ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জীবন নেছার জীবন!

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ১৫ মার্চ ২০১৯

জীবন নেছার জীবন!

জীবনের ভার বহিবার শক্তি ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। সময় যত গড়ায়, বয়স যত বাড়ে ততই চারদিক হয়ে আসে ধূসর। দুবেলা দুমুঠো জোগাড় করাই হয়ে পড়ছে কষ্টসাধ্য। গৃহপরিচারিকার কাজে তবু জোটে খাদ্য, সেও নয় পর্যাপ্ত। কত কি খাবার সাধ জাগে। স্বাদ পেতে ইচ্ছে হয় ভাল খাবারের। উচ্ছিষ্টের খাবারই তাকে করতে হয় গলাধকরণ। অভাবিজনের ক্ষুধার্ত পেট যা পায়, তাই যেন গেলে গোগ্রাসে। ক্ষুণ্ণিবৃত্তি নিবারণে এখনও তাকে উদায়স্ত থাকতে হয় শ্রমে ও কর্মে। কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তি? সেও নৈবচ নৈবচ। হাত পাতার কথা ভাবতেও পারেন না এই বৃদ্ধ বয়সে। তাই কাজ করে যেতে হয়, খেতে হয় কাজের বিনিময়ে পাওয়া খাদ্য। হোক না তা টাটকা কিংবা বাসি। অত বাছবিচার করার মতো অবস্থাও নেই তার। জীবনের গান হয় না গাওয়া জীবন নেছার। যেদিকে তাকান দেখেন শুধু ধু ধু মরুভূমি, বালিয়াড়ি আর অনন্ত আসমান। উদার আকাশ আর বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেন কপালের লিখন বড়ই করুণ। কঠিন থেকে কঠিনতর সময় তাকে পাড়ি দিতে হয় প্রতিদিন। কেউ এসে দাঁড়ায় না পাশে। হাত ধরে দেখায় না পথ। বলে না উঠে এসো ধর হাত, দেখ বাঁচার রথ চলছে আপনগতিতে। কে দেবে তাকে বাঁচার আশা, অধিকার? ঘনঘোর অন্ধকারের ভেতর হাতড়ে বেড়ান বেঁচে থাকার উপকরণ। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়ন। চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের এক নম্বর মহল্লায় মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু আজও সরে যায়নি। কোনভাবে দিনাতিপাত করার এই আশ্রয়টুকু তার একান্ত সম্বল। বয়স দাঁড়িয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র বা আইডি সূত্রে ৭৮ বছর। আইডি নম্বর তার ৬৭১৬৮৫৫৮২৭৬৪২। এতেই প্রমাণিত হয় এদেশের সিনিয়র সিটিজেন তিনি। ১৫ বছর আগে ২০০৩ সালে হারিয়েছেন স্বামী আবদুল করিমকে। যে ছিল তার সকল ভরসা। স্বামীর রোজগার তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল নিশ্চিন্ত নির্ভর জীবনযাপনে। স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র পুত্রের হাল ধরার কথা। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য যে, পুত্রটি তার মানসিক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। আরও করুণ যে, সেই একমাত্র পুত্র আট বছর আগে হারিয়ে গেছে কোথায়, কেউ জানে না। খোঁজখবর বা সন্ধান করার সামর্থ্যও নেই তার। প্রতিবন্ধী পুত্রের জন্য গভীর শোক বুকে পুষে তবু জীবনের রথকে টেনে নিয়েছেন জীবন নেছা। পুত্রের কথা ভাবতে গেলেই হাহাকার আর শূন্যতা এসে ধরা দেয়। মানুষের বাড়িতে কাজের বিনিময়ে দুমুঠো খাবার খেয়ে বেঁচে আছেন। বয়সের ভারে আগের মতো কাজকর্ম করতে পারেন না। তাই জীবিকা নির্বাহ হয়ে পড়েছে কষ্টসাধ্য। শুনেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরুষদের ৬৫ আর নারীদের ৬২ বছর বয়স হলে বয়স্ক ভাতা দিয়ে আসছেন। বিধি অনুযায়ী তার বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা পাবার কথা। অথচ জনপ্রতিনিধিরাও তার প্রতি ভ্রƒক্ষেপহীন। তাদের ‘খুশি’ করতে সামর্থ্য না থাকায় ভাতাও মেলে না। রূপগঞ্জ উপজেলায় ১৫ হাজারের অধিক নারী ও পুরুষ বয়স্ক ভাতা পেলেও জীবন নেছার ভাগ্যে তা জুটছে না। বিধবা ভাতাও নয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মদদপুষ্ট, সমর্থক ও আত্মীয় না হলে বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার কার্ড দেয়া হয় না। তাদের কাছে যতবার গিয়েছেন ততবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। প্রশাসন সঠিকভাবে তদারকি করে না বলেই সারাদেশে অজস্র জীবন নেছা শেখ হাসিনা প্রদত্ত ভাতা থেকে রয়েছেন বঞ্চিত। ভাতাহীন, রোজগারহীন, সন্তানহীন জীবন নেছার জীবন প্রদীপ এখনও জ্বলছে। একদিন তা নিভে যাবে অনাহারে, অর্ধাহারে, অভাবের চাপে। এসবের কোন প্রতিকার আছে কিনা জানা নেই তার। জীবন নেছার জীবন থাক সচল, এই প্রত্যাশা।
×