ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি বেড়ে ওঠায় খণ্ডিত হচ্ছে শিশুর মেধার বিকাশ

প্রকাশিত: ১১:১৯, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি বেড়ে ওঠায় খণ্ডিত হচ্ছে শিশুর মেধার বিকাশ

সমুদ্র হক ॥ প্রায় দু’বছর বয়সী মেয়েটি এতটাই কিউট যে শিশু মনস্তত্ত্ব এখনই রপ্ত করেছে। মুখ টিপে মায়াবি হাসি দিয়ে প্রমাণ করে সে অনেক কিছুই বুঝতে পারছে। চোখেমুখে উদ্ভাসিত হয় মেধার ঝলক। হাসি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর কেল্টার বলেছেন, হাসতে থাকা শিশু ঠিকই জানে মিষ্টি হাসি ভালবাসার বন্ধন দৃঢ় করে। এই হাসিতেই স্বজনদের কাছ থেকে অকৃত্রিম আদর সহজে পাওয়া যায়। পারিবারিক বন্ধন পোক্ত হয়। ইতিবাচক মস্তিষ্ক রাসায়নিক অবমুক্ত হয়।শুরু হয় জীবন রসায়ন তৈরির পালা। শিশু জন্মগ্রহণের পরই মস্তিষ্কের মেধা বিকাশের নিউরন কার্যক্রম শুরু করে। নবজাতকদের কেউই এর বাইরে নয়। এই শিশুরা কিভাবে বেড়ে উঠছে এ নিয়ে বর্তমানের অভিভাবকরা অনেকটাই চিন্তিত। অন্যতম কারণ- এরা বেড়ে উঠছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির মধ্যে। একটা সময় ছিল একান্নবর্তী পরিবার। এখন তা ভেঙ্গে যাচ্ছে। একান্নবর্তীর শরিকরা নানা কারণে ভাগ হতে থাকে। এক পরিবারের সদস্যরা কিছুদিন আলাদা হাঁড়িতে রান্না করলেও একই উঠোনে এক সঙ্গে বাস করে। এই অবস্থারও বদল শুরু হয়। উঠোনে প্রাচীর দিয়ে পরিবারগুলো আলাদা হয়। সম্পর্কের দূরত্ব অবশ্য তখনও বেশি হয়নি। গ্রামের মানুষ শহরে-বন্দরে স্থানান্তরিত হওয়ায় সম্পর্কের দূরত্ব বেড়ে যায়। পরিবারের যে সদস্যরা এক সঙ্গে থাকত তারা বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। কেউ থাকে একই ফ্ল্যাটের আলাদা এ্যাপার্টমেন্টে। কেউ অন্য কোথাও বাড়ি করে বা ফ্ল্যাট নিয়ে বাস করতে থাকে। শুরু হয় নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির পালা, যা দিনে দিনে বিস্তৃত হচ্ছে। নিউক্লিয়ার পরিবারের এই ধারায় সবচেয়ে বেশি একাকীত্বের মধ্যে পড়েছে শিশুরা। বর্তমানে শহর, নগর এমনকি শহরের ছোঁয়া লাগা উন্নত উপজেলাগুলোতেও বেশিরভাগ দম্পতি থাকছে আলাদা। জীবনমান উন্নত করতে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই কোন না কোন চাকরি বেছে নিতে হচ্ছে। কেউ ঘরে বসে হস্তশিল্প, সেলাইসহ নানা কাজ করে সংসারের বাড়তি রোজগারের পথ করে নিচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই যখন চাকরির জন্য অফিসে যাচ্ছেন তখন সন্তান হয় থাকছে কাজের ‘বুয়ার’ কাছে, নয়ত ঘরে একাই। এদের শৈশব-কৈশোরে স্কুলে পাঠ নেয়ার সময়ে যে সহপাঠী পাচ্ছে তারাই হচ্ছে কাছের বন্ধু। বাড়ি ফিরে ফের একাকীত্বের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। দিনে দিনে এই একাকীত্ব তাদের সঙ্গী হচ্ছে। এরা বেড়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে, যা শিশু-কিশোর মনে বড় প্রভাব ফেলছে। বিজ্ঞান বলছে, প্রত্যেক শিশু এক শ’ বিলিয়ন নিউরন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। ¯œায়ুতন্ত্রের মস্তিষ্কেই সর্বাধিক বিকাশ ঘটে তিন বছরে ৮০ শতাংশ। পাঁচ বছরের মধ্যে বেড়ে যায় ৯০ শতাংশ। আট বছর পর্যন্ত বাড়ে ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ। আর বাকি ২ থেকে ৫ শতাংশ বাড়ে