ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সামরিক কবরস্থানে বাবাকে সমাহিত করতে দেয়া হয়নি

প্রকাশিত: ১০:২৫, ১৪ মার্চ ২০১৯

 সামরিক কবরস্থানে বাবাকে সমাহিত করতে দেয়া হয়নি

আমার ছোটবেলা কেটেছে অন্ধকার যুগে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত আমরা স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে পারতাম না। কারণ, তখন দেশ শাসিত হতো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের সরকার দ্বারা। এখন যখন ছোট শিশুরা গেয়ে ওঠে- ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণি/বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ তখন আমার গর্বে বুকটা ভরে যায় এবং মনে হয় কত সৌভাগ্যবান এখনকার প্রজন্ম। আজ এই প্রজন্মের হাত ধরে বলতে পারি, ‘যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা/গৌরি, মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান।’ মহান স্বাধীনতার মাসে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদকে। লাখো মা-বোন যারা পাকিস্তানীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছিল তাদেরকে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতাসহ তাঁদের পরিবারের শাহাদাতবরণকারী সকলকে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতাকে, যাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ’৭৫-এর ৩ নবেম্বর। ’৭৫-এর ৭ নবেম্বর আমার বাবা শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদাসহ (বীর বিক্রম) মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম) ও কর্নেল এটিএম হায়দারকে (বীর উত্তম) নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাদের সবাইকে এই স্বাধীনতার মাসে স্মরণ করছি। আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। আজন্ম মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করি। আজ স্বাধীনতার মাসে আমি আমার বাবা শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা (বীর বিক্রম) সম্পর্কে কিছু বলব, যা তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানেন না। আমার বাবা ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে বাবা ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ২৭তম অভিযুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৪ মাস কারাগারে বন্দী ছিলেন। জেলবন্দী থাকাকালীন তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় এবং সামরিক আদালতে বিচার শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে ১ নম্বর অভিযুক্ত করে মামলা শুরু হলে এটি রাজনৈতিক মামলায় পরিণত হয়। ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটি এক ধ্বনিতে গেয়ে বঙ্গবন্ধু সকল অভিযুক্তকে নিয়ে প্রবেশ করতেন কোর্টরুমে। কোর্টরুমে বঙ্গবন্ধু সব অভিযুক্তের পরিবারকে আশ্বাস দিতেন যে, তারা সসম্মানে মুক্তি পাবেন। পরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুসহ সকলে সসম্মানে মুক্তি পান। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর আমার বাবা মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন ৮ নং সেক্টরের বয়রা সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। যুদ্ধে তার বীরত্বের জন্য তিনি ‘বীর বিক্রম’ খেতামে ভূষিত হন। ‘চির উন্নত মম শির’ এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে বাংলাদেশে একটি আধুনিক সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বাবাকে দায়িত্ব দেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধু কাছ থেকে দেখেছিলেন আগরতলা মামলার সময় একজন তরুণ ক্যাপ্টেন হিসেবে। যার মধ্যে ছিল অসম্ভব দেশপ্রেম ও অসীম সাহস। বাবা তার নিবেদিতপ্রাণ, আত্মবিশ্বাস, সততা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে কুমিল্লাতে প্রথম বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি ছিলেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ফার্স্ট কমান্ড্যান্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় তখন বাবার পোস্টিং ছিল রংপুরে। ৩ নবেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনীরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে। এর সূত্র ধরে ৭ নবেম্বর ১৯৭৫ সালে তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম), আমার বাবা কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা (বীর বিক্রম) ও কর্নেল এটিএম হায়দারকে (বীর উত্তম) হত্যা করা হয় আমাদের মহান সংসদের প্রাঙ্গণে। আমরা জানতাম না যে, বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা রংপুর থেকে ঢাকায় আসি ৯ নবেম্বর। আমার মা ফোন করে জিয়াউর রহমানকে অনুরোধ করেন বাবার লাশের জন্য। জিয়াউর রহমান বলেন, বাবার লাশ আমাদের নিজ দায়িত্বে¡ CMH থেকে নিতে হবে। মা শেষ অনুরোধ করেন জিয়াউর রহমানকে একটি জাতীয় পতাকা বাবার লাশের ওপরে দেয়ার জন্য; কিন্তু জিয়াউর রহমান সেটা দেননি। ১০ তারিখ আমার