ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লাকসামের বেলতলী

প্রকাশিত: ১০:২৬, ১৪ মার্চ ২০১৯

লাকসামের বেলতলী

গণহত্যা ও বধ্যভূমির ইতিহাস অনুসন্ধান শুধু অতীতের ঘটনা ও করুণ কাহিনী তুলে ধরাই নয় বরং মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের কথা স্মরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক ও সম্প্রীতির সমাজ গড়ে তোলার প্রয়াসও বটে। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তর সালে ঘটে যাওয়া অগণিত গণহত্যার প্রকাশিত প্রমাণচিত্রের একটি হচ্ছে ‘বেলতলী গণহত্যা’। বেলতলী একটি বৃহৎ বধ্যভূমি। যা কুমিল্লা জেলার সর্ব দক্ষিণের উপজেলা লাকসামে অবস্থিত। ডাকাতিয়া নদী বিধৌত, নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর স্মৃতি বিজড়িত একটি শহর লাকসাম। যেখানে সংঘটিত হয়েছিল হাসনাবাদ কৃষক বিদ্রোহ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই গুরুত্বের ব্যতিক্রম ঘটেনি। যুদ্ধকালীন সময়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে লালমাই-সোনাইমুড়ি সড়কের ওপর আধিপত্য বিস্তার এবং নদীবন্দর চাঁদপুরের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পাকিস্তান বাহিনীকে স্থলপথে লাকসামে অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়েছিল। পনের এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী লাকসাম দখল করে একে তাদের নিয়ন্ত্রিত অংশ হিসেবে বেছে নেয়। এরই সপ্তাহ তিনেক আগে, তেইশ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লাকসাম হাই স্কুল মাঠে বিপুল জনসমাগমের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছয় এপ্রিল আজগরা বাজারে পাকিস্তান বাহিনীর বোমারু বিমানের আক্রমণে আনুমানিক ছাব্বিশ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন। রক্তাক্ত আজগরা বাজার তখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। যার নেতৃত্বে ছিলেন আলতাফ আলী। পনেরো এপ্রিল পাকিস্তান আর্মি চূড়ান্তভাবে লাকসাম দখলের পর প্রধান সড়ক ও রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন বিহারি আব্দুল মান্নানের মালিকানাধীন চাঁদপুর টোব্যাকো কোম্পানিকে (থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরি) বেছে নেয় যুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে, যা ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ নামে পরিচিত ছিল। শুধু তাই নয়, ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ সুরক্ষায় কয়েক কিলোমিটার এলাকাব্যাপী খনন করা হয়েছিল পরিখা। এখান থেকেই বিভিন্ন স্থানে পাক-সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসরদের অধীনে খোলা হতো ছোট ছোট ক্যাম্প। ক্যাম্পগুলোর মধ্যে ছিল হরিকোটের ব্রিজ, নাথেরপেটুয়া বাজার, লাকসাম কলেজ, খিলাবাজার, হাসনাবাদ বাজার, পশ্চিমগাঁও দরগা এলাকা, মুদাফফরগঞ্জ বাজার প্রভৃতি। এই সকল ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল পাকিস্তান বাহিনীর শের আলী ও ক্যাপ্টেন গাদ্দার্জী। জেলার এগারো জন প্রধান যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে এই ব্যক্তি একজন, তার করা অপরাধের মধ্যে রয়েছে জাতিগত নিধন, গণহত্যা ও ধর্মান্তরিত করা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। বেলতলী গণহত্যা ছিল আর শত-সহস্র নির্যাতন গণহত্যার ন্যায় নির্মম ও হৃদয়বিদারক। অকথ্য নির্যাতন ও নিপীড়নের পর লাশগুলোকে মাটিচাপা দেয়া হতো এই বধ্যভূমিতে, মিনি ক্যান্টনমেন্টে ইলেকট্রিক শক দিয়ে লাশ নিয়ে আসা হতো এখানে মাটিচাপা দেয়ার জন্য, যাদের দিয়ে দিনের বেলা গর্ত খোঁড়ানো হত, তাদেরই রাতে ব্রাশ ফায়ার করে এই গর্তে ফেলা হতো। ট্রেন থেকে নারী যাত্রীদের নামিয়ে চাবুকের আঘাতে জর্জরিত করা হতো। তাদের মদ্যপানেও বাধ্য করা হতো, অকথ্য নির্যাতনের পর ফেলে রাখা হতো এই বধ্যভূমিতেই। কারখানা ভবনটির ভেতর ও বাইরে মোট একত্রিশটি বাঙ্কারে প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ মজুদ ছিল। একদিকে গণহত্যা-নির্যাতন, অপরদিকে এই কারখানা থেকে পুরো অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন ছিল পাকিস্তান বাহিনীর কাজ। বেলতলী গণহত্যার প্রধান ভূমিকায় ছিল পাকিস্তান বাহিনী। তাদের সহযোগী ছিল বিহারি সম্প্রদায়ের লোকজন, রেল কর্মচারী এবং স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তি। শহীদ আলী আশরাফ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন দৃঢ় সমর্থক, একাত্তরের-এর দশ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা হওয়ার অপরাধে তাকে লাকসাম থেকে ডেকে এনে রেলওয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর তার লাশ গরুর গাড়িতে করে সমগ্র লাকসামে প্রদর্শন করে পাকিস্তান বাহিনী এবং এই মর্মে ঘোষণা দেয় যে- মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার পরিণতি এই রূপ নির্মম মৃত্যুদন্ড। প্রত্যক্ষদর্শী বলরাম শীল একাত্তরে রেল-জংশনের একটি সেলুনে কাজ করতেন, হানাদারদের আক্রমণের পর তাকে সিগারেট ফ্যাক্টরিতে চুল কাটার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘খালেক সাহেব চা খাচ্ছিলেন, এমন সময় বাকাওয়ালী এসে খালেক সাহেবের হাত ধরে নিয়ে যেতে চায় সিগারেট ফ্যাক্টরির ভেতরে। আমি খালেক সাহেবকে নিষেধ করি সেখানে যাওয়ার জন্য। উনি বলেন, কিছু হবে না। বাকাওয়ালী সাহেব আমার বন্ধু মানুষ। তিনি গেলেন আর ফিরে এলেন না। ওদের হাত থেকে আমার বাবাও রেহাই পাননি। যখন আমার বাবার লাশ পাই, তখন তার সারা শরীরে ছিল বেয়নেটের ক্ষত চিহ্ন। বাবার শ্রাদ্ধ করতে পারিনি ভয়ে।’ বেলতলীর এমনি আরো অজানা ও নির্মম হত্যা সম্পর্কে জানতে পড়ুন ‘গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ থেকে প্রকাশিত গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘন্ট গ্রন্থমালার ‘বেলতলী গণহত্যা’ গ্রন্থটি। গ্রন্থটির লেখক মামুন সিদ্দিকী। লেখক : গবেষণা কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র
×