ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ০৯:১১, ১৩ মার্চ ২০১৯

বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যত

বিএনপির ভবিষ্যত কি, এটা নিয়ে অনেকেই ভাবিত। বিএনপি সংসদীয় রাজনীতি বর্জন করে চলেছে। অন্যদিকে দেশের মানুষও বিএনপিকে বর্জনের নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে বিএনপির এখন না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থা দেখা দিয়েছে। বিএনপি সংসদে নেই, মাঠের রাজনীতিতেও নেই। তাদের আন্দোলনের কোন ইস্যু নেই। আবার কোন ইস্যু তৈরি করে আন্দোলনের ডাক দিলে তাতে সাড়া দেয়ারও কেউ নেই। বেগম খালেদা জিয়াকে একবার ক্যান্টনমেন্টের দখল করা বাড়ি থেকে আদালতের নির্দেশে বহিষ্কার এবং পরে তাকে দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দী করার সময়েও বিএনপি আন্দোলনের ডাক দিয়ে গাছের একটি ঝরা পাতাও নড়াতে পারেনি। ফলে দেশের এবং বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল, বাংলাদেশে বন্দুকের রাজনীতির দাপট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির দাপটও শেষ। ক্যান্টনমেন্টের উপর নির্ভরতা শেষ হলে জামায়াতের কাঁধে চড়ে সন্ত্রাসের রাজনীতিতে নির্ভর করে বিএনপি ক্ষমতায় রাজনীতিতে টিকতে চেয়েছিল তাদের সে কৌশলও ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির শুধু গ্রহণযোগ্যতা অর্জন নয়, দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হওয়ায় যে সুযোগ হয়েছিল, তার প্রধান কারণ, জিয়ার নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের পর বেগম খালেদা জিয়া নিজে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি না ছাড়লেও তার দলের রাজনীতিতে দৃশ্যত ক্যান্টনমেন্টের বাইরে অনেকটাই নিয়ে এসেছিলেন। এরশাদ হটাও আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিএনপির রাজনীতির একটা গণতন্ত্রায়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিলেন। দেশে গণতন্ত্র ফিরে এলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দ্বিদলীয় সংসদীয় রাজনীতির দুটি সুস্থ দল হয়ে উঠবে বলে অনেকেই আশা করছিলেন। সকলেই দেশে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকারের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী বিরোধী দল আশা করেছে। কখনও আওয়ামী লীগ, কখনও বিএনপি পরস্পরের সঙ্গে জনকল্যাণের উন্নত কর্মসূচী নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তাদের মধ্যে। নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাত বদল হবে এটাই দেশের মানুষ আশা করেছিল। তাদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্বে আসার পর দলটির ক্যান্টনমেন্টের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক চরিত্র অর্জনের যেটুকু আশা দেখা দিয়েছিল, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে টেনে-হিঁচড়ে জয়লাভ করে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সেই আশা সম্পূর্ণ নিভে যায়। দেখা গেল বিএনপি চরিত্র বদলায়নি। ক্ষমতায় বসেই মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে স্বাধীনতা ও তার মৌলিক আদর্শের শত্রু জামায়াতকে। আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ (ঙঢ়ঢ়ড়হবহঃ) হিসেবে গ্রহণ না করে গ্রহণ করেছে শত্রুপক্ষ (বহবসু) হিসেবে। তার যুদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর বিরুদ্ধে নয়, একেবারে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরুদ্ধে। পরাজিত পাকিস্তান ও তার সামরিক গোয়েন্দা চক্রের গোপন নির্দেশে তারা চালিত হচ্ছে। দেশের মানুষ ভেবেছে, তাদের কাক্সিক্ষত দ্বিতীয় বৃহত্তম বিকল্প গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হচ্ছে বিএনপি। একটি স্বার্থান্ধ, সুবিধাবাদী সুশীল সমাজ এবং নিরপেক্ষতার ভেকধারী একটি মিডিয়া গ্রুপ দেশের মানুষের মধ্যে এই বিভ্রান্তি আরও ভালভাবে ছড়িয়েছে। ফলে বিএনপি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ক্ষমতায় বসে তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সন্ত্রাস ও হত্যাকা- দ্বারা আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা এবং অন্যদিকে আওয়ামী বিরোধিতায় নামে মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন ও আদর্শ ধ্বংস করে দেয়া। ভারতেও এই ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীনতা লাভের পর কংগ্রেস একক বৃহত্তম দল হিসেবে ক্ষমতায় বসে। সম্ভাবনা ছিল হয় অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টি অথবা প্রজা সোস্যালিস্ট দল দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এবং হয়তো ক্ষমতাতেও যাবে। ৪২-এর আগস্ট