মামারা বাবার লাশ নিয়ে আসেন। বাবাকে দাফন করার জন্য সামরিক কবরস্থানে জায়গা চাওয়া হয়; কিন্তু তৎকালীন Station Commander Colonel Hamid এক কথায় বলেছিলেন, Colonel Huda does not deserve a grave in Army graveyard. কত বড় অন্যায় এবং অবিচার করা হয় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে। এরপর আর কোন উপায় না পেয়ে বাবাকে সমাহিত করা হয় বনানী কবরস্থানে। বাবা এত সৎ ছিলেন যে, আমাদের কাছে কবর কেনার ৫০০০ টাকা ছিল না। কবরটি শেষে আমার চাচা কিনে দেন। বনানী কবরস্থানে আমার বাবাকে সমাহিত করা হয় বঙ্গবন্ধু পরিবার ও জাতীয় চার নেতার সঙ্গে একই সারিতে। ছোটবেলা থেকে মা আমাদের শিখিয়েছেন এই তিন জায়গায় দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করার জন্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে জিয়াউর রহমান যত হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন তা গুণে শেষ করা যাবে না। জিয়াউর রহমানকে তুলনা করা যায় ইংরেজ সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত MACBETH উপন্যাসের একটি উক্তির সঙ্গে Heres the smell of blood still. All perfume of Arabia will not sweeten this little hand. যার বাংলা করলে দাঁড়ায় : তার হাতে এত রক্তের গন্ধ যে, আরবের সমস্ত সুগন্ধ হাতে দিলেও রক্তের গন্ধ যাবে না। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের জীবনে শুরু হয় সংগ্রাম। প্রতিটি দিন ছিল একেকটি যুদ্ধ। মা একই সঙ্গে আমাদের বাবা ও মা উভয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছোটবেলা থেকেই বাবার আদর্শে আমাদের বড় করেছেন। আমাদের শিখিয়েছেন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ধৈর্য ধারণ, নির্লোভ ও দেশকে ভালবাসতে। সন্ধ্যার পর যখনই গেটে গাড়ির হর্ন বাজত দৌড়ে বাইরে যেতাম বাবা আসবে বলে, আমাদের নিয়ে যাবে নিজেদের বাসায়। কিন্তু তখন এত ছোট ছিলাম যে, বুঝতে পারতাম না মানুষ মারা গেলে আর কখনও ফেরত আসে না। বাবার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম। বাবার জন্য প্রকাশ্যে প্রথম কেঁদে ফেলি বিয়ের দুইদিন আগে। সেদিন আমার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল বাবাকে। সেদিন তার অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি অনুভব করি। একটি মেয়ে স্বপ্ন দেখে তার নতুন জীবন শুরু করবে বাবার হাত ধরে; কিন্তু আমার ঘটনা ছিল ভিন্ন। এমন একটা সময় ছিল, আমি ও আমার ভাই স্কুলে যেতে পারতাম না। কোন স্কুল আমাদের ভর্তি করে নিত না। আমরা দুই বছর পড়াশোনা করতে পারিনি। অবশেষে সানবিমস্ স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস নিলুফার মঞ্জুর আমাকে তার স্কুলে ভর্তি করে নেন। বর্তমানে আমি সানবিমস্ স্কুলে ১৮ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। ৭ নবেম্বর আমাদের জন্য একটি দুঃখ ভারাক্রান্ত দিন। ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত দেখে এসেছিলাম একটি মহল এই দিনটি সরকারী ছুটি ও উৎসবের দিন হিসেবে পালন করে। অথচ দিনটি মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা দিবস। যে হত্যাকা-ে যুক্ত ছিল জিয়াউর রহমানের অনুসারীরা। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ তিনি ৭ নবেম্বরের ছুটি বাতিল করেছেন এবং আমাদের এই কষ্ট ও গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই। প্রধানমন্ত্রীকে আমি প্রথম দেখি ১৯৮১ সালের ১৭ মে মানিক মিয়া এভিনিউতে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন। আমার আজও মনে পড়ে প্রধানমন্ত্রী জনসমুদ্রের সামনে অঝোরে কেদেঁছিলেন। সেদিন শুধু প্রধানমন্ত্রী কাঁদেননি, কেঁদেছিল উপস্থিত প্রতিটি মানুষ। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন কাঁদছে বাংলার আকাশ ও বাংলার বাতাস। এরপর মায়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে যাই ৩২ নং বাসায় যেখানে তখনও নারকীয় হত্যাকান্ডের চিহ্ন ছিল। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সকলের জীবনে একটি অনুকরণীয়। যিনি শোককে শক্তিতে পরিণত করে আজ একজন মেধাবী ও শক্তিশালী নেত্রী হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে দিয়েছেন এক নতুন পরিচয়। বাবার একটি প্রিয় কবিতা ছিল জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিবো ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এ বাংলায়।’ বাবা তো আর ফিরে আসবেন না; কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমার বাবার সততা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমাকে একাদশ জাতীয় সংসদে সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। এই সেই মহান সংসদ যার প্রাঙ্গণে আমার বাবার রক্তমাখা দেহ পড়েছিল ’৭৫-এর ৭ নবেম্বর। আমি কৃতজ্ঞ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। [লেখাটি ৭ মার্চ ২০১৯, জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের বক্তব্যের ভিত্তিতে] লেখক : কর্নেল নামজুল হুদার (বীর বিক্রম) মেয়ে
×