ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সফিউল আযম

বই ॥ বানানভীতি রোধে প্রসঙ্গ ব্যবহারিক বাংলা

প্রকাশিত: ১২:১৪, ১৫ মার্চ ২০১৯

বই ॥ বানানভীতি রোধে প্রসঙ্গ ব্যবহারিক বাংলা

মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধার বস্তু। মাতৃভাষার ইতিহাসে বাঙালী যে সীমাহীন আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তা বিশ্বের ইতিহাসে সত্যিই অতুলনীয়। ভাষার জন্য এ রক্তক্ষরণ বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম চেতনার বহির্প্রকাশ। বাংলা ভাষার প্রতিটি শব্দই প্রাণের চেয়ে দামী। বাংলা বানান আতঙ্কের বিষয় নয়। প্রমিত বাংলা বানান চর্চার জন্য চাই কিছু সহজ নিয়ম বা কৌশল বা উদাহরণ। বিষয়গুলো অনুধাবন করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ২৭তম ব্যাচের সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষের এ্যাসাইনমেন্ট অফিসার মোঃ মোস্তফা রচনা করেছেন ‘প্রসঙ্গ ব্যবহারিক বাংলা’ বইটি। বইটির ভূমিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের বাংলা বিভাগের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন বলেন, বাংলা ভাষা ও বানানরীতি-বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক বেশকিছু বই দেশে প্রচলিত থাকলেও, এসব বইয়ের উপযোগিতা কখনও নিঃশেষ হওয়ার নয়। বাংলা বানানচর্চার পাশাপাশি ‘প্রসঙ্গ ব্যবহারিক বাংলা’য় বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পারিভাষিক শব্দ, শব্দার্থের প্রয়োগ বৈচিত্র্য যতিচিহ্ন ইত্যাদি। বইটিতে যতিচিহ্ন ব্যবহারের নিয়ম ও উদাহরণ এবং অ থেকে হ ধ্বনি পর্যন্ত প্রমিত যে শব্দাবলি সংকলিত হয়েছে তা থেকে সর্বস্তরের পাঠক উপকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। এ ধরনের শ্রমসাধ্য জটিল কাজে কোন কোন ক্ষেত্রে মতান্তরের উৎস থেকেই যায়, যা পাঠককে উদ্বুদ্ধ করে নতুনতর ভাষাচর্চায়। ইদানীং বাংলা বানানে /িই-কার ও ী/ঈ-কার নিয়ে ভীতি-বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এ ভীতি কিছুটা লাঘব করার জন্য /িই-কারের ৩১টি নিয়ম ও ী/ঈ-কারের ৪৪টি নিয়মের আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও ু/উ-কার ও ূ/ঊ-কার, স্ত/স্থ/স্তি/স্থি, ব্য/ব্যা, ত্য, ত্যা, ন্য ও ন্যা দিয়ে বানান; বিশেষ্য/বিশেষণ/ক্রিয়ার দ্বৈত প্রয়োগ; সমার্থক শব্দদ্বৈত; চন্দ্রবিন্দু/ডবল চন্দ্রবিন্দুর বানান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ রকম নিয়মমাফিক আলোচনা ও অজস্র উদাহরণ বইটিকে গবেষণামমূলক গ্রন্থে উন্নীত করেছে। সন্ধি; সন্ধির ক্ষেত্রে পরিহার্য; বিদেশি শব্দের