ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিজের শহরে রাঁচী বিমানবন্দরে ঘরের ছেলে ধোনিকে নিয়ে উন্মাদনা সমর্থকদের

প্রকাশিত: ০১:০২, ৭ মার্চ ২০১৯

নিজের শহরে রাঁচী বিমানবন্দরে ঘরের ছেলে ধোনিকে নিয়ে উন্মাদনা সমর্থকদের

অনলাইন ডেস্ক ॥ ঝাড়খণ্ড ক্রিকেট সংস্থার স্টেডিয়ামের ঠিক আগে বাঁ দিকে দেখা যাবে সেই মাঠ। স্থানীয়দের কাছে যা ‘জাস্টিস গ্রাউন্ড’ বলে পরিচিত। রাঁচীর একমাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে ৫০ গজ দূরত্বে দাঁড়িয়ে। বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল স্থানীয় কোনও অনুষ্ঠানের জন্য প্যান্ডেল করা হয়েছে। পাশাপাশি চারটি নেট প্র্যাক্টিসের জায়গা। সামান্য এগিয়ে ফাঁকা জায়গায় চলছে টেনিস বলের ক্রিকেট। দশ-বারো জনের তরুণের ব্যাট-বলের লড়াই দেখতে দেখতে পিছিয়ে যাওয়া যাক পঁচিশ বছর। কল্পনা করে নিন লম্বা চুলের এক নায়ককে। ভেসে উঠবে কোনও এক মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মুখ। এ মাঠে এ ভাবেই টেনিস বলে খেলতে খেলতে যে উত্থান তাঁর! মাহি-মায়ায় এই সব জায়গাগুলো আরও আলোকিত দেখাচ্ছে কারণ, ধরে নেওয়া হচ্ছে এটাই ঘরের মাঠে তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। বিশ্বকাপ খেলে যে ধোনি ভারতের জার্সি তুলে রাখতে চলেছেন, ক্রমশ সেই সম্ভাবনা জোরাল হচ্ছে। আর তা যদি হয়, আগামী শুক্রবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তৃতীয় এক দিনের ম্যাচ দেশের জার্সিতে রাঁচীতে বিদায় মঞ্চ হয়ে থাকছে। ‘ফেয়ারওয়েল মাহি’ বাজনা আরও জোরাল হয়েছে বুধবার রাঁচীতে আসার পরেই গোটা দলকে ধোনি তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করায়। কোচ রবি শাস্ত্রী থেকে শুরু করে অধিনায়ক বিরাট কোহলি, দলের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক সদস্য ধোনির নতুন বিশাল ফার্ম হাউসে গেলেন। এমনিতে রাঁচীতে এলে আগেও তাঁর বাড়িতে গিয়েছেন কোহালিরা। কিন্তু এ বারের রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে, ‘ফেয়ারওয়েল পার্টি’। কোহলিরা রাঁচী পৌঁছনোর কাছাকাছি সময়ে ‘জাস্টিস গ্রাউন্ড’-এ ধোনির সঙ্গে টেনিস বলে খেলা দুই বন্ধুকে পাওয়া গেল। এক জন মোহাম্মদ আনিস। ‘ক্যাপ্টেন কুল’-এর সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল দু’টোই খেলেছেন। আনিস চমকে ওঠার মতো ব্যাখ্যা দিলেন, ‘‘মাহিকে যে ফিনিশার বলা হয়, সেটা কিন্তু টেনিস বল থেকেই শুরু হয়েছে। আমরা অনেক দেখেছি ফিনিশারের জাদু। কত ম্যাচ যে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়ে মেরে জিতিয়ে দিয়েছে মাহি, বলে শেষ করা । যাবে না!’’ এখানেই শেষ নয়। আনিস বলে দিচ্ছেন, ক্রিকেট না খেললে তাঁর বন্ধু বড় ফুটবলারও হতে পারতেন। ‘‘লোকে জানে মাহি গোলকিপার ছিল। অনেকে জানে না, গোলকিপিংয়ের পাশাপাশি মিডফিল্ডেও দারুণ খেলতে পারত,’’ বলে আনিস উদাহরণ দিলেন, ‘‘অনেক ম্যাচে মিডফিল্ডে খেলে গোল করার পরে শেষের দিকে গোলকিপারের জায়গায় গিয়ে গোল বাঁচিয়েছে।’’ ধোনির ‘গেম রিডিং’ দক্ষতা ক্রিকেট ভক্তরা এখন দেখতে পান। আনিস তা দেখেছেন লম্বা চুলের যুবকের মধ্যে ফুটবল খেলতে খেলতে। তাঁর মুখে শোনা গেল দারুণ সেই ঘটনা, ‘‘আমি আর মাহি মিডফিল্ডে খেলতাম। এক বার ম্যাচের শেষের দিকে এসে বলেছিল, গোলকিপিংয়ে চলে যাই। আমি বারণ করলাম। বললাম, ঠিক গোল হয়ে যাবে। মাহি বার বার বলতে থাকল, নহী আনিস ভাই গোল নহী হোগা। তবু আমি ওকে গোলকিপারের জায়গায় ফিরতে দিলাম না। শেষ পর্যন্ত গোল হল না, আমরাও হেরে গেলাম। মাহির মস্তিষ্ক ব্যবহার নিয়ে যখনই মানুষের উচ্ছ্বাস দেখি, ওই ঘটনাটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।’’ সম্ভবত ফুটবল খেলতে খেলতেই জন্ম নেওয়া শুরু ‘ক্যাপ্টেন কুল’-এর। এ মাঠেই হেলিকপ্টার শটে হাতেখড়ি ধোনির। তাঁদের টেনিস দলের নাম ছিল ‘আলফাতে’। এমনকি, টেনিস বলের প্রতিযোগিতায় খেলতে ভিন রাজ্যেও সফর করতেন তাঁরা। সেই দলেই খেলতেন সন্তোষ লাল। পরে রঞ্জিও খেলেছেন। তিনিই হেলিকপ্টার শটের আসল আবিষ্কর্তা। টেনিস বলে ইয়র্কারের সামনে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকব কেন? প্রায়ই ধোনিদের বলতেন সন্তোষ। এর পরে নিজে মাথা থেকে বের করেন পায়ের কাছ থেকে বল উড়িয়ে দেওয়ার সেই অভিনব শট। সন্তোষের দেখাদেখি ধোনিও এই শট অনুশীলন করা শুরু করেন। তবে তাঁর টেনিস বলের সতীর্থরা অবাক হয়ে যান যে, কী ভাবে ধোনি এই শট ডিউস বলেও আয়ত্বে এনে ফেললেন! আনিস বলছিলেন, ‘‘টেনিস বলে ও ভাবে ব্যাট ঘুরিয়ে শটটা খেলা যায়। কিন্তু আমরা কেউ ভাবতে পারিনি, মাহি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এটা খেলে দেবে!’’ মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে পেটের মারাত্মক অসুখে মারা যান সন্তোষ। তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন ধোনি। বারবার সেখান থেকে খোঁজ নিতে থাকেন। ‘জাস্টিস গ্রাউন্ড’-এ দাঁড়িয়ে ধোনির ক্রিকেট বা ফুটবল কাহিনিই শুধু যে পাওয়া গেল, এমন নয়। তাঁর আর এক বন্ধু সেখানে হাজির। গৌরব নাম। কিন্তু পান্না নামে সকলে চেনে। রাঁচী বিধানসভায় কাজ করেন। পুরনো একটি কালো ইয়ামাহা মোটরবাইকে চড়ে এলেন পান্না। এবং, এসেই ঘোষণা করে দিলেন, ‘‘এটাই মাহির সেই প্রথম মোটরবাইক। ২০০৩-এ কিনেছিল। সেকেন্ড হ্যান্ড ছিল। তার পর আমি কিনে নিলাম ওর থেকে ২০০৪-এ।’’ কালো মোটরবাইক হস্তান্তরের মধ্যেও রয়েছে মজাদার গল্প। পান্নার সঙ্গে ধোনির রফা হয়েছিল, কুড়ি হাজার টাকায় তিনি মোটরবাইকটি কিনবেন। তার মধ্যে পনেরো হাজার টাকা প্রথমে দিয়ে দিতে হবে। বাকি পাঁচ হাজার দেবেন পরে। কথা মতো পান্না মোটরবাইক নেওয়ার সময়েই ধোনিকে পনেরো হাজার টাকা দিয়ে দিলেন। এর পরই ভারত ‘এ’ দলে সুযোগ পেয়ে কেনিয়া সফরে গেলেন ধোনি। ফিরে এসে পান্নার থেকে বকেয়া পাঁচ হাজার বুঝে নেওয়ার কথা। কিন্তু কেনিয়া থেকে ফিরে মাহি বন্ধুকে বলে দিলেন, ‘‘আমি ভারতীয় এ দলে সুযোগ পেয়ে গিয়েছি। ওখান থেকে তো টাকা পাবই। তোমাকে আর বাকি পাঁচ হাজার দিতে হবে না।’’ ধোনির কালো মোটরবাইকের এখনকার মালিকের মুখে সেই গল্প শুনতে শুনতে মনে হবে, ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা সেরা রূপকথা শুনছি। রাঁচীর রাস্তায় মোটরবাইক নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে যিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উড়ান ধরলেন। এবং মেঘে ঢাকা আকাশ পেরিয়ে শুধুই আরও উঁচুতে উড়তে থাকলেন। গলি থেকে রাজপথের এমন থ্রিলার আর কি লেখা হয়েছে কোনও খেলায়? এ বার হয়তো ল্যান্ডিংয়ের সময়। ৮ মার্চ, ২০১৯— সম্ভবত শেষ বার নীল জার্সিতে প্রিয় নায়ককে দেখতে পাবে তাঁর শহর। ভক্তরা চাইবেন, শেষ বারের মতো তরঙ্গ তৈরি করুক সেই স্লোগান— মাহি মার রহা হ্যায়! সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×