সারাজীবনে। নিউরনকে যতেœর সঙ্গে নার্সিং করলে একটি নিউরন ১৫ হাজার নিউরনের সংযোগ ঘটাতে পারে। সংযোগ যত শক্ত হয় ধীশক্তি তত বাড়ে। জন্মের পর আট বছরের মধ্যে শিশু পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার বুঝতে পারে, ব্যবহার শুরু করে। এই ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারও ৮০ শতাংশ ঘটে জন্মের তিন বছরের মধ্যেই। একই সময়ে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বা ‘সিক্সথ সেন্স’ অনুভূত হয়। দ্রুত প্রয়োজনে আপনা আপনি তার ব্যবহার শুরু করে। কীভাবে বেড়ে উঠছে প্রজন্মের শিশুরা। যে নিউরন এবং ইন্দ্রিয়ের পূর্ণ বিকাশ ঘটে মা-বাবা-আপনজনকে ঘিরে। মনোবিজ্ঞানীদের কাছে সবচেয়ে কঠিন অধ্যায় হলো শিশু মনোস্তত্ত্ব। শিশুর মনোস্তত্ত্ব প্রথমে বোঝার ক্ষমতা রাখে মা। তার অনেক পরে বাবা। জন্মের প্রক্রিয়ায় নারীর শিশু ধারণের থলিতে যে ভ্রƒণ বাড়ে তার প্রথম খোঁজ রাখে মা। থলিতে বেড়ে ওঠার সময় প্রাকৃতিক নলে (টিউব) সন্তান খাবার গ্রহণ করে। শিশুর মনোস্তত্ত্ব বোঝার ক্ষমতা অর্জন করে মা। সেই শিশুর চোখে পৃথিবীর প্রথম আলোকরশ্মি পড়ার সঙ্গেই বিস্ময়ের কান্না আর মায়ের আনন্দের হাসি গড়ে তোলে প্রকৃতির ভালবাসার ভুবন। এই ভুবন মা ও শিশুর হৃদয় থেকে সঞ্চারিত হতে থাকে। শিশু মাতৃদুগ্ধ পানের সময় মা ও সন্তানের মধ্যে যে ‘আই কনট্যাক্ট’ বা চোখের সংযোগ ঘটে তা স্বর্গীয় দ্যুতির এক অনুভূতি, যা টের পায় মা। শিশু মায়ের পরই খুঁজতে থাকে বাবাকে। ওই সময়ে বাবা কাছে না থাকলে সন্তানের সঙ্গে বাবার একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয় যা মেধা বিকাশের সবচেয়ে বড় বাধা। মেধার এই বিকাশ দ্রুত ঘটে যখন কাছের আত্মীয়স্বজন শিশুর পাশে থাকে, বিশেষ করে দাদা-দাদি, নানা-নানি, খালা-ফুপু, চাচি শিশুর মেধার বিকাশে সহযোগী হয়ে আসে। শিশু মা-বাবার পরই প্রথম প্রশ্ন ছুড়তে থাকে নানি-দাদির দিকে। তারপর দাদা-নানার দিকে। এরপর স্বজনের দিকে। এ সময় শিশুকে যদি মুক্ত করা না যায়, কোন কারণে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া হয় অথবা নেতিবাচক মনোভাব শো করা হয়; তাহলে বিষয়টি সবচেয়ে আগে বুঝতে পারে শিশু। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশুদের কখনও কঠোরভাবে শাসন করা মোটেও ঠিক নয়। অনেক মা-বাবা শিশুদের সরাসরি শাসনের সুরে কথা বলেন। এটা ঠিক নয়। শিশুকে ¯েœহের সুরে শাসন করা উচিত। শিশু যদি জন্মের পর থেকে অন্তত পাঁচ বছর পর্যন্ত মা-বাবাকে সময়মতো কাছে না পায় তাহলে তার মনের মধ্যে একাকীত্বের প্রচ্ছন্ন ধারা চলে আসে। এই একাকীত্ব পরবর্তী সময় তার চলার পথে প্রভাব ফেলবে, যা সুখময় নাও হতে পারে। বিষয়টি দৃষ্টিতে আনার দায়িত্ব মা-বাবার। শিশু যত হাসি-খুশিতে থাকে, প্রাণ খুলে হাসবে ততই তার মেধার বিকাশ ঘটবে দ্রুত। এই বিকাশই পরবর্তী সময় তাকে এগিয়ে নেবে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ইতিবাচক ভাব বিনিময় এক ধরনের মিথস্ক্রিয়াগত নৃত্য। বড়দের হাসির প্রত্যুত্তরে শিশু হাসি দিলে বুঝতে হবে তার মস্তিষ্কের বিকাশ সুন্দরভাবেই ঘটছে। মা ও শিশুর মধ্যে হাসি বিনিময়ে আছে একটি ছন্দ, যা সুরের তাল-লয় এনে দেয়। এই ছন্দের খুবই প্রয়োজন, যা শিশুর মেধা বিকাশে ও পরবর্তী জীবনের সকল অধ্যায়ে তাকে আলোকিত করে দেবে।
×