ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জ্ঞানেশ মন্ডল

গল্প ॥ জননী

প্রকাশিত: ১২:১৭, ১৫ মার্চ ২০১৯

গল্প ॥ জননী

যে সময় বুয়া ময়নার মা খবরটা বয়ে আনে, সেই থেকে শাহানার আর কোন কাজে মন বসে না। এমনিতে বৃষ্টির দিন। অলস সময়। শেষ রাতের কোন এক সময় থেকে মেঘের চোখে বৃষ্টির অঝর ধারা যেন দিন-রাত একাকার করে ঝরছে। এর মধ্যে ময়নার মা ভিজে-ভিজে বন্যার্তদের ক্যাম্পে গিয়েছিল। মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনি দেখতে। সেখানেই শুনে এসেছে প্রতিবন্ধী মনা পাগলির রগরগে গল্পটা। তারপর থেকে রূপ নগর সিনেমা চত্বর, মনা পাগলির নবজাতক দেখতে যাওয়া নিয়ে শাহানার চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। সেই সকাল থেকে একজোড়া কাক আঙ্গিনার সজনে গাছের ডালে বসে ভিজছে, কোথাও নিরাপদ আশ্রয় না পেয়ে। এভাবে বসে চোখের সামনে সকাল, দুপুর, বিকেল গড়ালে শাহানা নিশ্চিত হয়, তার আজ আর সময় মতো ঘরে ফেরা হবে না। নিশ্চয়ই বৃষ্টি বন্দী শাহেদ। শাহানা এরপর সময়ের সৎব্যবহারে উদ্দিপ্ত হয়ে ওঠে। মেঘলা সময়। রেইন ডে বলে কথা। শাশুড়ি মাহিমা বেগমও সেই দুপুর থেকে ঘুম নিমগ্ন। শুধু এই মাহেন্দ্রক্ষণ টুকুর জন্য শাহানার যত প্রতীক্ষা। আর বসে থাকতে পারে না শাহানা। বৃষ্টি মাথায় তখনই বেরিয়ে পড়ে। শহরজুড়ে বন্যার জল। প্রতিটি সড়ক কমবেশি জোয়ারের তা-বে ভাসছে। কোনটাতে নৌকা ভাসছে জলে। এই দুর্যোগের মধ্যে বৃষ্টি মাথায় মনা পাগলির নবজাতক কোলে শাহানা ঘরে ফেরে। তারপর সন্ধ্যা থেকে শুধু মানুষের ঢল। সারা রাত নির্ঘুম রাত জাগে শাহানা, তার সঙ্গে মাহিমা বেগম, ময়নার মা বলতে গেলে গোটা পরিবার। এ জন্য শাহানার প্রতি মাহিমা বেগম অসন্তুষ্ট। তার মাথার ওপর গুরুদায়িত্ব। এই অনাহূত পথশিশু ঘরে ফেরার পর থেকে শাহানার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে শতগুণ। মুহূর্তে সে যেন মা হয়ে উঠেছে। চারদিকে বন্যার হাজারো বিপন্ন মানুষ। তবু মানুষের কি করে এমন অহেতুক কৌতূহল হয়, ভাল লাগে না শাহানার। আরও কিছু লোক এ সময় বাইরের ফটক গলিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ফ্ল্যাট বাড়ি বলে কথা, প্রতি ফ্ল্যাটে লোকজন, শাহেদ তখনও বাড়ি ফেরেনি। পরে সে ফোনে জানিয়েছে, সাময়িক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় মাননীয় জেলা প্রশাসক শহরের গণ্যমান্যদের নিয়ে জরুরী বৈঠক বসেছে। বৈঠক শেষে ফিরতে রাত হবে। তারপর থেকে শাহানা একাই দু’হাতে সব সামলিয়েছে। শাহানার মিথ্যে বলার কিছু নেই। কারণ, এই অনাহূত পথশিশু, তার আগমন বার্তা নিজে