নিয়ম; শ/স/ষ; জ/য; ড়/ঢ়/র ব্যবহারের নিয়ম-উদাহরণ আলোচিত হয়েছে যা পাঠকের সহজে বানানভীতি দূর করবে। ক্রিয়াপদ, ক্রিয়াবিশেষণ ও প্রযোজক ক্রিয়ার শেষে কেন ‘ে া/ও-কার’ বর্জনীয় তার সাবলীল যুক্তি ও উদাহরণ আলোচিত হয়েছে। সমাসের নিয়ম, অ থেকে হ পর্যন্ত সমাসবদ্ধপদের পূর্বপদের একটা তালিকা; বহুপদী সমাসবদ্ধপদ; বিশেষণ ও সমাসবদ্ধপদ; অসংলগ্ন সমাস নিয়ে অসংখ্য উদাহরণসহ আলোচনা করা হয়েছে যা পাঠককে সমাসবদ্ধপদ চিনতে ও লিখতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। একটি সার্থক বাক্যের গুণাবলি; সমাপিকা-অসমাপিকা ক্রিয়া; সমোচ্চারিত শব্দ; অকারণ লিঙ্গান্তর; পদাশ্রিত নির্দেশক; প্রত্যয়; পারিভাষিক শব্দ; দুইবার বহুবচন বা বচনবাহুল্য; পরোক্ষ উক্তিতে যে; ব্যাকরণিক শব্দশ্রেণি; বিশেষ্যপদ ও শ্রেণিবিভাগ; অব্যয় পদ ও শ্রেণিবিভাগ; ক্রিয়াপদ ও শ্রেণিবিভাগ; যোজক পদ ও শ্রেণিবিভাগ; আবেগশব্দ ও শ্রেণিবিভাগ; সর্বনাম পদ ও শ্রেণিবিভাগ; খুদেবার্তা ও বৈদ্যুতিন চিঠি; অনাপত্তিপত্র/অভিজ্ঞতা/চারিত্রিকসনদ; নোটিস/বিজ্ঞপ্তি/প্রেসবিজ্ঞপ্তির নমুনা; বিসর্গ/কোলনের পার্থক্য; উপসর্গ; অনুসর্গ; বিভক্তি; হসন্ত/ঊর্ধ্বকমা; রেফের পরে ব্যঞ্জনবর্ণ; বাক্যের পদবিন্যাস; বাঙালীর বারো মাসের নাম ও বারের নামের উচ্চারণ; ৎ যুক্ত শব্দ; শব্দের মধ্যে/শেষে বিসর্গ; অনুস্বারযুক্ত শব্দ; শব্দ গঠনের প্রক্রিয়া আলোচিত হয়েছে। এ বইয়ের ণত্ববিধান; ষত্ববিধানের নিয়ম নিয়ে এত বড় আলোচনা করা হয়েছে যা দুই বাংলাতে অদ্বিতীয় ও প্রশংসার দাবিদার। এতে বাংলা ফন্টের সাইজ; প্যারাইনডেন্ট; পঙ্ক্তি ভাঙার নিয়ম; বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম আলোচিত হয়েছে। অ থেকে হ পর্যন্ত (৭০ পৃষ্ঠায়) গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ২০,০০০ (বিশ হাজার) প্রমিত শব্দ সন্নিবেশিত হয়েছে যা যে-কোন পাঠকের কাছে সহজেই ব্যবহারিক বানান-অভিধানের মতোই নিত্যসঙ্গী হিসাবে কাজ করবে। ব্যবহারিক অথচ অনেক অভিধানের ভুক্তিতেই স্থান না পাওয়া শব্দাবলিও এতে সন্নিবেশিত হয়েছে যা বানানপিপাসু মনের চাহিদা পূরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এ বইয়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বাংলা শব্দার্থের প্রয়োগবৈচিত্র্য, যেমন, ২১/একুশ/একুশে; অংশগ্রহণ/অংশ গ্রহণ; অসামরিক/বেসামরিক/সামরিক; আঁতাত/আঁতাত; আকর্ষক/আকর্ষণীয়; আগামী/গত; আগামীতে/পরবর্তিতে; আদব/আদাব/নমস্কার/সালাম; আপোস/আপস; আমন্ত্রণ/নিমন্ত্রণ; আলোচনা/পর্যালোচনা/বিশ্লেষণ; আশংকা/সম্ভাবনা; আশ্রায়ণ/আশ্রয়ণ; আসলে/এলে; ঈদ/ইদ; ইত্যাদি সম্পর্কে রেফারেন্সসহ আলোচনা করা হয়েছে। প্রমিত বাংলার