ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

ভাষা আন্দোলনের হক সাহেব ও শেখ সাহেব ॥ দুই॥

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ভাষা আন্দোলনের হক সাহেব ও শেখ সাহেব ॥ দুই॥

(গত বুধবারের পর) হক সাহেব ও শেখ সাহেবের রাজনীতির মধ্যে প্রচুর মিল। এটা ভাষাপ্রীতির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে হক সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতা এবং শেখ সাহেবের একাত্মতা একে সফল করার ব্যাপারে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। বাংলার মানুষের দুর্ভাগ্য এই যে, তাদের দু’জন প্রভাবশালী নেতা এবং পাকিস্তান হওয়ার পর বাঙালী পরিচয়ের দু’জন প্রধানমন্ত্রীই বাংলা জানতেন না। একজন খাজা নাজিমুদ্দীন এবং অন্যজন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ঢাকার নবাব পরিবারের উর্দুভাষী নাজিমুদ্দীন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে ছিলেন অসম্মত। বরং জিন্নার ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করে ঢাকায় বলেন, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজেও বাংলা ভাষা ভালভাবে না জানা এবং উর্দু ভাষী পরিবারের সন্তান হওয়ায় বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রতি প্রথমদিকে সহানুভূতিশীল ছিলেন না। ভাষা আন্দোলনে প্রথমে সমর্থনও দেননি। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে গুলি হওয়ার পর শহীদ সোহরাওয়ার্দী গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দেন। কিন্তু ভাষার দাবি সম্পর্কে কোন বক্তব্য দেননি। এ জন্য আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশ তার ওপর অখুশি ছিলেন। ১৯৫৩ সালে একুশের ভাষা শহীদ দিবস পালনের সময় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে পরামর্শ করে শেখ সাহেব করাচীতে চলে যান। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর রীতিমতো প্রভাব খাটিয়ে তার কাছ থেকে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে বিবৃতি আদায় করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুখের ওপর কথা বলার লোক আওয়ামী লীগে কেউ ছিলেন না। ছিলেন একমাত্র শেখ মুজিব। তাকে সমর্থন জানাতেন মওলানা ভাসানী। আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক করা, পাকিস্তানে যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তন ইত্যাদি ঐতিহাসিক কাজে শহীদ সোহওরাওয়ার্দীর প্রথমে সমর্থন ছিল না। কিন্তু মওলানা ভাসানী শেখ মুজিব ও মানিক মিয়ার (ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) চাপে তিনি মত পরিবর্তন করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী গণতন্ত্রমনা নেতা ছিলেন। শেখ মুজিবকে (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হয়নি। দেশের মানুষের কাছে শেখ সাহেব নামে অধিক পরিচিতি) অসম্ভব ভালবাসতেন। মওলানা ভাসানী ও মানিক মিয়ার যুক্তি শুনে এবং শেখ সাহেবের চাপে শহীদ সাবেক আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক করা ও পাকিস্তানে যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তনের দাবির সবচাইতে শক্তিশালী প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। শেখ সাহেব যদিও পরিচিত ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক শিষ্য হিসেবে। কিন্তু আমার ধারণা, তার রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে উঠেছিল হক সাহেব, আবুল হাশেম, সুভাষ বসু ও মওলানা ভাসানীর রাজনীতির প্রভাব বলয়ে। হক সাহেবের প্রথম রাজনীতিই ছিল অসাম্প্রদায়িক। তিনি প্রথমে মুসলিম লীগে যোগ না দিয়ে কৃষক প্রজা পার্টি নামে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগকে নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটান। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও বাংলাদেশ (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) থেকে মুসলিম লীগের নাম নিশানা উচ্ছেদ হয়। তাতেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হক সাহেব ও ভাসানী। সঙ্গে শেখ সাহেব। শেষ সাহেব তার নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক ঐক্য মোর্চার নাম দিয়েছিলেন কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে ছাত্রনেতা হিসেবে কলকাতায় ‘সাপ্তাহিক মিল্লাত’ পত্রিকার অফিসে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সভায় শেখ সাহেব দাবি তোলেন