ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর লোকজ মেলা

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাঙালীর লোকজ মেলা

মেলা- নামই বলে দেয় উৎসবের সুবাস। বাঙালীর লোকজ ধারায় মাটির গন্ধের আবহ ফুটে তোলে এই মেলা। বাংলা ভাষায় মেলা শব্দটি অনেক বাক্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যেমন মিলনমেলা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কাব্যে সঙ্গীতে গল্প কবিতা উপন্যাসে মেলা শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন নানা ব্যঞ্জনায়। ‘ভাঙলো মিলনমেলা ভাঙলো...’ রবীন্দ্রনাথের এই গানের সুর মানুষে মানুষে মেলবন্ধন অটুট রেখেছে। মেলা এই মিলনকেই গেঁথে রেখেছে বহুকাল ধরে। বঙ্গীয় ব-দ্বীপে মেলার উৎপত্তি কবে কি ভাবে এসেছে তা নিয়ে আজও গবেষণা হয়। যুগে যুগে মেলার অনেক রকমফের ঘটেছে। তবে বাঙালীর জীবনে লোকজ সংস্কৃতির গভীরে গ্রামীণ মেলার আবহ আজও টিকে আছে এবং থাকবে অনন্তকাল। লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ মেলা। মেলাকে ঘিরেই মানুষের জীবন প্রবাহ আবর্তিত। মেলার সঙ্গে নদীরও একটা আত্মিক সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। অধিকাংশ মেলা বসে নদী তীরে কোন পাথারে। কোন বট-পাকুড়ের তলায়। দেশে দেশে মেলার ধরনটি আলাদা তবে আবহ একই। ষড়ঋতুর এই দেশে বাংলা মাস ও ঋতুর নামের মেলা জীবন ঘনিষ্ঠ। যেমন চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, বৈশাখী মেলা, পৌষ মেলা, বসন্ত মেলা, আষাঢ় মেলা, অগ্রহায়ণে নবান্ন মেলা। গ্রামীণ মেলা বাঙালীর হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যায়। নগরীর মেলা অনেকটাই কৃত্রিম। ষাটের দশকে দেশের শহরগুলোতে কৃষি শিল্প শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রদর্শনী হতো। ইংরেজীতে পরিচিতি ছিল ‘এক্সিবিশন’। গ্রামের লোক এই মেলার নাম দেয় ‘শখের মেলা’। দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর সত্তর দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত শহরগুলোতে এ ধরনের মেলা ছিল। পরবর্তী সময়ে এই ধরনের প্রদর্শনী পরিবর্তিত রূপ নেয় নানা নামে। মেলা এক ধরনের আনন্দ বিনোদনের সঙ্গে বাণিজ্য। বর্তমানে বাণিজ্যের লক্ষ্য নিয়ে মেলার নামকরণ হয় বাণিজ্য মেলা, রফতানি মেলা, তাঁত মেলা, বস্ত্রমেলাসহ বিভিন্ন পণ্যের, ব্র্যান্ডের ও প্রতিষ্ঠানের নামে মেলা শব্দটি চালু হয়। যে ধারা নগরীর মেলা ও গ্রামীণ মেলাকে পৃথক করে দেয়। বাঙালী সংস্কৃতির লোকজ ধারার আদি ভূখ- এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপ। যা প-িতগণ বহুভাবে তুলে ধরেছেন। প্রাচীন পুঁথি থেকে জানা যায়, বহুকাল আগে মেলার গোড়াপত্তন ভাটি অঞ্চলে। কয়েকটি কাব্যে জানা যায় ময়মনসিংহের ভাটি এলাকা ও বগুড়ার শিবগঞ্জের গাঙনগরে একটা সময় বড় মেলার আয়োজন করা হতো। প্রাচীন পু-্রবর্ধন ভুক্তির রাজধানী প-্রনগর মহাস্থানগড়ে (বগুড়া) প্রমত্তা করতোয়া নদী হয়ে যে সওদাগরি বড় বজরা নৌকা ভিড়ত তার সংযোগ ছিল বারানসি বিলে। করতোয়ার এই তীরে প্রতিবছর মেলার আয়োজন হতো নানা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে। পৌরাণিক উপাখ্যান থেকে জানা যায়, চাঁদ সওদাগর বেহুলা লখিন্দরের বিয়ের অনুষ্ঠান সাজিয়েছিলেন মেলা বসিয়ে। চাঁদমহুয়া গ্রামে বসেছিল সেই মেলা। বগুড়ার এই গ্রামের নাম অপভ্রংশ হয়ে উচ্চারিত হয় চাঁদমুহা। বগুড়া অঞ্চলে যে কয়টি মেলা হয় তার প্রত্যেকটির সঙ্গে একটি করে গল্প রচিত হয়ে আছে বহুকাল ধরে। গাজী পীর আর কালু পীরের কাহিনী নিয়ে বগুড়ার শেরপুরের কেল্লাপোশি নামের দুই গ্রামের মধ্যবর্তী বিশাল পাথারে প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসে বসে কেল্লাপোশির মেলা। এই মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে কালু গাজী চম্পাবতীর প্রণয় কাহিনী। বগুড়ার ঐতিহ্যের এক মেলার নাম- পোড়াদহের মেলা। গাবতলীর মহিষাবান গাড়িদহ নদীর তীরে ছিল জোড়া বটবৃক্ষ। সন্ন্যাসী এসে এই বৃক্ষতলে যোগাসনে বসে ধ্যান করতেন। তারপর শুরু হয় মেলা। প্রতিবছর মাঘের শেষ মঙ্গলবার পোড়াদহের মেলা বসে। গোপীনাথপুরের মেলার সঙ্গে মিশে আছে ঋষীদের গল্প। মহাস্থানগড়ে বাউলদের মেলা বসে চৈত্র শেষে। উল্লেখ আছে ইংরেজ রিরোধী আন্দোলনে ফকির মজনু শাহ এই অঞ্চলে কিছুদিন ছিলেন। ফকিররা এক যুদ্ধে ইংরেজদের পরাভূত করার পর মেলার গোড়াপত্তন করেন। এমনিভাবে বারানসির মেলা, দাঁড়িয়ালের মেলা, খারুয়ার মেলাসহ ৪০টিরও বেশি মেলার গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বগুড়া। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবছর যত মেলা বসে তার সংখ্যা অন্তত ৬শ’। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পুণ্য স্নানকে কেন্দ্র করে মেলা বসে বিভিন্ন স্থানে। গ্রামীণ মেলাকে ঘিরে যাত্রা-সার্কাস-লোকজ সংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠানসহ নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। বাংলা মাসের শুরু বৈশাখ আসে মেলাকে সঙ্গে নিয়ে। বৈশাখী মেলা বাংলার চিরন্তন লোকজ রূপ। যে মেলার ধারাবহিকতার স্রোতধারায় একে একে আসে বাঙালীর মেলাগুলো। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×