থেকে জানিয়ে দিয়েছে-তার সুতীব্র চিৎকারে। সে বার্তা প্রতিহত করা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই বুক ফাটা আর্তনাদ এখনো বাতাসে সমান অনুরণিত। শাহানা শিশুটিকে কুড়িয়ে পেয়েছে মাত্র। জন্ম দাতা, নামধাম এসব জানা নেই। তবে মা যে তার মনা পাগলি। অল্প বয়স। চেহারায় যৌবনের মাদকতা। হঠাৎ একদিন বন্যার জলে কোথা থেকে ভেসে এলো। একেবারে অন্য চেহারা বৈচিত্র্য। এতদিনে যৌবন আর গর্ভরসে তাকে আরও খানিকটা উজ্জ্বল করেছে। এত প্রাকৃতিক দুর্যোগ তবুও হাজার মানুষের জিজ্ঞাসা, ‘পাগলির পেটে বাচ্চা এ কি করে সম্ভব? এই জন্যইতো দিন দুনিয়া নষ্ট হয়ে গেছে।’ বাইরে এখনো অবিশ্রান্ত বৃষ্টির আর্তনাদ। তবুও উৎসব মুখর পরিবেশ। প্রতিবেশীদের শত জিজ্ঞাসার মাঝেও বিরক্ত হয় না শাহানা। সে তার নিজের মতো করে সবই জবাব দিয়ে যায়। তবে বারবার একটি প্রশ্নই তাকে আক্রান্ত করে, পাগলির শিশু কন্যাটি কি ঈশ^র প্রদত্ত, না, নিশিকুটুম্বের ঔরসজাত? এই নিয়ে সমান কূটতর্ক চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। দর্শনার্থীদের কখনো ক্লান্ত করে না। তারা একটার পর একটা নিরন্তর প্রশ্ন করে যায়। এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে শাহানা। ভাবছে কি করে একটু একা হবে। মানুষের এত কোলাহল আর ভাল লাগে না তার। শাহানা সম্ভ্রান্ত ঘরের বউ। শাহেদ প্রথম শ্রেণী সরকারী চাকরিজীবী। তবু রাত করে ঘরে ফেরার দায়ে তোপের মুখে পড়ে। তার কাছের লোকজন জানে সে অক্ষম পুরুষ। তবু সেই সাংবাদিক দল তার পৌরষ নিয়ে নানা রকম সুখপ্রদ গল্প ফাঁদে। তাদের দশ বছরের বৈবাহিক জীবন। আজও শাহানা মা হতে পারেনি। তার পুরুষত্ব নিয়ে নানা কথা আসে। সে দেশ বিদেশের অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে শাহানাকে। যে যেমন বলেছে নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। শাহানাকে নিয়ে সর্বত্র ঘুরে বেরিয়েছে। পীরমোর্শেদের মাজারেও ধর্ণা দিয়েছে। তবু সন্তান লাভে ব্যর্থ শাহানা। পরিশেষে ডাক্তার দু’জনের এক সঙ্গে পরীক্ষা করে জানিয়েছে, শাহেদ ত্রুটিমুক্ত নয়। তার স্পাম জন্মের পরই অবলীলায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আজকের এই আধুনিক বিশ^ায়নে মেডিক্যাল সাইন্স প্রভূত অগ্রগতির দিনেও শাহেদ স্ত্রীর সন্তান কামনার অন্তরায়। এ দায় কখনো শাহানার নয়। তার কোন এক সময় শাহেদ চাইল্ড হোমে যাওয়া-আসা শুরু করে। একটি বাচ্চা শিশু দত্তক নেয়ার জন্য। সে শাহানাকে উদ্দীপ্ত করে নানাভাবে। তবু শাহানা নীরব নিথর উত্তাপহীন। সর্বশেষ শাহানার নির্লিপ্ততায় সে সব ভেস্তে