ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফুটবলার থেকে এ্যাথলেট হয়ে আক্ষেপ নেই রুমকীর...

প্রকাশিত: ১২:১৮, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ফুটবলার থেকে এ্যাথলেট হয়ে আক্ষেপ নেই রুমকীর...

রুমেল খান ॥ বাংলাদেশের টিভি নাটকের সবচেয়ে রোমান্টিক নায়ক হিসেবে যিনি অবিসংবাদিতভাবে সেরা, তিনি আফজাল হোসেন। তিনি ছিলেন একজন লেখকও। আশির দশকে তিনি একটি প্রেমের উপন্যাস লেখেন। পরে সেটা একই নামে টিভি নাটক হয়, নাম ছিল ‘পারলে না রুমকি’। এর বছর চল্লিশেক পর রুমকী (এই মেয়েটির নামের বানানটি কিঞ্চিৎ ভিন্ন) পারলো। প্রেমঘটিত ব্যাপারে নয় খেলাধুলার ব্যাপারে। না, এ উপন্যাস বা নাটকের সেই রুমকি নয়, এ আরেক রুমকী, রক্ত-মাংসের বাস্তবের এক চরিত্র। বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের এখন জয় জয়কার। সাফল্য, অর্থ, খ্যাতি... সবই পাচ্ছে তারা। এর অংশীদার হতে পারতেন রুমকীও। মারিয়া, কৃষ্ণা, সাবিনাদের সঙ্গেই অনেকদিন ক্যাম্প করেছেন তিনি। ছিলেন গোলরক্ষক। কিন্তু এক সময় ফুটবল ছেড়ে পুরোপুরি বনে গেলেন এ্যাথলেট। কেন? এর উত্তর পেতে হলে জানতে হবে রুমকীর অতীত জীবন। উম্মে হাফসা রুমকী। বয়স ১৯ ছুঁইছুঁই (জন্ম ২০০০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর)। সিরাজগঞ্জের সদর থানার দিয়ার ধানগড়া গ্রামের ব্যবসায়ী বাবা আবদুর রহিম এবং গৃহিণী মা পারুল বেগমের পাঁচ কন্যার (কোন ছেলে নেই) চতুর্থ সন্তান রুমকী। ছোট বোন রাফিন আক্তার রিনতিও একজন এ্যাথলেট। বিকেএসপিতে ক’দিন আগেই ট্রায়াল দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায়। ঢাকার বনানীর রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক বিষয় নিয়ে দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী রুমকী জনকণ্ঠকে শোনান তার খেলোয়াড় হবার বিচিত্র কাহিনী। তখন তিনি পড়েন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। স্কুলে সব ধরনের খেলাই খেলতেন। যদিও ক্রিকেটটাই খেলতেন বেশি। ছিলেন ওপেনার কাম উইকেটকিপার। ২০১২ সালে ইন্টারস্কুল প্রতিযাগিতায় (বরিশালে অনুষ্ঠিত) হাইজাম্পে গোল্ড মেডেল লাভ করেন। যা ছিল তার প্রথম কোন সাফল্য। বর্শা নিক্ষেপেও তাই। এছাড়া রৌপ্য জেতেন ২০০ মিটার স্প্রিন্টে। সে-ই লাভ করেন ওই প্রতিযোগিতার সেরা এ্যাথলেটের পুরস্কার। ২০১৪ সালের আন্তঃজেলা প্রতিযোগিতাতেও হাইজাম্পে স্বর্ণ জেতেন। ওই প্রতিযোগিতায় রুমকীর উদ্ভাসিত নৈপুণ্যে নজর পড়ে চট্টগ্রাম বিজেএমসির। কোচ আমির আলীর মাধ্যমে সেখানে যোগ দেন। ওই বছরই সিজেকেএস লীগে আগ্রাবাদ নওজোয়ানের হয়ে অংশ নিয়ে হাইজাম্পে স্বর্ণ জেতেন। ওই বছরই প্রথমবারের মতো অংশ নেন জাতীয় জুনিয়র এ্যাথলেটিক্সে। এবার তার দল নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থা। হাইজাম্পে স্বর্ণ এবং চার গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে জেতেন তাম্রপদক। ২০১৪ সালে সেনাবাহিনী এবং ২০১৭ সালে বাংলাদেশ জেলে যোগ দেন রুমকী। