ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা

চকবাজার ট্র্যাজেডি ॥ মসজিদে মসজিদে কান্নার রোল

প্রকাশিত: ১০:১৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 চকবাজার ট্র্যাজেডি ॥ মসজিদে মসজিদে কান্নার রোল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চুড়িহাট্টার মানুষের অশ্রু হয়ত কোন দিন ফুরাবে না। এদের বুকজুড়ে এত কান্না ছিল কে জানত! আগুনের লেলিহান শিখা কেড়ে নিল অসংখ্য প্রাণ, কেড়ে নিল কত স্বপ্ন। ধ্বংসস্তূপের সামনে চুড়িহাট্টা মসজিদে দুপুরে জুমার নামাজের মোনাজাতে অঝোরে কেঁদেছেন সাধারণ মানুষ। চিৎকার করে বুকফাটা আর্তনাদে জ্বলে পুড়ে যাওয়ার বিলাপ। তাই তো সৃষ্টিকর্তার করুণা প্রাপ্তির জন্য দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে মসজিদে মসজিদে ছিল কান্নার রোল। দোয়া শেষে চোখ মুছতে মুছতে মসজিদ ছেড়েছেন আগত মুসল্লিরা। রাজধানীর চকবাজারে চুড়িহাট্টা মোড়ের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে মৃতদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনায় শুক্রবার দেশের মসজদিগুলোতে বিশেষ দোয়া ওমোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। চেনা জানা না থাকলেও পুড়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য সবার কষ্টই যেন সমান। জুমার নামাজের পর সৃষ্টিকর্তার কাছে দুহাত বাড়িয়ে কেঁদেছেন সবাই। ছোট্ট শিশু থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ সবাই চেয়েছেন নিহতের আত্মার শান্তি। একই সঙ্গে এই অগ্নিকান্ডে যারা এখনও যন্ত্রণায় হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন তাদের দ্রুত আরোগ্য হওয়ার দোয়াও করা হয়। অন্যান্য মসজিদের চেয়ে মুসল্লিদের কান্নাটা আরও বেশিই মনে হয়েছেচুড়িহাট্টা শাহী মসজিদে। কেননা অনেকের নিত্য দিনের সাথী কিংবা প্রতিবেশী আর নেই। হয়ত গত জুমায় পাশে বসে নামাজ আদায় করা মানুষটি এখন অন্তিম যাত্রার সারথি। এসব ভেবেই মসজিদের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে হু হু করে কাঁদে সবাই। এছাড়াও অগ্নিকান্ডে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনায় বঙ্গভবন জামে মসজিদ, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, ধানমন্ডি, জিগাতলা, কলাবাগান, ইস্কাটন, কাওরান বাজারসহ দেশের মসজিদগুলোতে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত হয়েছে বলে জানা গেছে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, শুক্রবার জুমার নামাজের পর ওই বিশেষ মোনাজাতে চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করা হয়। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এই মোনাজাতে অংশ নেন। দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন বঙ্গভবন জামে মসজিদের মোয়াজ্জেম মাওলানা এনামুল হক। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ শেষে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মোনাজাত হয়। এতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনের ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনাসহ আহতদের দ্রুত আরোগ্য লাভের প্রার্থনা করা হয়। পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের শোক কাটিয়ে ওঠার জন্য মোনাজাত করা হয়। এ সময় দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নতি কামনা করে দোয়া করা হয়। পরে মসজিদের দক্ষিণ পাশে গায়েবানা জানাজায় অংশ নেন হাজারো মানুষ। গায়েবানা জানাজা পরিচালনা করেন মাওলানা আবদুল হালিম সিরাজী। গায়েবানা জানাজায় ও মোনাজাতে হাজারো মুসল্লির সঙ্গে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মোঃ আব্দুল্লাহ, ধর্মসচিব মোঃ আনিছুর রহমান অংশ নেন। এদিন পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার দৃশ্য ছিল বেদনাবিধুর। দুহাত তুলে বাচ্চা শিশুরা যখন মোনাজাতে হাত তুলে তখন গাল গড়িয়ে টল টল জল পড়ছিল। এছাড়াও মধ্য বয়সী থেকে বৃদ্ধ সবাই কেউ নিবৃত্তে কেউবা উচ্চস্বরেই কেঁদে ওঠেন। প্রতিদিনের চেনা জানা মুখগুলোই বারবার ভেসে উঠছিল মনের আয়নাতে। পুড়ে যাওয়া ভবনের ১৫ ফিট উত্তরে অবস্থিত চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদ। অসংখ্য মানুষ এখানে নামাজে অংশ নেন। জুমার নামাজের মোনাজাতে চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের ইমাম বলেন, ‘হে আল্লাহ যারা এ ঘটনায় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তাদেন জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। তাদের পরিবারকে শোক সহ্য করে ধৈর্য ধরার ক্ষমতা দান করুন।’ এছাড়াও যারা এখনও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তাদের সুস্থতার জন্যও দোয়া করেন মসজিদের ইমাম। এর আগে এই মসজিদে নামাজ শুরুর আগে সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপি হাজী সেলিম মুখপাত্রের মাধ্যমে এলাকাবাসীর উদ্দেশে বলেন, আমার আদেশ ও অনুরোধ, আপনারা কেউ নিজের বাসায় কেমিক্যালের গোডাউন ভাড়া দেবেন না। এছাড়াও অগ্নিকা-ে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনায় আজ শনিবার চুড়িহাট্টা জামে মসজিদে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। শুক্রবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সচিব মোস্তফা কামাল মজুমদার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। সবাইকে দোয়া মাহফিলে অংশ নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এদিকে, রাজধানীর ইস্কাটন জামে মসজিদে নামাজ শেষে মোনাজাতে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করা হয়। এ সময় অসংখ্য মুসল্লি কান্নাভেজা কণ্ঠে ‘আমিন’ ‘আমিন’ বলতে থাকেন। জিগাতলা গাবতলা মসজিদের ইমাম জুমার নামাজের পর মোনাজাতে সবাইকে চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে নিহতদের জন্য সবাইকে দোয়া করতে বলেন। মসজিদের ইমাম মোনাজাতে বলেন, ‘হে আল্লাহ যারা চকবাজার অগ্নিকান্ডের ঘটনায় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তাদের জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। তাদের পরিবারকে শোক সহ্য করে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করুন। আগুনের ঘটনায় যারা মারা গেছেন তাদের সকলকে শহীদের মর্যাদা দান করুন।’ এদিকে, অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়েও নিহতদের শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করা হয়। সকালে বিভিন্ন গীর্জা ও প্যাগোডায় নিহতদের শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করা হয়। এছাড়া, দুপুরে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। এর আগে, বৃহস্পতিবারই ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজপ্তিতে অগ্নিকান্ডে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শুক্রবার দেশের সব মসজিদে বাদ জুমা বিশেষ মোনাজাতের অনুরোধ করেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট শেখ মোঃ আব্দুল্লাহ। অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়েও দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ প্রার্থনার অনুরোধ জানান। প্রসঙ্গত, বুধবার রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ৬৪ নম্বর ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিটের প্রায় ২০০ কর্মী স্থানীয়দের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই ঘটনায় শুক্রবার সকাল পর্যন্ত মোট ৬৭ জন নিহত হয়েছে বলে জানায় ঢাকা জেলা প্রশাসন। আহত ও দগ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪১ জন। তাদের মধ্যে দুজনকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র আইসিইউতে রাখা হয়েছে। বাকিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। অগ্নিকান্ডের কারণ উদ্ঘাটনসহ দুর্ঘটনার সার্বিক বিষয় তদন্তের জন্য সুরক্ষাসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অগ্নি অনুবিভাগ) প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদান করতে বলা হয়েছে। এছাড়া দোষীদের চিহ্নিত করতে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। এছাড়াও শিল্প মন্ত্রণালয় ১২ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
×