যায়। সেই থেকে শাহানার বন্ধুর পথ। চড়াই উৎরাই। নিঃসঙ্গ জীবনের অভিযাত্রা। তারপর প্রয়োজনের বাইরে কারও সঙ্গে কথা বলে না শাহানা। শাহেদ হাজারো প্রশ্ন করে কোন দিনও উত্তর পায়নি। সে যেন বাগ সংযত এক ব্রত চারিণী। পরিস্থিতির দায়ে আজ শাহানা বেপরোয়া। রাস্তার আঁস্তাকুড় থেকে জাত ধর্মহীন এক অবাঞ্ছিত তুলে এনে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সে। একি প্রতিশোধ? শাহেদ ভাবতে গিয়ে নিজের অক্ষমতায় বার বার আরও বিধ্বস্ত হয়। নিজেকে প্রশ্ন করে, তবে কি সে ঈর্ষান্বিত? যে কারণে আজ প্রাণবন্ত শাহানা, এ যাবৎ সে এরকমই ভেবে আসছে। শাহানা এখন থেকে প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরে থাকবে চিরদিন। শাহানার জীবন আরও সুন্দর হবে। মাতৃত্বের অহংকারে শাহানা যদি আত্মগরবিনী হয়, তবে তো শাহেদের জন্যই স্বস্তিকর। যে অমৃতের স্বাদ নিজে দিতে পারেনি। শাহানার তার নিজের সামর্থ্যে অর্জন করে নিয়েছে। এখানেই শাহেদ দ্বিধাগ্রস্ত। কিছুতে শাহানার প্রাপ্তি মেনে নিতে পারে না শাহেদ। এবড়োখেবড়ো চলার পথে হাঁটতে গিয়ে শাহেদ মুখ থুবড়ে পড়ে যেন। কোথাকার ফুটপাথে পড়ে থাকা এক উন্মাদিনী, যার জাতধর্ম বলে কিছু নেই। কে তার সন্তানের জন্মদাতা। কে বা কারা রাতের অন্ধকারে চৌর্যবৃত্তের ন্যায় কোন এক কামার্ত পুরুষ বীজ বপন করে গেছে। সে সব অজ্ঞাত থাকবে চিরকাল। সেই কামার্তের উৎপন্ন ফসল এখন থেকে চৌধুরীর বংশ মর্যাদায় বেড়ে উঠবে। এজন্য শাহেদ বিবেকের কাছে বারবার আত্মদংশিত হয়। একান্নবর্তী পরিবারের সর্বেসর্বা মিয়া ভাইকে সে কি জবাব দেবে, এ সব কূট দর্শন শাহানার পছন্দ নয়। সে নারী মা হতে পারা তার জন্মগত অধিকার, সে যেমন শাহেদ দিতে পারেনি। শাহানা নিজ উদ্যমে অর্জন করেছে। আজ সে গর্বিত জননী। প্রতীক্ষার রাত ভোর হওয়া মাত্র শাহানা দেরি না করে, ডা. দোহার দরজার কড়া নাড়ে। ডাঃ দোহা বেরিয়ে আসেন। শিশুটিকে নানা ভাবে ডায়াগনোসিস করে বললেন, ‘এ বেবীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। মনে হয় জন্মলগ্ন থেকে মায়ের শালদুধ পেটে পড়েনি। শুধু তোলা দিয়ে একে কোন রকম বাঁচানো সম্ভব নয়। সঙ্গে ল্যাকটেড মাদার দরকার’ ‘কিন্তু স্যার দুধমাতা অনেক খুঁজে ব্যর্থ হয়েছি।’ বলল শাহানা। তারপরও আরেকটু চেষ্টা করে দেখুন যদি হয়। তবে প্রাণে বেঁচে যায় এ অসহায় শিশুটি।’ ‘কি করে হবে।’ ‘যদি পারেন নিশ্চয় দেখুন।’ ‘না, হলে কি আর করা। যদি কেউ দয়া করে... ।’ এই বলে ব্যবস্থা পত্র দিয়ে উঠে দাঁড়ান ডাঃ দোহা। এরমধ্যে শাহানা সমস্ত মহল্লা ঘুরে এসে একেবারে নিরাশ হয়ে বিছানায় ভেঙ্গে পড়ে। সারা মহল্লা তন্ন তন্ন করেও দুধমাতা দূরে থাক একফোঁটা দুধও ঘরে তুলতে পারেনি। অপয়াকে দুধ দিয়ে কোন পোয়াতি মাতা নিজ সন্তানের সর্বনাশ ডেকে আনতে সম্মত নয়। এ উক্তি অভিভাবকেরা সর্বত্র জানিয়ে দিয়েছে। শাহানার চোখ ফেটে পানি আসে। এ সময় শাহেদ ডাঃ দোহাকে পৌঁছে দিয়ে অভ্যাসবশত দিনের শুরুর প্রথম দৈনিক পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বসেছে মাত্র। প্রথম পৃষ্ঠার বক্সনিউজেই তার দৃষ্টি আটকে যায়, বাক্সবন্দী পুরো নিউজটা এক নিঃশ^াসে শেষ করে চমকে উঠে শাহেদ। এ যে তার নিজেরই গল্প যে। হেডিংটা এরকম, ‘একজন ব্যর্থ পুরুষ বাবা আর্তনাদে বড় ব্যাকুল।’ পুরো লাইনটা সে একবারই পড়ে শুধু। এতেই শূল ফোটানো যন্ত্রণা ছড়ায় শরীর জুড়ে। দ্বিতীয় বার আর পড়ে দেখতে ইচ্ছা হয় না। এ যে স্থানীয় সাংবাদিকদের হেডিং নিউজ। কাগজটা দুমড়েমুচড়ে টুকরো টুকরো করে জানালা গলিয়ে বাইরে ছুড়ে দেয়। তার সমস্ত অভিমান গিয়ে জড় হয় শাহানার ওপর। একটা বেওয়ারিশ মাল এত হেনস্থা করছে তাকে, তাকে বাদ দিয়ে কি করে এ মাল পুষে শাহানা দেখতে চায় শাহেদ। শুধুমাত্র নিজের বউর জন্য তার এত হেনস্থা সে ভুলতে পারে না। অফিস কক্ষের ভিতরে বাইরে সর্বত্র ব্যাপারটা টক অব দ্য টাউন। রাগে ফুঁসে ওঠে শাহেদ। এই নিয়ে শাহানার সঙ্গে দ্বিতীয় বার আর কোন আলোচনায় যেতেও ঘৃণা হয়। চৌধুরী বংশের বউ হয়ে এত পদঙ্খলন শাহানার মেনে নিতে কষ্ট হয় শাহেদের। একটা পথের জঞ্জাল ঘরে তুলে এ নোংরামোর উপযুক্ত তুলনা খুঁজে পায় না শাহেদ। মনে পড়ে মা তার ঠিকই বলতেন। সে সময় মায়ের উপদেশ শুনে বিরক্ত হতো শাহেদ। সে ভাবত মা শাহানাকে অপছন্দ করে বলেই হয়তো পায়ে পায়ে দোষ খুঁজে বেড়ায়। তার অপছন্দের কারণ, সে তার মায়ের পছন্দের মেয়ে রুবিনাকে বিয়ে না করে, নিজের পছন্দের শাহানাকে ঘরে এনেছে। শাহেদ এখন ভাবে শাহানা খুবই আত্ম কেন্দ্রিক মেয়ে। সে যখন যেমনভাবে করে যায়। অন্য কারও পরোয়া করে না। শাহেদ বাইরে বেরিয়ে আসে। চেয়েদেখে মাহিমা বেগম ড্রইং রুমের জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। শাহেদ বলল, ‘তুমি কি ভাবছো?’ ‘কি ভাববো ঘরে মন বসে না।’ ‘ভিতরে যাও, এভাবে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে?’ ‘আমাকে একটা কাজ করে দিবি বাবা।’ হঠাৎ বললেন মাহিমা বেগম। ‘বলল, ‘কি কাজ করতে হবে।’ ‘অনেক দিনতো হলো, এবার বাড়ি যাব।, ‘মনটা কেমন করে।’ ‘পানি কাদার মধ্যে যাবে। ঘরবাড়ি ভেসে গেছে যে। ঘরে হাঁটু পানি। থাকতে পারবে? মিয়া ভাইবা বলবে কি।’ ‘বলার তো কিছু নাই বাবা। ‘নাপাক শিশুর সঙ্গে এক ঘরে থাকা যায় না।’ ‘বয়স হইছে তো। দু’দিন যে বাঁচবো সেই ভরসাও পাই না। আখেরাতে কি জবাব দিমু।’ অবশেষে মাহিমার কণ্ঠে মিনতি ঝরে পড়ে, ‘একটা ব্যবস্থা করে দে না... ।’ ১০ একটানা অঝর ধারার বৃষ্টির পর, আজ নীল আকাশ নীল ফুলের মত তার স্বরূপ উম্মোচন করে। চার পাশের লোকজন বৃষ্টি শেষে চাড়া দিয়ে উঠতে পেরেছে। পত্রিকার খবরটা দেখার পর সেই থেকে শাহেদ আরও বিষণœ। আজ আর তার অফিসেও যাওয়া হয়নি। পরিচিত কাউকে মুখ দেখাতেও তার লজ্জা। সহকারী বন্ধুরাই বা কি ভাবছে। এই জন্য দুশ্চিন্তায় বাসা থেকে বের হতে মন সায় দেয়নি। এই সময় মাহিমা বেগম হঠাৎই শ শ ব্যস্ত হয়ে ছুটে এসে বললেন, ‘শুনছোস শাহেদ, ‘শাহানা আবার কি কা- করেছে?’ সবেমাত্র দিবা নিদ্রা থেকে উঠে বসেছে শাহেদ। ঘুম কাতুরে কণ্ঠে বলল, ‘আবার নতুন কী করলো শাহানা?’ মাহিমা বেগমের কণ্ঠে ঝাঁজ, বললেন, ‘করেনি তো কী বাকি রেখেছে! সবেতো শুরু। না জানি আরও কত কি দেখতে হবে।’ গৌরচন্ডিকা আর সহ্য হয় না শাহেদের, বলল, ‘একটু খুলে বলবে মা, ছাদের কোন দিকটা গুঁড়িয়ে দিয়েছে শাহানা।’ এরপর থতমত খেয়ে মাহিমা বেগম ইনিয়ে বিনিয়ে যা বললেন, তার মর্মার্থ দাঁড়ায়, শাহানা পুরান বাজার পতিতালয় থেকে একটি মেয়েকে ধরে এনে শিশুটিকে দুধ খাইয়েছে। সে এখন খুবই চন্মন্।ে তার বিপদও অনেকটা কেটে গেছে। খেদ করে শেষে বললেন, ‘সেই বেশ্যা মেয়েটা নাকি এখন থেকে পালা করে রোজ দু’বেলা আসবে।’ তার কণ্ঠ ঝংকার শাহেদের কর্ণ কুহরে সিসার মতো যন্ত্রণা করে। শেষমেশ শুধু শুনতে পেল সে, ‘আমাকে এক্ষণি একটা নৌকা এনে দাও এখানে আর এক দ-ও নয়, মরতে হয় স্বামীর ভিটায় মরব তাতেই শান্তি।’ মাহিমা বেগমের অভিযোগগুলো মন দিয়ে শোনার মতো আর শাহেদের কোন অবস্থা ছিল না। সে ভাবছে শুধু, এ কি করে সম্ভব! শাহানা প্রজটিউট থেকে একটা মেয়ে ধরে এনেছে শুধু বাচ্চাটাকে দুধ দেবে বলে, এ সাহস কি করে পায় শাহানা? সন্ধ্যা আসন্ন। সবেমাত্র একটু একটু করে রাস্তার ঘোনাঘুপচি জুড়ে অন্ধকার দানা বাঁধতে শুরু করে। আর একটু পর বৈদ্যুতিক আলো জ¦লে উঠবে শহর জুড়ে। এ সময় কলাপসিবল গেটের বাইরে জলমগ্ন রাস্তার ওপর কারা যেন হৈহুল্লোর করে। শাহেদ ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে দাঁড়ায়। দেখে পাড়ার দু’টা রকবাজ ছেলে একটি মেয়েকে দু’দিক থেকে ধরে নিয়ে পানি ভেঙ্গে সামনে এগুচ্ছে। দূর থেকে মেয়েটির বয়স ঠিক আন্দাজ করতে পারে না শাহেদ। তবে অনুমান থেকে একটু কমই হবে হয়তো। তার হালকা পাতলা গড়ন। পান পাতার মতো মুখশ্রী। কাঠ-কাঠ সুদৃঢ় শরীর জুড়ে তামাটে বর্ণচ্ছটা। সব ছাড়িয়ে উঠে আসে, মেয়েটির শরীর