ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই থেমে নেই

প্রকাশিত: ০৯:২০, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই থেমে নেই

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁর আমলেই ১৯৯৯ সালে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত হয়ে ১৯৩টি দেশে দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল রাষ্ট্রভাষার দাবি আদায়ের আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। তাই বলা যায়, ভাষা শহীদদের রক্তে স্নাত হওয়া সত্ত্বেও ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বর্তমান সময়েও আমাদের লড়াই থেমে নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে। এই গ্রন্থে তিনি তুলে ধরেছেন পাকিস্তানী শাসক ও এদেশীয় দোসরদের বাংলা ভাষার প্রতি বিরূপ মনোভঙ্গি। আর রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে বেগবান করার কঠিন সময়ের কথা লেখকের নিজের জবানিতে ব্যক্ত হয়েছে। তবে সেদিন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে অভিপ্রায় ছিল ভাষাসৈনিকদের তার অনেক কিছুই আজ অপূর্ণ রয়ে গেছে। ৬৭ বছর পর আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার মান ও মর্যাদা নিয়ে কথা বলি, নির্ভুল বানানে বাংলা লেখার জন্য তর্কবিতর্কে লিপ্ত হই আর হরহামেশায় ভুলে ভরা বাংলা লেখা নিয়ে খেদোক্তি করি। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষা ব্যবহারে সকলকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বাংলা শব্দের বানান ও উচ্চারণ সম্পর্কে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ‘ইদানীং বাংলা বলতে গিয়ে ইংরেজী বলার একটা বিচিত্র প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জানি না, অনেক ছেলেমেয়ের মাঝে এখন এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে যেন তাদের মর্যাদাই থাকে না- এমন একটা ভাব।’ শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, প্রমিত বাংলা শব্দের বানান এবং উচ্চারণ সুনির্দিষ্ট। এখানে কোন আপোস চলবে না। বাংলা ভাষাকে মিশ্রিত বা বিকৃত করে বলার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। তবে আঞ্চলিক ভাষাকে কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। কারণ, আঞ্চলিক ভাষাও বাংলা ভাষা, এর নিজস্বতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে বলা চলে কেবল নতুন প্রজন্ম নয়, সরকারী- বেসরকারী অনেক প্রতিষ্ঠানই বাংলার সঙ্গে ইংরেজী মিশিয়ে জনগণের কাছে বাংলার চেয়ে বিদেশি ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। যেমন, কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘সরকারী প্রতিষ্ঠানের ইংরেজীপ্রীতি বেশি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ইংরেজী শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার কীভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠেছে তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যেমন বাংলায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন লেখা থাকলেও তার সংক্ষিপ্ত রূপ ইংরেজীতে ‘ডিএনসিসি’। অর্থাৎ ঢাকা নর্থ সিটি কর্পোরেশন। ঠিক একই পদ্ধতিতে নাম ব্যবহার করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনও (ডিএসসিসি)। অথচ বাংলা ব্যবহার না করার অভিযোগে কোথাও কোথাও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানের পরিচিতিমূলক সাইন বোর্ড। তাছাড়া হরহামেশায় ইংরেজীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণও করছে সরকারের ভেতরের কিছু ব্যক্তিবর্গ। এভাবে