ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ মিনারে রাত দিন

প্রকাশিত: ১১:২২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

শহীদ মিনারে রাত দিন

মুনতাসির জিহাদ ॥ শহীদ মিনারের মূল বেদির আশপাশেই পড়ে থাকা বিচ্ছিন্ন ফুল কুড়িয়ে একটি ফুলের গুচ্ছ বানাচ্ছে সাত বছরের শিশু জাফর। এরপরে মূল বেদিতে গিয়ে ধীরে ধীরে রেখে দেয় সেই ফুলগুচ্ছ। কথা বলে জানা যায়, হাইকোর্ট মাজারের আশপাশেই তার বসবাস। ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবন ধারণ করে সে। শহীদ দিবস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না জাফর নামের শিশুটি। তবে সবার দেখাদেখি ফুল দিতে এসেছে বলে জানায় সে। আজ থেকে ঠিক ৬৭ বছর আগে ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যেসব বীরসন্তান জীবন দিয়েছিলেন, তাদেরই স্মরণে লাখো মানুষের জনস্রোত নেমেছে শহীদ মিনারে। যেন রাজধানীর সব পথ গিয়ে মিশেছে শহীদ মিনারে। কারও হাতে ফুল, কারো গালে লেখা রঙিন বর্ণমালা অথবা শুধু ২১। অপরিসীম শ্রদ্ধা ও পূর্ণ ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে ভাষা শহীদদের স্মরণ করে সারাদেশের মানুষ। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শুরু হয় ভাষা শহীদদের প্রতি বাঙালীর শ্রদ্ধা নিবেদন। রাত ১২টা ১মিনিটে রাষ্ট্রপতি এবং এরপরই প্রধানমন্ত্রী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ শেষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত অমর একুশের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি বাজানো হয়। পরবর্তীতে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চেীধুরী পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের পক্ষে সিনিয়র নেতাদের নিয়ে শহীদ মিনারে পুনরায় পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এছাড়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতারা শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শহীদ মিনারে পৌঁছানোর আগেই বুধবার রাত ১০টা থেকেই পার্শ্ববর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মাঠে অংশ নেয় বিভিন্ন স্তরের মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠন ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন শহীদ বেদিতে ফুল দেয়ার জন্য। আনুষ্ঠানিকতা শেষে হলে শহীদ মিনার সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা সারিবদ্ধভাবে ফুলের ঢালা নিয়ে শহীদ মিনারের মূল বেদিতে শ্রদ্ধা জানায়। ভোর হওয়ার পর পরই শহীদ মিনার এলাকায় নামে হাজার হাজার মানুষের ঢল। এদের কারও হাতে ফুল, ফুলের তোড়া কিংবা মালা। শহীদ বেদিতে গিয়ে ৬৭ বছর আগে ভাষার জন্য প্রাণ দেয়া বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার ফুলটা ছুঁয়ে দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন তারা। রাজধানী ঢাকা ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করতে দেখা যায়। প্রথম প্রহরের পর থেকে বেজে চলছে বাঙালীর অতি পরিচিত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।’ একই সঙ্গে শহীদ বেদির ডান পাশে স্থাপিত ঘোষণা মঞ্চ থেকে ঘোষণা হচ্ছে, যে সংগঠনগুলো শদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছে তাদের নাম। এভাবেই চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। বিকেলের মধ্যেই ঘোষণা মঞ্চের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শেষ হয়। বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও ভাষা শহীদদের স্মরণ করেছেন। অনেক বিদেশীকে পাঞ্জাবি পরিধান করে ফুল হাতে শহীদ মিনারে আসতে দেখা যায়। কথা বলে জানা যায়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলাভাষার জন্য জীবন দেয়া বীরদের স্মরণ করার জন্যই এসেছেন। শহীদ মিনারে এত মানুষের ঢল দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন তারা। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে শ্রদ্ধা জানায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ আরও অনেকে। ভোর হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ফুল দিতে আসে শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ইডেন মহিলা কলেজ ও গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থীরা ফুলের ঢালি হাতে শহীদ মিনারে প্রবেশ করে। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে ফুল দিতে আসে। শহীদ মিনারের মূল বেদিতে সাজানো হয়েছে গোলাপ ও গাঁদা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ফুল দিয়ে লেখা হয়েছে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি ২১’। ফুলের ঢালা সাজানো হয়েছে বেদির চারপাশজুড়ে। শ্রদ্ধা আর শোকের আবহ পড়েছে দর্শনার্থীদের পরনে পোশাকে। অধিকাংশের গায়ে সাদা-কালো পাঞ্জাবি আর শাড়ি। অবশ্য অনেকে লাল-হলুদ জামাও পরিধান করেছে। বৃহস্পতিবার দিনটি ছিল শুধু বাংলাভাষার জন্য। যে ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে শহীদ রফিক, জব্বার, বরকত; সেই বাংলাতে রচিত বইয়ের খোঁজে বইমেলায় এসে শহীদ মিনারের জনস্রোত মিশেছে। শহীদ মিনারে মানুষের ঢলের প্রভাব পড়েছে বইমেলায়।
×