মুভমেন্টের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও স্বাধীন ভারতের গোড়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ছিল অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টি, শক্তিশালী দল ছিল সাম্প্রদায়িক হিন্দু মহাসভাও। গান্ধী হত্যার পর ভারতে সাম্প্রদায়িক শক্তির অভ্যুত্থানের আশঙ্কা দেখা দেয়। শাসক কংগ্রেস দলেও বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নেহেরুর গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জোট বাঁধে। কমরেড জি সি যোশীর নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট পার্টি ভারতে অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তির অভ্যুত্থান ঠেকাতে নেহেরু সরকারকে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কম্যুনিস্ট পার্টির আরেকটি অংশ দাঁড়ায়। তারা আলাদা হয়ে গিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টি মার্কসিস্ট (সিপিএম) নামে কম্যুনিস্ট পার্টি গঠন করে। এই সিপিএম পরবর্তীকালে নেহরু কন্যা ইন্দিরাকে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের জন্য হিন্দু মহাসভার খোলস পাল্টানো দল ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গেও হাত মিলিয়ে ছিলেন। সিপিএম দিল্লীতে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। গেছে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। নেহেরু সরকারকে সমর্থনের প্রশ্নে কমরেড পিসি যোশী তাদের মুখপত্র ‘নিউ এজ’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘দেশের বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির এখন একমাত্র কর্তব্য সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ছদ্মবেশী এজেন্টদের ষড়যন্ত্র থেকে ভারতের গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য সর্বপ্রযতেœ নেহরুকে ক্ষমতায় রাখা। গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতা দখল ঠেকাতে আমি নেহরুর শাসন যদি দীর্ঘ একনায়কত্ববাদী হয় তাহলেও তা সমর্থন করি।’ নেহরু ও পরবর্তীকালে ইন্দিরাকে ক্ষমতা থেকে হটাতে গিয়ে এবং সাম্প্রতিককালে সোনিয়া-মনমোহন সিংয়ের কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে হটাতে গিয়ে সিপিএম এবং তাদের সহযোগী অন্য কয়েকটি বাম দল ভারতের দুটি রাজ্যে শোচনীয়ভাবে ক্ষমতা হারিয়েছে এবং দিল্লীর সিংহাসনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের নিরঙ্কুশ রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে। এখন তাদের চৈতন্য হয়েছে। ভারতে আজ গান্ধী-নেহরু গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা গভীর ভাবে বিপন্ন। বাংলাদেশেও ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার দানব শক্তি যতদিন সম্পূর্ণ ধ্বংস না হয়, ততদিন শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন। তার ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য বিএনপির মতো স্বাধীনতার আদর্শবিরোদী দল নয়, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বিরোধী দল দরকার। সেই বিরোধী দল যতদিন গড়ে না ওঠে, ততদিন হাসিনা সরকার তাদের ভুলত্রুটিসহ দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। কথায় বলে দুষ্ট গরুর চাইতে শূন্য গোয়াল ভাল। ড. কামাল হোসেনদের ফসিল নেতৃত্ব ব্যর্থ। নতুন প্রজন্মের নতুন আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির শক্তিশালী বিকল্প দল গড়ে তোলার জন্য তরুণ নেতৃত্বেরই এগিয়ে আসা উচিত। আওয়ামী লীগের উচিত হবে তার বিরোধিতা করা নয়, সহযোগিতা করা। নীতি ও নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন না ঘটলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির কোন ভবিষ্যত নেই। আগামীতে বিএনপি ভেঙ্গে নতুন দল হতে পারে। কিন্তু বিএনপির বিলুপ্তি অতীতের হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগের পথ ধরবে। গত সাধারণ নির্বাচনের আগে বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিপরীত শিবির থেকে ড. কামাল হোসেনকে দলীয় জোটের নেতৃত্বে এনে বিএনপি ভোল পাল্টে দেশের মানুষকে ধোঁকা দিতে চেয়েছিল। মানুষ সেই ধোঁকায় পড়েনি। ফলে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে কামাল হোসেন সাহেব মনের জ্বালায় রোজ আবোল-তাবোল বকছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিএনপি যদি বিলুপ্ত হয়ে যায়, আমি দুঃখিত হব না। তাতে দেশের কোন ক্ষতি হবে না। বরং দেশে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে ওঠার পথে বিএনপি যে বাধার দেয়াল খাড়া করে রেখেছে, তা যত শীঘ্র লুপ্ত হয় ততই ভাল। [লন্ডন, ১২ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১৯]
×