জুড়ে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। পিছনে তখনও পুরো দলের হুল্লোড়ে ছেলেগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আস্ফালন করছে। ওদের মধ্যে থেকে দলনেতা ছেলেটি বেরিয়ে এসে বলল, ‘স্যার, মহিলাটা অনেক সময় হয় পানি ভেঙ্গে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিল। আমরা সব দূর থেকে লক্ষ্য করি। শেষে কোন সুবিধা করতে না পেরে গেটের ভেতর ঢোকার পাঁয়তারা করলে, তখনি আমরা প্রস্তুতি নেই, ‘দৌড়ে ধরে ফেলার। বিষয়টা অন্দর মহলে দেরিতে পৌঁছালেও শাহানা খবর পেয়ে মাত্র হন্তদন্ত ছুটে আসে। শাহেদ গেট পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটি বলল, ‘সাহেব’ আমি মোটেও খারাপ মেয়েছেলে নই, উদ্দেশ্যও আমার মন্দ নয়। পরশু সন্দায় আমি আমার কোলের মেয়েডারে হারায়াছি। একে বারে আতুর দুধশিশু। লোক মুখে শুনেছি, মেয়েটি এখানেই নাকি কোথায় আছে। বাড়িটা খুঁজবার আছি, পাইনাই।’ এ সময় শাহেদ সন্দেহ প্রবণ হয়ে বলল, ‘তোমার নাম কি?’ বলল মেয়েটি, ‘মোমেনা।’ ‘থাকো কোথায় তুমি?’ ‘ওই রূপ নগর টকী হলের পাছের বস্তিতে।’ এ সময় ভিড়ের মধ্যে শাহানাকে লক্ষ্য করে মোমেনা বলল, ‘আপনেই তো হেই মেম সাহেবা। আপনের কোলেইতো আমার গেন্দা মাইয়াডারে দিছিলাম। হেই সময় মাথাটা ঠিক ছিল না গো মেম সাহেবা। না খাওয়া মানুষতো সংসারে মরণ বাঁচনের লড়াই। ঝুপড়ি ঘরে পানি। খিদার তাড়নায় বুঝবার পারিনাই ভালমন্দ। তা না হলে কোন মায়ের কি সন্তান বেশি মনে হয়? সেই সকাল থেইকা সারাদিন মেইয়েডারে খুঁজবার লাগছি। ওরে না পাইলে মুই বাঁচুম না যে।’ শাহেদ বলল, ‘তুমি বলছো নিজের সন্তান?’ তা তুমি অন্যকে দেবে কেন?’ মোমেনা স্থির মাথায় বলল, ‘সাহেব, আমার এই বয়সে আরও দুটা মাইয়া আছে। স্বামী আমার জাহাজ ঘাটের কুলি। যাত্রী ওঠা নামার আগের মতো এহন আর কাম নাই। বাস চাপায় হ্যায় পঙ্গু হয়া ছয়মাস হয় বিচানায় পইড়া আছে। বন্যার পানিতে ঝুপড়ি ঘরখানা আগে থেইকাই ডুইবা গেছে। আতুর মাইয়েডার জন্য কামে যাইবার পারি নেই। পঙ্গু স্বামী বাচ্চাকাচ্চা লইয়া যে কোথায় যাইমু হে সাহসও পাই নাই। ভাবলাম এবার হক্কলে মিল্যা এক সাথে মরমু। থাকার জায়গা নাই, খাওন নাই। শ্যাষমেশ কামে বেরইলাম। দেহি শেষ চেষ্টা কইরে বাঁচবার পারিকি না। সন্দাকালে ঝুপড়িতে ফেরার পথে একটা আজব ব্যাপার দেখলাম, পাগলের পাগলামী, মনা পাগলি নিজের আতুর পোলাডারে টুপ কইরে বন্যার পানিতে ছাইড়া দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটা যে কোথায় ভাইস্যা গেল মালুম করবার পারি নেই। অন্য কিছু না ভাইবা আমার নিজের আতুর মেইয়েডার