গোটা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। ঢাকায় জিন্নার ভাষা সংক্রান্ত বিতর্কিত বক্তব্যের পর তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা নইমদীন আহমদ এবং কয়েকজন সহপাঠী মিলে যে প্রতিবাদ জানান তাতে জোরালো সমর্থন দেন শেখ সাহেব। তমদুন মজলিসের নেতা অধ্যাপক আবুল কাশেম যখন তার দলের মুখপাত্রের নাম বাংলা ভাষায় ‘সৈনিক’ রেখে বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন তখন শেখ সাহেব তাতে জোর সমর্থন দেন। ১৯৫১ সালের শেষের দিকে ঢাকায় ১৯ নম্বর আজিমপুরে অধ্যাপক কাশেম ভাষা সম্পর্কে এক আলোচনাসভা ডাকেন, তাতে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। শেখ সাহেবও এসেছিলেন। খুলনায় বাঁশদহ থেকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী। আমি এবং সাংবাদিক বন্ধু এবিএম মুসাও এই সভায় ছিলাম। এই সভায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন এবং বলেন, ‘ইসলামী ভাষা নাম দিয়ে যদি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে হয়, তাহলে আসল ইসলামী ভাষা আরবিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা সমীচীন।’ তার বক্তব্য শুনে শেখ সাহেব বলেন, স্যার, অতীতে বাংলা ভাষাতেই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। আলাওল, পরাগল খান বাংলা ভাষাতেই কবিতা লিখেছেন। বাঙালী মুসলমানও এ ভাষাতেই কথা বলে। আপনারা দোয়া করুন, আমরা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করে ছাড়বোই।’ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি তুলে মুসলিম লীগের নেতাদের দ্বারা তিরস্কৃত হন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তাকে ‘ভারত ও হিন্দুদের দালাল’ বলে গালি দেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কড়া জবাব দেয়ার জন্য শেখ সাহেব পুরান ঢাকার ওল্ড মোগলটুলিতে এক সভা ডাকেন। ছাত্রলীগের তরফ থেকে লিয়াকত আলীর বক্তব্যের এবং ধীরেন দত্তের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের বাঙালী নেতাদের অশোভন মন্তব্যের নিন্দা জানিয়ে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন। এই ইশতেহারে মাস্তুলে ‘বাংলার প্রাচীন কবির কবিতার দুটি বিখ্যাত লাইন ছাপা হয়েছিল : ‘যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন’ জানি।’ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ভাষা আন্দোলনের শুরু। এই আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে শেখ সাহেব জড়িত ছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন, কখনও কখনও গ্রেফতার হয়েছেন। একুশে ফেব্রুয়ারির দুপুরে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দলের ছাত্ররা ভাষার দাবিতে সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা সমীচীন হবে কিনা এই বিতর্কে লিপ্ত, তখন জেল থেকে পাঠানো ছোট্ট চিরকুটে লেখা নির্দেশেই ছাত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেয়। শুরু হয় বায়ান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন। এক বামপন্থী লেখক, যার রয়েছে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অন্ধ মুজিব-বিদ্বেষ, তিনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে এই আন্দোলনে শেখ সাহেবের অবদান ও নেতৃত্ব একেবারে মুছে ফেলতে চেয়েছেন। যেমন পরবর্তীকালে বিএনপি ও ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা চেয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে স্বাধীনতার স্থপতির নাম মুছে ফেলতে। তা হয়নি। এই বামপন্থী লেখকসহ স্বাধীনতার শত্রুরা আজ আবার নতুন করে পরাজিত। কিন্তু শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু ও বিশ্ববন্ধু এই নতুন নামে ইতিহাসের পাতায় নতুনভাবে উঠে এসেছেন। তিনি ভাষাভিত্তিক স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বাংলা গান সোনার বাংলাকে জাতীয় সঙ্গীত করেছেন। জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘আমার পরিচয় বাঙালি, আমার দেশ বাংলা, আমার ভাষা বাংলা। জীবনে এবং মরণেও আমি বাঙালি।’ এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার পরও যারা তার দেশপ্রেম ও ভাষাপ্রেম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায়, ‘তাহারা কাহার জন্য নির্ণয় ন’ জানি।’ হক সাহেব ও শেখ সাহেব- এ দুটি নাম বাংলার ইতিহাসের দুটি অনির্বাণ তারা। এই নক্ষত্রের দ্যুতি মলিন করা কোন অর্বাচীনের পক্ষে সম্ভব কি? (সমাপ্ত) লন্ডন, ২৬ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১৯।
×