বহু প্রতিষ্ঠানের বাংলা নামের পাশে সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে ইংরেজী শব্দের বিশদ ব্যবহার আছে যত্রতত্র। যেমন, ইউনিয়ন পরিষদ ‘ইউপি’, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করর্পোরেশন-বিআইডব্লিউটিসি, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন- ইউজিসি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড- এনসিটিবি, নগর উন্নয়ন অধিফতর- ইউডিডি, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন- বিটিআরসি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন-বিআরটিসি, ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কতৃর্পক্ষ-ডিটিসিএ, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরেটি- বিআরটিএ প্রভৃতি। এ ধরনের ব্যবহারের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো ‘ওয়াসা’। ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সুয়্যারেজ অথরেটির সংক্ষিপ্ত রূপ এটি। এ রকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে মানুষের মুখে মুখে বিদেশী শব্দ এভাবেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হুমকির মুখে পড়বে বাংলা শব্দ, যা জাতি সত্তার মৌলিক উপাদানের ওপর হুমকি স্বরূপ। যে কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন তা থেকে নিস্তার পেতে হলে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এসব তৎপরতার অবসান ঘটানো দরকার। কারণ, কথায় কথায় এসব সংক্ষিপ্ত নাম ব্যবহার করছে সর্বস্তরের মানুষ। যা কেবল বাংলা ভাষা প্রয়োগের সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করছে না, এর মধ্য দিয়ে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান করা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। উল্লেখ্য, মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের ১৬৯৬/২০১৪ নং রিট পিটিশনে প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী সকল প্রতিষ্ঠানের (দূতাবাস, বিদেশী সংস্থা ও তৎসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতীত) নামফলক, সাইনবোর্ড, বিল বোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে হাইকোর্টের আদেশটি ডিএনসিসি এলাকায় নিশ্চিত করার দায়িত্ব ডিএনসিসি কতৃর্পক্ষকে দেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের শুরুতে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ৭ দিনের মধ্যে নামফলক, সাইন বোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লিখতে বলা হয়। হাইকোটের্র আদেশ এবং ডিএনসিসির গণবিজ্ঞপ্তি বাস্তবায়ন না করার অপরাধে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ অনুযায়ী অনেক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হলেও সরকারী অফিসগুলো ইংরেজী শব্দ নিয়েই বহাল তবিয়তে আছে। গত বছর বিচারপতির পদত্যাগপত্রে বাংলা বানান ভুল নিয়ে হৈচৈ হয়ে গেল। আবার উপরের তথ্য থেকে আমরা দেখতে পেলাম সরকারী সাইন বোর্ড, রাস্তার প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, ব্যানারে বানান ভুল নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বাংলা একাডেমি কর্তৃক সঠিক বানানের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকলেও মানতে নারাজ অনেকেই। এ জন্য ঢাকার প্রধান সড়কের পাশে ফার্মেসি ও ফটোস্ট্যাটের দোকানের প্রত্যেকটির সাইন বোর্ডে লেখা ‘ফার্মেসি’, ‘ফটোস্ট্যাট’ ইত্যাদি। কয়েকটি দোকানে স্টোরের জায়গায় ‘স্টোর’ লিখে রাখা হয়েছে। রাস্তা সংলগ্ন বেশকিছু রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ে