ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ ইটভাঁটি অবৈধ

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ ইটভাঁটি অবৈধ

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ উত্তরাঞ্চলের যত ইটভাঁটি আছে তার প্রায় অর্ধেক অবৈধ। বগুড়ায় অবস্থিত রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী উত্তরের ১৬ জেলায় ইটভাঁটির সংখ্যা ১ হাজার ৯শ’ ৮০টি। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেয়া আছে ১ হাজার ১শ’ ১০টির। দু’বছর আগে ২০১৬ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ করে ইটভাঁটি স্থাপনে নতুন নীতিমালা ও আইন জারি করা হয়। খোঁজখবর করে জানা যায় এই আইন মেনে চলা হয় না। এদিকে ইট তৈরির জন্য যে মাটি ব্যবহার হরা হচ্ছে তারও কোন নীতি মানা হচ্ছে না। আইনে বলা আছে আবাদি জমি, খাল বিল, নদী নালা, পুকুর, মজা পুকুরের আশপাশে, বসতভিটা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আশপাশে থেকে ইটভাঁটির মাটি কাটা চলবে না। কোনভাবেই আবাদি ভূমির টপসয়েল নেয়া চলবে না। বসতবাড়ির আশপাশে ইটভাঁটি স্থাপন করা যাবে না। মাঠপর্যায়ে ঘুরে দেখা যায় বেশিরভাগ ইটভাঁটি কোন নিয়ম নীতি মানছে না। এমনও ইটভাঁটি আছে যা রাস্তা সীমানার মাটি কেটে নিয়েছে। এই বিষয়ে ইটভাঁটি মালিক সমিতির সভাপতির বলেন, এই আইন মেনে ইটভাঁটি চালাতে গেলে ইট তৈরির মাটি পাওয়া যাবে না। আবার সরকারীভাবে ইট তৈরিতে যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে তা স্থাপন করতে বহু কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। এই প্রযুক্তিতে ইট উৎপাদনের পর তা বেশি দামে বিক্রি না করলে লোকসান পোহাতে হবে, এই মন্তব্য ইটভাঁটি মালিকদের। তবে পরিবেশ অধিদফতর সূত্র জানাচ্ছে, পরিবেশ সংরক্ষণে ইটভাঁটিকে আধুনিকায়ন করে উন্নত ইট প্রস্তুত করে দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশে ইটের চাহিদা বেড়েছে। একদা গ্রামাঞ্চলে বাঁশের বেড়ায় খড় বা ছনের চালায় কুঁড়ে ঘর নির্মিত হতো সেই অবস্থা এখন আর নেই। দরিদ্রতার হার কমে জীবনমান উন্নত হওয়ার সঙ্গে বসতভিটা উন্নত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে তিন ধরনের ইটভাঁটি আছে। স্থায়ী চিমনি ভাঁটি, জিগজ্যাগ ভাঁটি ও হাইব্রিড হফসম্যান ভাঁটি। বগুড়ায় ইটভাঁটি ২শ’ ১১টি। এর মধ্যে জিগজাগ ইটভাঁটি ১শ’ ৮টি, স্থায়ী চিমনি (১শ’ ২০ ফুট উচ্চতার চিমনি) ৯৭টি ও হাইব্রিড হফসম্যান পদ্ধতির ইটভাঁটি ২। এর মধ্যে একটি টানেল ভাঁটি। পাবনায় ইটভাঁটি ১শ’ ১৬টি, রাজশাহীতে ১শ’ ৯৪টি, জয়পুরহাটে ১শ’ ৪৭টি, সিরাজগঞ্জে ১শ’ ৮ টি, গাইবান্ধায় ১শ’ ১৩টি, নাটোরে ১শ’ ২৪টি, নওগাঁয় ১শ’ ৫৭টি, রংপুরে ২শ’ ৩০টি, দিনাজপুরে ২শ’ ১টি, নীলফামারীতে ৪৪টি, লালমনিরহাটে ৪৪টি ও পঞ্চগড়ে ৪৩টি। এই বিষয়ে বগুড়া আঞ্চলিক পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি। তিনি মোবাইল ফোন ধরেননি। অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ভিন্ন একটি উর্ধতন সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলে অনুমোদনহীন অনেক ইটভাঁটি আছে। এসব ইটভাঁটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে বর্তমান চিত্র হলো, এখনও অনুমোদনহীন কোন ইটভাঁটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মির্জাপুরে তিন ফসলি জমির মাটি বিক্রি নিজস্ব