ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে দিগন্তজোড়া বিষ বৃক্ষের চাষ ॥ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে কৃষক

প্রকাশিত: ০২:১৪, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

টাঙ্গাইলে দিগন্তজোড়া বিষ বৃক্ষের চাষ ॥ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে কৃষক

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল ॥ টাঙ্গাইলে নানা প্রণোদনায় কৃষকরা কয়েক বছর তামাকের পরিবর্তে ভুট্টা চাষে আগ্রহী হলেও এবার দিগন্তব্যাপী বিষবৃক্ষ নামক তামাকের চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। টোব্যাকো কোম্পানীর প্রলোভনে পড়ে অধিক লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছে। তামাক চাষে ‘কারগিল’ নামক সার প্রয়োগের ফলে চাষি ও তার পরিবারের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে, ফসলি জমি উর্বর শক্তি হারাচ্ছে। জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার গোপালপুর, ভূঞাপুর, কালিহাতী, টাঙ্গাইল সদর, দেলদুয়ার ও নাগরপুর উপজেলার চরাঞ্চলে ব্যাপক হারে তামাক চাষ হচ্ছে। জেলার এই ৬টি উপজেলার পশ্চিম এলাকা চরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। যমুনা, ধলেশ্বরী, লৌহজং ও নিউ ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেষা এসব চরাঞ্চলে প্রতিবছরই বর্ষাকালে পলি পড়ে। ফলে এসব এলাকার জমি উর্বর হয়ে থাকে। জমিগুলো বালি ও দো’আশ মাটি হওয়ায় এক সময় মশুর ও মাস কালাই, ভূট্টা, চিনা, কাউন, গম, আলু, আখ, বাদাম ইত্যাদি ফসল বেশি পরিমাণে উৎপাদন হতো। স্থানীয় কৃষকরা বহুজাতিক ও দেশীয় টোব্যাকো কোম্পানীর প্রলোভনে পড়ে ওইসব ফসল চাষ না করে বেশি লাভের আশায় ‘বিষবৃক্ষ’ তামাক চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠছে। বাংলাদেশে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন বন্ধ করে সরকার বিকল্প কৃষিজ উৎপাদনে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করায় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের তৎপরতায় বিগত ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জেলায় তামাক চাষ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কিন্তু এ বছর টোব্যাকো কোম্পানীর প্রতিনিধিরা কৃষকদের অধিক মুনাফার পাশাপাশি সার, বীজ ও সেচের জন্য নগদ টাকা মূলধন(ঋণ) হিসেবে দেয়ায় আবার তামাক চাষের পরিমাণ কয়েকগুন বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি, ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানী, আকিজ টোব্যাকো কোম্পানী, আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানী, বিভিন্ন বিড়ি, সিগারেট ও জর্দা কোম্পানী সহ আরো কিছু কোম্পানী তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। সরকারি কোনরূপ নিষেধাজ্ঞা না থাকার ফলে কৃষকদের এ চাষে উৎসাহ জোগাচ্ছে টোব্যাকো কোম্পানীগুলো। তামাক চাষে বহুজাতিক কোম্পানীগুলো অগ্রীম টাকা, বীজ ও সার প্রদান এবং বিভিন্নভাবে তামাক চাষে সাহায্য-সহযোগিতা করছে। সরকার যখন চেষ্টা করছে তামাক চাষের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষে কৃষকদের উৎসাহী করতে তখনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে টোব্যাকো কোম্পানীর অপতৎপরতায় তামাক চাষ ধীরে ধীরে বাড়ছে। তামাক চাষে জড়িত চাষি ও তাদের পরিবারের অভিযোগ, তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক উল্লেখ বা এ চাষ বন্ধে কৃষি কর্মকর্তাদের কোনরূপ পদক্ষেপ না থাকায় দিনদিন এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের মতে, প্রতি শতাংশ জমি বাবদ পাঁচ কেজি সার ও পরিমাণমত তামাক বীজ সরবরাহ করছে টোব্যাকো কোম্পানী। তামাক চাষে শতাংশ প্রতি প্রায় এক হাজার টাকার তামাক উৎপাদন করা যায়। মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কম পরিশ্রমে তামাক অধিক লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা এ চাষে উদ্ধুদ্ধ হচ্ছে। কারগিল সার বা অতিরিক্ত সার ব্যবহারের ফলে কৃষি জমিগুলো নষ্ট হওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন চাষিরা। কিন্তু লাভ বেশি হচ্ছে পাশাপাশি এ কথাও বলছেন। কৃষক পরিবারগুলো জানায়, তামাক শুকানোসহ ঘরে মজুদ করে রাখতে তাদের শারীরিক নানা সমস্যা হচ্ছে। বাড়ির অনেকেরই চর্ম, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানী ইত্যাদি রোগ দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, দীর্ঘদিন তামাক চাষে যুক্ত থাকলে ক্যান্সার, পেটের পীড়া, বুক ও ঘাড়ে ব্যাথা সহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কৃষি বিদদের মতে তামাকের শিকড় মাটির অনেক গভীর থেকে খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে। ফলে তামাকের জমিতে ৪-৫ বছর পর্যন্ত অন্য ফসল উৎপাদন হয় না। এছাড়া তামাক গাছের পাতা বড় করার জন্য ৩-৪ ফুট লম্বা হলেই মগডাল ভেঙে ‘কারগিল’ নামক সার প্রয়োগ করা হয়। এই ‘কারগিল’ সার অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ী) উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক জানান, সরকারি কোন বিধি-নিষেধ না থাকায় তামাক চাষের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা না থাকার সুযোগ নিয়ে টোব্যাকো কোম্পানীগুলো নগদ অর্থ আর নানা সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে এ চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে। এ অবস্থা স্বত্ত্বেও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কৃষি কর্মকর্তারা জমির উর্বরতা নষ্ট ও স্বাস্থ্যের কুফল তুলে ধরে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
×