যেগুলোতে লেখা ‘রেস্টুরেন্ট’। একটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের নামের বানানে ভুল করে মর্ডান না লিখে ‘ণ’ ‘মর্ডাণ’ লেখা রয়েছে। অথচ আমরা জানি, কোন বিদেশী শব্দে ণ, ষ এবং ঈ কার হবে না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুণ্যস্থান ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণ। কিন্তু সেখানেও বানান ভুল দেখতে পাবেন। মেডিক্যালে ঢুকেই নজরে আসে ‘বার্ন এবং সার্জারি’ (বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট) বানান ভুল। একটু পেছন ফিরলেই চোখে মিলবে ইমারজেন্সি কমপ্লেক্সের ‘ইমারজেন্সি’ ভুল বানান। অন্যদিকে সুপ্রীম কোর্টের বানান ভুল করে ‘সুপ্রীম’ লেখা। জাতীয় প্রেসক্লাবের কর্মচারী ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন বানানটাই ‘ষ’ দিয়ে লেখা। আবার একই শব্দ একেক সাইন বোর্ড বা দেয়ালে লেখা হচ্ছে একেক রকম। এতে একদিকে যেমন বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটছে তেমনি শিশুর ভাষা বিকাশে ত্রুটি ঘটছে বলে ভাষা বিশেষজ্ঞদের অভিমত। শিশুরা আগ্রহ নিয়ে সাইন বোর্ডগুলো পড়ে। আর সেখানে যদি ভুল থাকে তবে সেটি তাদের মনে গেঁথে যায়। অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত আর্টিস্ট দ্বারা যখন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল কিংবা বাসা বাড়ির কাজ করা তখন সে সব সাইন বোর্ড, ব্যানার ও দেয়াল লিখন বাংলা বানানে ভুলে ভরা থাকছে। সাইন বোর্ড হচ্ছে চোখের ঝিলিক; প্রতিষ্ঠানের আয়না। প্রতিষ্ঠানের পরিচয় যদি ভুল বানানে থাকে তাহলে প্রথমেই একটা বিরূপ ধারণা চলে আসে। যেমন, ফার্নিচারের দোকানগুলোতে দেখা যায় ফার্নিচার শব্দটিই একেক দোকানে লেখা আছে একেক রকম। ‘মদিনা ফার্নিসারস’, ‘প্যারামাইন্ট ফার্নিশার্স’, ‘হোম ফার্নিশার্স’ বানানে লেখা হয়েছে শব্দটি। অটোমোবাইলসের সাইন বোর্ডে লেখা আছে ‘এহানে মুবিল, গিরিজ, পিট্রোল’ (এখানে মবিল, গ্রিজ, পেট্রোল) পাওয়া যায়। ‘রহমান অটোমোবাইলসের’ জায়গায় লেখা আছে ‘রয়মান অটোমোবাইল’, গ্রিজকে লেখা আছে ‘গিরিজ’, অকটেনকে লেখা আছে ‘অটেন’। মোবাইলের দোকানের সাইন বোর্ডে দেখা যায়, ‘কলিম ইন্টারপ্রাইজ’- তাতে আরো লেখা ‘এখান থেকে ফিলিক্স লোড, এজি লোড করা হয়। মোবাইল টু মবেল ২ টাকা। বিকাষ করা হয়।’ বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপনেও ভুল লেখা চোখে পড়ে। যেমন, ‘এখানে ঘোর ভারা দেয়া হবে। পানি, গস সুবিধাসহ।’ ছাত্রাবাসগুলোর সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘মেছ ভাড়া দেয়া হবে।’ যারা এসব বাংলা লেখে তাদের কেবল বর্ণমালা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে কাজ করতে হয়। বানান নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। তবে যারা লিখে নিচ্ছেন তাদেরও রয়েছে বানানে অদক্ষতা। অর্থাৎ অসচেতন মানুষের কারণে বাংলা ভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেবল সোশ্যাল মিডিয়া নয় খ্রিস্টীয় বছরের প্রথম দিনে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া বিনামূল্যের বই নিয়ে ২০১৭ সালে ছিল তুমুল বিতর্ক। ছিল কবিতার বিকৃতি আর বানান ভুলের ছড়াছড়ি। এমনকি মুদ্রণের মান ও অলংকরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল তখন। প্রথম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে অক্ষরজ্ঞান সূচিতে পাঠ ১২-তে ‘ও’ অক্ষর চেনানোর উপকরণ হিসেবে ‘ওড়না’কে ব্যবহার করা হয়েছিল। ‘শুনি ও বলি’ পাঠে ‘ও’ অক্ষর চেনাতে ওড়না পরা এক কন্যাশিশুর ছবি দিয়ে লেখা হয়েছিল- ‘ওড়না চাই’। প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ের লেখা ও ছবিতে ‘ছাগল গাছে উঠে আম খাচ্ছে’ বোঝাতে চেয়েছিলেন লেখক। বাংলা পাঠ্যবইটির ১১ পাতায় অতে অজ (ছাগল) বোঝাতে গিয়ে ছাগলের ছবি জুড়ে দেয়া হয়। সংশোধন করা না হলে ছাগলের গাছে উঠে আম খাওয়ার মতো অসম্ভব বিষয় শিখতে হতো শিশুদের। তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি বিকৃত করা হয়েছিল। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’ না লিখে লেখা হয়েছিল ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে?’ এ ছাড়া ‘মানুষ হইতে হবে- এই তার পণ’ না লিখে ‘মানুষ হতেই হবে- এই তার পণ’ লেখা হয়। ‘হাতে প্রাণে খাট সবে শক্তি কর দান’ এই লাইনে ‘খাট’ শব্দটির বানান বদলে দিয়ে লেখা হয়েছিল ‘খাটো’। এ ছাড়া চতুর্থ শ্রেণীর ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বইয়ের ৭৮ পাতায় ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ’ লেখায় মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি কখনো ‘মুক্তিযুদ্ধ’ আবার কখনও ‘মুকতিযুদ্ধ’। ‘বঙ্গবন্ধু’ বানানটি ভেঙে ঙ-গ আলাদা আলাদা করে লেখা হয়। যা হোক, এসব সমস্যা সমাধান করা হয়েছিল অতি দ্রুত। কিন্তু ভুলে ভরা বাংলা ভাষার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়। আমরা মনে করি, পাঠ্যপুস্তকে কোন ধরনের ভুল গ্রহণযোগ্য নয়। শিশুদের কাছে উপস্থাপিত কবিতা বা লেখার কোন ভুল বা বিকৃতি ভবিষ্যতেও পরিহার করতে হবে। আসলে বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটছে সর্বত্রই। এফএম রেডিওতে বাংলা ভাষাকে ইংরেজী স্টাইলে উচ্চারণ করা হচ্ছে। ভুলে ভরা বানানে প্রতিবাদলিপি প্রেরিত হয়েছে দৈনিক পত্রিকায়; কয়েক বছর আগে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নে ভুল দেখা গেছে। তখন বিজ্ঞান পরীক্ষায় ছিল ব্যাকরণগত ভুল। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের এক ফেস্টুনের ছবিতে দেখা গেছে বানান ভুলের ছড়াছড়ি। শিক্ষা, মেরুদন্ড এমন সাধারণ বানানেও ভুল হতে দেখা গেছে সেখানে। পাওয়া গেছে ভুলে ভরা উত্তরপত্র মূল্যায়ন নির্দেশিকাও। আওয়ামী লীগ সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে নির্দেশনা মোতাবেক অধিকাংশ সরকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে নিজস্ব ওয়েবসাইট। কিন্তু এসব ওয়েবসাইটে রয়েছে অনেক ভুল। ওয়েবসাইটগুলো মানছে না বাংলা একাডেমির প্রমিত ‘বাংলা বানান রীতি’। জাতীয় সংসদের নিজস্ব ওয়েবসাইটের বাংলা সংস্করণে ইংরেজী শব্দের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার দেখা গেছে। অথচ এসব শব্দের বাংলা অর্থ রয়েছে। আবার এসব শব্দের ব্যবহারের রয়েছে ভুল। ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, ট্যাবগুলোর মধ্যে রয়েছে হোম, লাইব্রেরি। অথচ চাইলেই হোমের পরিবর্তে ‘প্রচ্ছদ’ আর লাইব্রেরির পরিবর্তে ‘গ্রন্থাগার’ শব্দটি ব্যবহার করা যেত। এসব প্রমাণ করে বাংলা শব্দ ব্যবহারে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। মূলত ভুলে ভরা বাংলা ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করার জন্য প্রথমে দরকার সচেতনতা; প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করা এবং ইংরেজী শব্দের গ্রহণযোগ্য বাংলা পরিভাষা ব্যবহার আবশ্যক; উপরন্তু বিদেশি শব্দের যথার্থ পরিভাষা তৈরি এবং সেগুলোর বানানরীতি স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া প্রযুক্তির প্রসারের যুগে বাংলাকে ইন্টারনেটের এক্সপ্রেসওয়েতে আরোহণ করতে হবে। এ জন্য সরকারী উদ্যোগ ও জনগণের উদ্যম দুটোই জরুরী। লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×