সংবাদদাতা, মির্জাপুর থেকে জানান, মির্জাপুরে রোরো প্রকল্প বন্ধ করে তিন ফসলি জমির মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে ইটভাঁটিয়। ভেকু মেশিন দিয়ে কেটে নেয়া এই মাটি ট্রাক দিয়ে পরিবহন করতে লৌহজং নদীতে পাশাপাশি তিনটি বাঁধ দিয়েছে ভাঁটি মালিক ও মাটি ব্যবসায়ীরা। ভাঁটি মালিকরা এলাকার কৃষকদের জিম্মি করে তিন ফসলি জমির মাটি ভেকু মেশিন দিয়ে কেটে প্রতিদিন শত শত ট্রাক ইটভাঁটিয় নিলেও ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছে না। এদিকে লৌহজং নদীতে পর পর তিনটি বাঁধ দেয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে নৌ যোগাযোগ, বিলুপ্তি ঘটছে মৎস্য সম্পদের। উপজেলার বহুরিয়া ইউনিয়নের কোর্ট বহুরিয়া এলাকায় মঙ্গলবার সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ইটভাঁটি মালিক শহীদ ও মাটি ব্যবসায়ী মোতালেব তিন ফসলি জমির মাটি ভেকু মেশিন দিয়ে কেটে নিচ্ছে ইটভাঁটিয়। এই মাটি ট্রাক দিয়ে পরিবহনের জন্য কোর্ট বহুরিয়া এলাকায় লৌহজং নদীতে পর পর তিনটি বাঁধ নির্মাণ করেছেন তারা। নদীতে বাঁধ নির্মাণ করায় নদীটিতে বন্ধ হয়ে গেছে পানি প্রবাহ ও নৌ যোগাযোগ। অন্যদিকে পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় প্রজনন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বিলুপ্তি ঘটছে মৎস্য সম্পদের। কৃষককদের জিম্মি করে প্রতিবছর হাজার হাজার ট্রাক ফসলি জমির মাটি ভেকু মেশিন দিয়ে কেটে নেয়ায় ইতোমধ্যে ওই এলাকার বেশ কয়েকটি বোরো প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি বছরও একটি বোরো প্রকল্প বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ওই এলাকার কৃষকরা অভিযোগ করে বলেছেন, প্রথমে ভাঁটি মালিক ও মাটি ব্যবসায়ীরা লোভ দেখিয়ে উচ্চমূল্য দিয়ে একজন কৃষকের এক টুকরো জমি কিনেন। তারপর ওই জমির মাটি সীমানা ঘেঁষে কমপক্ষে ২০ ফুট গভীর করে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে নেন। বৃষ্টি বা বর্ষা এলে চার পাশের জমির মাটি ভেঙ্গে ওই জমিতে গিয়ে পড়ে। পরে বাধ্য হয়ে জমির মালিক কম দামে তার জমির মাটি তাদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এভাবে প্রতিবছর কৃষক শত শত একর জমি খোয়াচ্ছেন ভাঁটি মালিক ও মাটি ব্যবসায়ীদের কাছে। শুধু যে জমি খোয়াচ্ছেন তা নয়, ওই এলাকার কমপক্ষে ১৫টি পরিবার এদের অত্যাচারে বাড়ি জমি হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছে বলে এলাকার লোকজন অভিযোগ করেছেন। মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল মালেক বলেন, কোট বহুরিয়া এলাকায় কিছুদিন আগে আমরা অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেছি এবং বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছি। ফসলি জমি কেটে ইট ভাঁটিতে মাটি নিতে নদীতে বাঁধ দেয়ার অনুমতি দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। ওই এলাকায় শীঘ্রই অভিযান চালানো হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। দিনাজপুরে হুমকির মুখে ফসল স্টাফ রিপোর্টার দিনাজপুর থেকে জানান, দিনাজপুরের ‘শস্যভা-ার’ বলে খ্যাত সদর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই ফসলি জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে ইটভাঁটি। এই ভাঁটি নির্মাণে নেয়া হয়নি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর ও লো প্রশাসনের কোন অনুমতি। ইটভাঁটি নির্মাণ করা হলে এর আশপাশের কয়েক শ’ একর আবাদি জমি চাষাবাদের ক্ষমতা হারাবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। একই সঙ্গে পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি হবে। দিনাজপুর সদর উপজেলার ৬নং ইউনিয়নে অবস্থিত ঘুঘুডাঙ্গা গ্রাম। এলাকাটি ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্তজোড়া ধানসহ বিভিন্ন সবজির উর্বরা জমি। এখন সেই উর্বরা জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে ইটভাঁটি। শ্রমিকরা পুরোদমে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নির্মিত ইটভাঁটির পাশেই চলছে জমিতে বোরো রোপণ-এর কাজ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই ইটভাঁটি নির্মাণ করতে পরিবেশ অধিদফতরের কোন ছাড়পত্র নেয়নি ইটভাঁটি কর্তৃপক্ষ। নেয়া হয়নি কৃষি বিভাগেরও কোন অনুমতি। এমনকি জেলা প্রশাসনের কোন অনুমতি নেয়নি। স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন, ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে ভাঁটি মালিক ফসলি জমিতে এই নির্মাণ কাজ করছেন। স্থানীয় কৃষক জমির উদ্দীন বলেন, ইটভাঁটি নির্মাণ হলে আমাদের ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাবে। ইটভাঁটির আশপাশে রয়েছে কয়েক শ’ একর আবাদি জমি। যেখানে ধান, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি ফলানো হয়। ইটভাঁটি চালু হলে আমরা চরম বিপদে পড়ব। তিনি জানান, নির্মাণাধীন ইটভাঁটির মালিক প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসীন দলের লোক হওয়ায়, ভয়ে এই কাজের কেউ প্রতিবাদ করতে পারছে না। ইটভাঁটির ম্যানেজার মমিনুল ইসলাম জানান, মালিকের নির্দেশে ইটভাঁটি নির্মাণের কাজ চলছে। চিমনির কাজ শেষ হলে আগামী মৌসুম থেকে ইট তৈরি শুরু হবে। ইটভাঁটির মালিক মোঃ মহসিন আলী জানান, তিনি পরিবেশ অধিদফতরের কোন ছাড়পত্র এখনও পাননি। তবে তা কয়েকদিনের মধ্যে পেয়ে যাবেন বলে তিনি দাবি করেন। কৃষি বিভাগের ছাড়পত্রও এ মাসেই পেয়ে যাবেন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘এমআর ব্রিকস’ নামে এই নতুন ভাঁটির জন্য জেলা প্রশাসনে টাকা জমা দেয়া হয়েছে। দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মোহাম্মদ শামীম জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে এমআর ব্রিকস নামক ইটভাঁটির কোন ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। ফসলি জমিতে ইটভাঁটি নির্মাণ হলে আশপাশের ফসলের অনেক ক্ষতি হবে। পরিবেশ অধিদফতর রংপুর কার্যালয়ের পরিদর্শক কাজী সাইফুদ্দিন জানান, পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র না নিয়ে ফসলি জমিতে ইটভাঁটি নির্মাণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিয়েই ইটভাঁটি নির্মাণের কাজ করতে হবে। ইটভাঁটির ধোঁয়ার ফলে আশপাশের পরিবেশের ক্ষতি হবে। কৃষি বিভাগ থেকে অনাবাদি জমির প্রত্যয়ন না দিলে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের প্রশ্নই আসে না। দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জয়নুল আবেদীন জানান, পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র না নিয়ে ইটভাঁটি নির্মাণ দ-নীয় অপরাধ। তদন্ত করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×