ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

বইমেলা ও আমাদের অর্থনীতি

প্রকাশিত: ১২:১৪, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বইমেলা ও আমাদের অর্থনীতি

অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। বাংলাদেশে হাজারো মেলার মাঝে বইমেলার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটছে মূলত এ মেলাকে কেন্দ্র করে। বাঙালীর ভাষা, সংস্কৃতি বোধ ও ঐতিহ্য হলো অমর একুশে বইমেলার ভিত্তি। লেখক, পাঠক এবং প্রকাশকদের কাছে অমর একুশে বইমেলা এক সেরা উৎসব। সবারই মিলনমেলা বাংলা একাডেমির বইমেলা। এদেশের সকল শ্রেণীর পাঠক সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে কখন বসবে অমর একুশে বইমেলা কবে বসবে বাঙালীর মিলনমেলা। ভাষা আন্দোলন, বাংলা একাডেমি আর একুশের বইমেলা একই সূত্রে গাথা। একুশের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ফসল বাংলা একাডেমি। একুশে বইমেলা বিকশিত হয়েছে বাংলা একাডেমিকে কেন্দ্র করে। নবগঠিত বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক জাগরণের প্রথম প্রকাশ ‘অমর একুশে বইমেলা’। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলার আয়োজন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের গৌরবের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতেই বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে বইমেলা’। বইমেলার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। এ ইতিহাসের সঙ্গে যে নামটি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে তিনি চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকতা থেকে আনা ৩২টি বই দিয়ে বইমেলার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা এ বইগুলো প্রকাশিত হয়েছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে যার বর্তমান নাম মুক্তধারা প্রকাশনী। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বইমেলা চলে এভাবেই। চিত্তরঞ্জন সাহার প্রচেষ্টায় এ মেলা বিকশিত হতে থাকে ক্রমাগত। ১৯৭৬ সালে বইমেলার প্রতি উৎসাহিত হন অন্য প্রকাশকরা। বইমেলার পরিধি বাড়তে থাকে। পরবর্তী বছরে বিক্রেতার সংখ্যা বেড়ে যায়। ১৯৭৮ সালে বইমেলা একটি পূর্ণাঙ্গ মেলায় রূপান্তরিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে। তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিক বাংলা একাডেমিকে বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার ঘোষণা প্রদান করেন। তখন থেকেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বাঙালীর এ প্রাণের মেলা শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। মন আর মননে প্রাণের মেলা হলেও অমর একুশে গ্রন্থমেলার বাণিজ্যিক দিকটা চমকে দেয়ার মতোই। দেশের অর্থনীতিতে সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ এ খাতের অবদান যে কিছুটা রয়েছে তা উপেক্ষিতই থেকে যায় অনেকের কাছে। নিন্দুকেরা বলেন, ইন্টারনেটের যুগে কাগজের বইয়ের কদর কমে গেছে। তাই বই আর কেউ পড়ে না। প্রকাশকরা কোনরকমে টিকিয়ে রেখেছে এ খাতটি। তবে আশাবাদীরা বলছেন, বই বিক্রি দিন দিনই বেড়ে চলেছে। তরুণদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা কমে যায়নি। বিশেষ করে অমর একুশে গ্রন্থমেলার মতো প্রাণের মেলা তরুণদের বইপ্রেমীকে উসকে দেয় প্রতিবছরই। অমর একুশে গ্রন্থমেলার বাণিজ্যিক দিকটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বইমেলার অর্থনীতি নানাভাবে, বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত। পরিবহন শ্রমিক, মুটেরা দেখে বাড়তি টাকার মুখ। অন্যদিকে এ সময়ে বিজ্ঞাপনের ব্যবসাও থাকে রমরমা। দৈনিক পত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বইমেলাকেন্দ্রিক বুলেটিনে ছাপা হয় কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন। এ বিজ্ঞাপন লেখক-প্রকাশক উভয়পক্ষই দিয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্টরা চান, বইয়ের খবর সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বিজ্ঞাপন প্রচার ও প্রকাশ দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোই পরবর্তীকালে চলে যায় পুরনো বইয়ের দোকানে। ঢাকার পল্টন, মিরপুর, নীলক্ষেত এলাকায় পুরনো বইয়ের ব্যবসা সরগরম থাকে সারা বছরই। তাছাড়া প্রতিবছরই বই বিক্রি বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বই বিক্রি থেকে প্রাপ্ত আয়ও। দুই বছর আগেও মেলায় টার্গেট ধরা হয়েছিল ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার মতো। আর এখন টার্গেট ধরা হচ্ছে প্রায় শত কোটি টাকা। ২০১৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরুর আগে ৩৫ কোটি টাকার বই বিক্রির টার্গেট ধরা হলেও শেষ পর্যন্ত বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০ কোটি টাকা। এ কারণে পরের বছর ২০১৬ সালে ৫ কোটি টাকা যোগ করে টার্গেট ধরা হয়েছিল ৪৫ কোটি টাকা। তবে অবিশ্বাস্যভাবে মেলা শেষে দেখা যায় টার্গেটের দ্বিগুণ অর্থাৎ ৮০ কোটি টাকার ওপরে বই বিক্রি হয়েছে। এরপর ২০১৭ সালের টার্গেট ধরা হয়েছিল ৬০ কোটি টাকার মতো। তবে এ ক্ষেত্রেও টার্গেট অতিক্রম করে বিক্রি হয় ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার বই। গত বছর ২০১৮ সালে বই বিক্রি হয় ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার । এই বছরে মেলা শুরুর প্রথম ৬ দিনে শুধু বাংলা একাডেমির ২৫ লাখ ৩১ হাজার টাকার বই বিক্রি হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় প্রথম ৬ দিনের চেয়ে সাত লাখ টাকা বেশি। প্রথম ছয়দিনে ৬৭১টি বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে গল্প ১০৭টি, উপন্যাস ১২২টি, প্রবন্ধ ৪৫টি, কবিতা ১৬১টি, গবেষণা ১২টি, ছড়া ২৩টি, শিশুতোষ ১৬টি, জীবনী ১৯টি, রচনাবলী ৪টি, মুক্তিযুদ্ধ ২৭টি, নাটক ৮টি, বিজ্ঞান ১৩টি, ভ্রমণ ১৫টি, ইতিহাস ১৩টি, রাজনীতি ৫টি, স্বাস্থ্য বিষয়ক ৫টি, রম্য/ধাঁধা ৬টি, ধর্মীয় ১টি, অনুবাদ ৩টি, সায়েন্স ফিকশন ১১টি এবং অন্যান্য ৫৫টি।
×