ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

ই-তথ্য ও কর্ম সংস্থানের সুযোগ

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ই-তথ্য ও কর্ম সংস্থানের সুযোগ

আমরা জানি যে, কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আমাদের আনুষাঙ্গিক তথ্যের দরকার হয়। পূর্বাপর তথ্যের বিশ্লেষণ ছাড়া সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন। গবেষণা কাজে তথ্যের সঙ্গে উপাত্তের (ডেটা) দরকার হয়। এই দুইয়ের সমন্বয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল সিদ্ধান্ত নেয়াও সহজ হয়ে উঠে- যা যুগে যুগে পরীক্ষিত হয়েছে। প্রাচীন যুগের যুদ্ধ থেকে শুরু করে আধুনিক কালের শস্য উৎপাদন এমন কোন উন্নয়ন খাত নেই যেখানে তথ্য ও উপাত্ত সমন্বিত ভূমিকা রাখেনি। আধুনিক যুগে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম উপযোগিতায় তথ্য সরাসরি ভূমিকা রাখছে ও অনিবার্য ই-সেবায় পরিণত হয়েছে। এক সময় মনীষীগণ চিন্তা করলেন শব্দের অর্থ দিয়ে কেমন করে জ্ঞান পিপাসুদের সহায়তা করা যায়, যার ফলে অভিধানের জন্ম হলো। কালে কালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শব্দের বুৎপত্তি ইতিহাস, সমার্থক শব্দের বানান ও প্রতিরূপ নিয়ে আলোচনা, এমনকি এর ব্যাকরণের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে অন্য ভাষার অর্থ ও উচ্চারণ প্রক্রিয়া। বাংলা অভিধান ইংরেজীর অনুরূপে বর্ণানুক্রমে তৈরি হলেও বর্ণনা ও ব্যাখ্যায় এর পরিধি ব্যাপক। এই যে শুধু ভাষার শব্দ তথ্য সেটাও এখন ঠাঁই নিয়েছে প্রযুক্তিতে, আজকাল ভাষা অভিধানের সব তথ্য পাওয়া যায় ইন্টারনেটে, যে কেউ মুহূর্তে যে কোন শব্দের অর্থ বা বুৎপত্তি যাচাই করে নিতে পারেন। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা রকমের তথ্যও এখন তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে ইন্টারনেট জগতে সহজলভ্য হয়েছে। উন্মুক্ত জ্ঞান আহরণের অধিকারে অনেক তথ্যই উন্মুক্ত। কিছু কিছু তথ্য এখনও উন্মুক্ত হয়নি তবে রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয়গুলো ছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত কিনে নিতে হয় যেমন গবেষণার তথ্য, ফল বা কোন কোন উপাত্ত যেগুলো জড়ো করতে অনেক খরচ হয়েছে বা এমন কোন তথ্য যেগুলো বাণিজ্যিক কাজের জন্য উপযোগী বা সে রকম কোন কাজে ব্যবহার করা হবে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের জন্য একটি সম্ভাবনাময় আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে, যদি কেউ এ রকম কোন শ্রেণীবদ্ধ তথ্যভা-ার তৈরি করে যার বিক্রি মূল্য আছে। ইতোমধ্যে ই-সেবা শব্দটি আমাদের দেশে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেছে। পল্লী তথ্য সেবা এখন ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রের রূপ নিয়েছে, যা এক সময় বেসরকারী উদ্যোগে ডি-নেট নামের একটি সংস্থার পল্লী তথ্য সেবা নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে মডেল তৈরি হয়েছিল। আমি নিজেও ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে রামপালে জ্ঞান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তথ্য ভা-ার তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে প্রায়োগিক গবেষণা করেছিলাম যার ফলে সুইস সরকার ও মাইক্রোসফটসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান পরবর্তী সময়ে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছিল। ২০০১ সালের পটপরিবর্তনের পর সে প্রকল্প কিছুটা হোঁচট খেলেও গত আট বছরের ব্যাপক প্রচেষ্টায় বর্তমানে ‘আমাদের গ্রাম’ রামপাল জ্ঞান কেন্দ্রের কর্মীদের হাতে ২৪টি গ্রামের জিপিএস লোকেশনসহ সকল বাড়ি ও সকল অধিবাসীর জনমিতিক ও স্বাস্থ্য পরিধির একটি পরিপূর্ণ তথ্য ভাণ্ডার তৈরি হয়েছে যা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য তথ্য ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে উন্মুক্ত। ডিজিটাল বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার হলো তথ্যপ্রযুক্তির উদ্ভাবনী কাজের স্বীকৃতি দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দেয়া যার ফল বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক হয়েছে। আমার ধারণা, ই-তথ্য সেবা একটি সর্বোচ্চ মানের কাজ হতে পারে বিশেষ করে যদি সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগের সহায়তা থাকে। গ্রামে গ্রামে যে কেউ নিজের উদ্যোগে একটি তথ্যভা-ার তৈরি করতে পারে যদি সরকারের নানা বিভাগ বা পরিসংখ্যান বিভাগ সে তথ্যগুলো ব্যবহার করে বা স্থানীয় তথ্যভা-ারকে একটি সেবা পরিধির আওতায় এনে নিয়ম বেঁধে দিতে পরামর্শ দেয়। যেমন ধরুন, গ্রামের কোন একজন তরুণ তাঁর গ্রামের সব হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর তথ্যভাণ্ডার তৈরি করে ফেলল। এ কাজে সে একটি নির্দিষ্ট মোবাইল ফোনের এ্যাপ ব্যবহার করল যাতে করে সে যে বাড়ির তথ্য নেয়া শেষ করল সঙ্গে সঙ্গে ওই বাড়ি থেকেই লোকেশনসহ সব তথ্য-উপাত্ত নির্ধারিত সার্ভারে পাঠিয়ে দিল। আমার অভিজ্ঞতা বলে এই কাজে বাংলাদেশের একটি গ্রামের এ জাতীয় তথ্য নিতে একজন কর্মীর সর্বোচ্চ সময় লাগবে এক মাস। তথ্য নেয়া শেষ হলে সরকার বা যে কেউ যিনি এই তথ্যভা-ার দেখার অধিকার পাবেন তিনি দেখতে পাবেন একটি গ্রামে কতগুলো হাঁস, মুরগি, কবুতর, গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি আছে। জানা যাবে এক মাসে বা সপ্তাহে বা দিনে গড়ে ওই গ্রামে কতগুলো ডিম সংগৃহীত হয়, কত লিটার দুধ আহরিত হয় তার কি পরিমাণ বাজারে যায় বা যায় না। সে সবের কী পরিমাণ ঘরে ভোগ করা হয় আর এর ফলে একজন পুষ্টিবিদ জেনে নিতে পারবেন এর প্রভাব কোন নির্ধারিত বাড়িতে কি রকম পড়ছে। যারা বাজারে সওদা করবেন বা বাজার নিয়ে পরিকল্পনা করবেন তারাও জানবেন সঠিকপথে তাদের চিন্তা এগুচ্ছে কীনা। সরকারের কোন কর্তাব্যক্তি বা পরিকল্পক বা কোন শিক্ষার্থী গবেষক যদি সব গ্রামের এই তথ্যগুলো এক সঙ্গে দেখতে চান তা হলে খুব সহজেই ইন্টারনেট থেকে সেগুলো লোকেশন ম্যাপসহ পাওয়া সম্ভব। এর জন্য শুধু ওই গ্রামের উদ্যোক্তাকে একটি খরচ দিতে হবে। বা চাইলে সরকার তাকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে নিয়োজিত করতে পারেন শুধু এই কাজের জন্য। তাকে সব রকমের বুদ্ধি পরামর্শ দেবেন ওই উপজেলার পশুপালন কর্মকর্তা। ফলে একসময় দেখা যাবে সব উপজেলার এই কর্মকর্তা একটি বিশাল দক্ষ তরুণ কর্মী বাহিনী তার কাজের জন্য পেয়ে যাবেন যারা ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। এ রকম কাজের উদাহরণ তৈরি করা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে সম্ভব। আর যদি বিষয়বস্তু অনুযায়ী গ্রামের তরুণ কর্মীদের ভাগ করে কাজ করে নিতে বলা হয় তাহলে দেখা যাবে শুধু হাঁস-মুরগি বা গবাদিপশুর নয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিবরণসহ ধর্মীয় উপাসনালয়ের তথ্য, গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের তথ্য, সংবাদপত্র পাঠকের তথ্য এমনকি ফলের বা বনজ গাছের তথ্য, গাছপালা, পুকুর, মৎস্য চাষ, বাজার, দোকানপাট কী-না সম্ভব? এখন আমাদের দেশে যেসব জরিপ হয় সেগুলো সাধারণত নমুনা নিয়ে হয়। যদিও পরিসংখ্যান বিজ্ঞানে এই পদ্ধতি স্বতঃসিদ্ধ কারণ খরচ ও সময় বাঁচাতে বহু যুগ ধরে নমুনা সংগ্রহের দিকে নজর দিতে হয়েছে বেশি। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের জন্য এখন অবারিত নমুনা নিয়ে কাজ করার সুযোগ এনে দিয়েছে যার ফলে ভিত্তিমূলে ই-তথ্য গড়ে তুলে সেখান থেকে প্রয়োজন আনুযায়ী নমুনা নিয়েও কাজ করা সম্ভব। যে কারণে শুরুতে অভিধানের কথা বলেছিলাম, শুধু শব্দের অর্থ ও বুৎপত্তি বিক্রি করে একসময় যে জ্ঞান বিতরণের সংস্কৃতি চালু ছিল এখন তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে তা ই-সেবা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। একটি শব্দের যেরকম অর্থ এখন সহজে গুগল বা কোন সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজলেই পাওয়া যায় সে রকম আমাদের দেশের উন্নয়নমুখী আর্থ-সামাজিক জগতের কোন তথ্যের সমন্বিত উপাত্ত খুঁজে পাওয়াও মোটেই কঠিন হবে না- যদি তা যথাযথভাবে সংরক্ষণের বাস্তবমুখী পরিকল্পনা করে নেয়া যায়। আমাদের ভাবতে হবে কেমন করে ই-তথ্য সেবা কাজ আমাদের দেশের তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য সহায়ক হতে পারে। এখন যে ডিজিটাল তথ্য সেবার কেন্দ্রগুলো চালু আছে সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বা আমলে নিয়ে আমরা খুব সহজেই এর পরের ধাপে স্থানীয় পর্যায়ে পরিসংখ্যানের ক্লাউডভিত্তিক ই-তথ্য সেবা চালু করতে পারি, এ জন্য সরকার একটা সহায়ক নীতিমালা তৈরি করে দিলেই হবে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×