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই দু’দলের হয়ে জাতীয় এ্যাথলেটিক্সে মোট ১০টি পদক জিতেছেন। এর মধ্যে ২টি স্বর্ণ, ১টি রৌপ্য এবং ৭টি তাম্রপদক। পদকগুলোর মধ্যে ৮টিই জিতেছেন জেলের হয়ে, এর মধ্যে ২টি স্বর্ণও আছে। ২০১৪ সালে প্ল্যান অনুর্ধ-১৪ বালিকা ফুটবল কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছিলেন রুমকী সিরাজগঞ্জ জেলা দলের হয়ে। তখন খেলতেন মিডফিল্ডার পজিশনে। ক্যাম্প হয়েছিল রাজশাহীতে। কোচ ছিলেন আজকের জাতীয় নারী দলের স্বনামধন্য কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। তিনি রুমকীর দীর্ঘ উচ্চতা দেখে তাকে গোলরক্ষক হিসেবে খেলার পরামর্শ দেন। রাজশাহী বনাম সিলেট দলের মধ্যে একটি ম্যাচ হয়। রুমকী রাজশাহী দলের হয়ে খেলেন এবং তার দল ০-১ গোলে হেরে যায়। ওই সময়ই তিনি চট্টগ্রাম বিজেএমসির হয়ে এ্যাথলেট হিসেবে খেলার ডাক পান। ২০১৭ সালের মার্চে বাফুফে লম্বা নারী গোলরক্ষক চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। ততদিনে সেনাবাহিনী থেকে বের হয়ে গেছেন রুমকী। বাফুফের বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করলেন, ট্রায়াল দিলেন এবং টিকেও গেলেন। রুমকীর গোলকিপিংয়ের ধরন দেখে তাকে দলে নিলেন তখনকার গোলরক্ষক নিউজিল্যান্ডের কোচ রায়ান স্যানফোর্ড। উন্নত প্রশিক্ষণে অল্প সময়েই দ্রুত উন্নতি ঘটে রুমকীর গোলকিপিংয়ে। এরপর চীন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া সফরে যায় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে। সেখানে গিয়ে ৬টি প্রীতি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান রুমকী। নৈপুণ্যও ছিল বেশ ভাল। তবে কোরিয়া সফরে হাতে চোট পাওয়ায় কোন ম্যাচ খেলেননি। এরপরই পল স্মলি এবং ছোটন রুমকীকে জানান, সিনিয়র দলেও তাকে খেলানোর কথা। ‘কিন্তু এতে একটু অসুবিধায় পড়লাম’, রুমকীর স্মৃতিচারণ, ‘জানালাম দু’দিন পরই জাতীয় এ্যাথলেটিক্স হবে। সেখানে অংশ নিতে চাই। জাতীয় দলের খেলা অনেক পরে হবে। কাজেই সমস্যা হবে না। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট এ কথা মানেনি। বললো, যে কোন একটা বেছে নিতে এবং সিদ্ধান্ত দ্রুত জানাতে। এখন বাফুফেতে যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে তখন ততটা ছিল না। ফলে এ্যাথলেটিক্সকেই বেছে নিই এবং আগস্টে বাফুফের ট্রেনিং ক্যাম্প ছেড়ে চলে আসি। চলে না এলে সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে গিয়ে জাতীয় দলের হয়ে খেললে এক নম্বর জার্সিটা আমারই হতো এবং প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারতাম।’ দলীয় খেলার চেয়ে একক খেলাই বেশি ভাল লাগে, সাফল্যটা নিজের ওপরই নির্ভর করে, যেটা দলীয় খেলায় নেই... এ কারণেই ফুটবল ছেড়ে এ্যাথলেটিক্সে বসত গড়েছেন রুমকী, ‘এখানে এসে আমি কোন ভুল করিনি। জেলের হয়ে স্বর্ণ জেতায় গত বছর কর্তৃপক্ষ আমাকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা বোনাস দিয়েছিলেন।’ তৃপ্তির ঝলক খেলে যায় রুমকির চোখে। তাই ফুটবল ছেড়ে দেয়ায় কোন আক্ষেপ নেই তার। তারপরও কী ফুটবলের জন্য মনটা পোড়ে না? ‘অবশ্যই। বাফুফে যদি মনে করে আগামীতে আমাকে তাদের দরকার আছে, তারা যদি আমাকে ডাকে তাহলে নিশ্চয়ই আবারও ফুটবলে ফিরে আসতে কোন আপত্তি নেই। দেশের হয়ে আবারও পারফর্ম করতে চাই।’ রুমকীর ভাষ্য।
×