ব্যবহার জাতি হিসাবে গর্বের বিষয়। ‘প্রসঙ্গ ব্যবহারিক বাংলা’ বইটিতে প্রমিত বাংলা বানানের কিছু কৌশল আলোচিত হয়েছে। এতে বাংলা বানানের কিছু নিয়মের পাশাপাশি অসংখ্য উদাহরণ, যতিচিহ্ন প্রয়োগের নিয়ম-উদাহরণ, সমাস-প্রত্যয় চর্চার কিছু নিয়ম, সমাসবদ্ধপদের উদাহরণ, ণত্বষত্ববিধানের নিয়ম-উদাহরণ, গুরুত্বপূর্ণ কিছু পারিভাষিক শব্দ সন্নিবেশিত হয়েছে। অনেক সময় অভিধানের ভুক্তিতে মূলশব্দ ব্যতীত গুরুত্বপূর্ণ শব্দ পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে পাঠক দ্বিধাগ্রস্ত হন এবং ভুল বানান লিখেন যেমন, ‘আশ্রায়ণ’, ‘জারিকৃত’, ‘সংকরায়ন’। এ গ্রন্থে যথাসম্ভব সেসকল শব্দ নির্মাণের চেষ্টা ও ছোটবড় ৫০০টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটি মাধ্যমিক শ্রেণী থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী, বিসিএসসহ যে-কোন প্রতিযোগিতামূলক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার্থী, ভাষার প্রয়োগ/অপপ্রয়োগ সম্পর্কে সর্বস্তরের পাঠক এতে উপকৃত হবেন। এছাড়াও বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার বাংলা ভাষা অংশের প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ, বানানের নিয়ম, বানান ও বাক্য শুদ্ধি, পরিভাষা, শব্দ, শব্দগঠন, পদ, বাক্য, বাক্যগঠন, প্রত্যয়, সন্ধি, সমাস ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। ‘বইটিতে যতিচিহ্ন ব্যবহারের নিয়ম ও উদাহরণ এবং অ থেকে হ ধ্বনি পর্যন্ত প্রমিত যে শব্দাবলি সংকলিত হয়েছে তা থেকে সর্বস্তরের পাঠক উপকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস।’ উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর বাংলা দ্বিতীয় পত্রের ব্যাকরণ ও নির্মিতি অংশের প্রায় ৫০ নম্বর এবং ৫০০টি বিভ্রান্তিকর বিষয়কে উদাহরণ ও ব্যাখ্যাসহ আলোচনা করা হয়েছে যা যে কোন পাঠককে প্রমিত বাংলা বানান ব্যবহারে সহায়তা করবে বলে আমি মনে করি। দেশের ২৭ হাজার প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তার নোটলিখন, নথিকরণ, পত্রাদির খসড়া প্রণয়নে দাফতরিক কাজে বইটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ‘প্রসঙ্গ ব্যবহারিক বাংলা’ বইটির প্রথম খণ্ডে ৪৬৪ পৃষ্ঠায় ১ লাখ ৩১ হাজারেরও বেশি শব্দ স্থান পেয়েছে। বইটির দাম ৪৫০ টাকা। দ্বিতীয় খন্ডও এসেছে বইমেলায়। যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৯৬ এবং দাম ৩০০ টাকা। তবে পৃষ্ঠা সংখ্যা আরও বাড়িয়ে বর্ণানুক্রমিক ভুক্তির সাহায্যে বইটিকে পাঠকবান্ধব করা যেতে পারে। কাগজের মান আরও উন্নত করা যেতে পারে। বই দুইটি বাজারে এনেছে মাওলা ব্রাদার্স।
×