ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফারিহা হোসেন

অভিমত ॥ নিরাপদ খাদ্য-পানির নিশ্চয়তা জরুরী

প্রকাশিত: ০৯:১০, ১৩ মার্চ ২০১৯

অভিমত ॥ নিরাপদ খাদ্য-পানির নিশ্চয়তা জরুরী

মানুষের জীবনের জন্য পানি এবং খাদ্য অপরিহার্য। কিন্তু সব পানি যেমন পানের যোগ্য নয়, তেমনি সব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য সুখকর নয়। এক কথায় বলা যায় একমাত্র বিশুদ্ধ পানিই কেবল পানের যোগ্য। ঠিক তেমনি সব খাদ্য স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। শুধু স্বাস্থ্যসম্মত, নিরাপদ খাদ্যই জীবনকে বাঁচাতে, রোগ মুক্ত রাখতে সক্ষম। তবুও বেঁচে থাকার জন্য আমাদের খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। তবে তা নিশ্চয় পুষ্টিকর, সুষম, ভেজাল মুক্ত এবং নিরাপদ হওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের খাবার ও পানি একজন মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিদিনের খাদ্যই যদি বিষাক্ত হয়, পানি দূষিত, পানের অযোগ্য হয় তাহলে ফল কি দাঁড়ায়? জীবনকে বাঁচাতে সহায়তার পরিবর্তে জীবনকে প্রতিমুহূর্তে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। অথচ আমাদের বাঙালীর প্রধান খাদ্য ভাত। এটি সত্য আমরা এখন চালসহ সব রকমের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই খাদ্য কতটুকু নিরাপদ, মানসম্মত, স্বাস্থ্যসম্মত এটা প্রশ্নাতীত নয়। বরং হলফ করে বলা যায়, আমরা প্রতিদিন যা খাচ্ছি তার নব্বই ভাগই অস্বাস্থ্যকর, অনিরাপদ, কিন্তু ভেজাল, অনিরাপদ খাদ্য, পানির পরিবর্তে বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারের নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত টহল কার্যক্রম অব্যাহত রাখলেও বাস্তবে এই কার্যক্রম প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পাশাপাশি এই কার্যক্রম শুধু রাজধানীতে নয়, দেশের অপরাপর বিভাগীয় জেলা এমনি কি উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃতি এবং সম্প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত পরিচালনা করা অপরিহার্য। একই সঙ্গে মাটি, পানি, ফসলকে বিষমুক্ত রাখার প্রযুক্তি, পন্থা, পদ্ধতিও উদ্ভাবন করা এবং এর সঠিক প্রয়োগ অপরিহার্য। ধান থেকে চাল, চাল থেকে ভাত হয়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে। নতুন নতুন ধান এসেছে। উচ্চ ফলনশীল এসব ধান দেশে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অধিক ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা যে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছি, তা কি কেউ ভেবে দেখেছি? ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির গবেষণায় যে তথ্য মিলেছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ। গবেষণার জন্য চালের যে- ২৩২টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, তার ১৩১টিতে মিলেছে বিভিন্ন মাত্রায় ক্রোমিয়াম। ১৩০টিতে পাওয়া গেছে ক্যাডমিয়াম ও সিসা। ৮৩টিতে মিলেছে আর্সেনিকের অস্তিত্ব। কী সাংঘাতিক! জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে- ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিক মানুষের শরীরে ঢুকলে তা বের হতে পারে না। সবকটিই দীর্ঘ মেয়াদে কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া ক্যান্সারসহ নানা ধরনের ক্রনিক রোগের বড় উৎস হচ্ছে এসব রাসায়নিক। এককথায় এগুলোর সব কটিই ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম। মানব শরীরে অতিরিক্ত ক্যাডমিয়াম জমা হলে মারাত্মক বিষক্রিয়ায় ক্যান্সার, হৃদরোগ ও কিডনি রোগ দেখা দিতে পারে। ইউরোপীয় কমিশনের নীতিমালা অনুসারে মানবদেহের জন্য ক্রোমিয়ামের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ১ পিপিএম। কিন্তু জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের গবেষণায় চালে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে ৩.৪১৪ পিপিএম পর্যন্ত। ক্যাডমিয়ামের সহনীয় মাত্রা ০.১ হলেও পাওয়া গেছে ৩.২৩৯৫ পর্যন্ত। সিসার সহনীয় মাত্রা ০.২ হলেও পাওয়া গেছে ১.৮৭ পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালে ক্যাডমিয়ামের প্রধান কারণ জমিতে নিম্নমানের টিএসপি সার প্রয়োগ এবং গার্মেন্ট, ওষুধ কারখানা, টেক্সটাইল ও ট্যানারির অপরিশোধিত বর্জ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের পরিণতি কমবেশি সবাইকেই ভোগ করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিশুরা সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। বিশেষ করে সঠিক মান রক্ষা করে এবং প্রয়োগবিধি না মেনে বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে একাধারে উৎপাদিত ফসল, মাছ, পানি ও জমি মারাত্মকভাবে বিষাক্ত হয়ে থাকে। এর যে কোন মাধ্যম থেকে মানুষের শরীরে সহজেই ঢুকে পড়ছে এই বিষাক্ত উপাদান। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফসল ও মাছে ভারি ধাতু ঢুকছে মূলত মাটি ও পানি থেকে। মাটি ও পানি এমনভাবেই রাসায়নিক দূষণের কবলে পড়েছে, যা খাদ্যচক্র হয়ে মানবদেহে ঢুকে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। নানা ধরনের জটিল রোগের ঝুঁকিতে ফেলছে মানুষকে। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের যে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, সে খাদ্যই যদি রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণ হয়। কাজেই আমাদের খাদ্য বিষমুক্ত করার সব ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। বিষাক্ত কীটনাশক ও সার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও শৃঙ্খলা আনতে হবে। বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপের কোন বিকল্প নেই। খাদ্যে ভেজাল, অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বাজারজাত, বিক্রি শত ভাগ বন্ধে প্রশাসন, পণ্যের উৎপাদনকারী, বিক্রেতা, মজুদকারী প্রভৃতিকে কঠোরভাবে শাস্তির আওতায় আনা জরুরী। একই সঙ্গে পানি দূষণকারী, দূষিত পানি বিক্রি, মজুদকারী, উৎপাদনকারীকে শাস্তির আওতায় আনা জরুরী। নতুবা ভেজাল, নিম্নমানের অনিরাপদ খাওয়ার খেয়ে, দূষিত পানি পান করে নানা রকম প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। যা বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, ভেজাল, পঁচাবাসি খাওয়ার এবং দূষিত পানি পান করে শিশু, নারী, বয়োবৃদ্ধসহ সকল শ্রেণীর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যান্সারসহ নানা মৃত্যুঘাতী রোগে। এই অবস্থা থেকে মানুষকে পরিত্রাণে এখনই প্রয়োজন সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা। নিরাপদ খাদ্য, পানীয় নিশ্চিত করা না গেলে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর আমাদের খাদ্য ভাবত যে অর্থ খরচ হবে তার চেয়ে ওষুধপথ্যে অর্থব্যয় বাড়বে অনেক বেশি। লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
×