কথা ভাবলাম এ সুময়। আমার চোখ খুলে গেল। এই তো সুময়। পাগলিরে দিয়েতো মোর মেইয়েডারে বাঁচাইবার পারি। এই দুনিয়াতে কত মানুষের কত রকম অভাব আছে। আমার পোলাপানের দরকার নেই তবু আল্লাহ্ আমারে দেয়। যা গোর দরকার দেয় না। পাগলির কাছে দিনরাত কত মানুষ আহে বাচ্চা নেওনের। পাগলি দূর দূর কইরে খ্যাগাইয়া দেয়। কাছে ঘেষতে দেয় না। সুযোগটা কাজে লাগাই আমি। সেইকাল সন্দায় বৃষ্টির ঘোরলাগা আন্ধারে আমার নওল শিশুটা লইয়া দাঁড়াইয়া থাকি, যদি নিঃসন্তান কেউ দত্তক নিবার আহে হে আশায়। ঠিকহেই সুময় এই মেম সাহেবা ঝুম বৃষ্টির মধ্যে পাগলির কাছে আগাইয়া গেলে আন্ধারে আমি আমার কইন্নাডারে কোলে তুইল্যা দেই; মেম সাহেবা পাগলির সন্তান ভাইবা তুইল্যা নেয় নিজের কোলে।’ মোমেনা যেন এক নিঃশ^াসে গল্প শেষে হাঁসফাঁস করে। তারপর ছাতি ফাটা তেষ্টায় এক গ্লাস পানি দাবি করলে ময়নার মা ছুটে গিয়ে পানি গ্লাস এনে দেয়। সে ডগডগ করে গিলে একটা স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলে। এ সময় শাহেদ প্রশ্ন করে, ‘তুমি বৃষ্টির মধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকারে কী করে তোমার মেম সাহেবা কে মনে রাখলে?’ মোমেনা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা লুফে নিয়ে বলল, ‘এইডা কি কন সাহেব, আমার নাড়ি ছেড়া ধন কার কাছে তারে চিনুম না! মেম সাহেবা আমার মনের আয়নায় সব সময় ফুইটা আছে যে। আমি যতদিন আছি হ্যায় একই রকম ফুইটা থাকবো।’ এবার শাহানার কাছে মোমেনা ছুটে গিয়ে বলল, ‘মেম সাহেবা, অপরাধ নেবেন না। অভাগি মায়ের কোন্যা মেহেরবাণী কইরা মায়ের কোলে ফিরায়া দেন। মুই ওরে ছাড়া বাঁচুম না যে। মোর ঘুম আহার সব হারাম হইয়া গেছে। ফিরায়া দেন আমার জানের টুক্রা। সবশেষে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বেতসলতার মতো মোমেনা। শাহেদ এবার কাছে ডেকে বলল, ‘তোমার বাচ্চা, তার কি কোন প্রমাণ দিতে পারবে?’ সঙ্গে সঙ্গে চারদিক পিন পতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কারও মুখে কোন ভাষা নেই। বিমূঢ় হয়ে পড়ে সবাই। মোমেনা এক মুহূর্ত থতমত খেয়ে দ্বিগভ্রান্তের মতো চারদিক কি যেন খুঁজে ফেরে। শেষে হাতের কাছে কিছু না দেখে নিজের বুকের জামার হাত চালিয়ে জামাটা ছিড়ে ফ্যালা ফ্যালা করে। তারপর সুুউচ্চ মাতৃস্তন্যদ্বয় অবলীলায় টেনে বের করে আনে। যেন মা হতে পারাই তার জন্মগত অধিকার। কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। আছে শুধু মাতৃত্বের গর্ব আর গৌরব গাথা। এরপর উপস্থিত জনতা সাগ্রহে চেয়ে দেখে তার বুকের স্তন্য থেকে নিঃসৃত অমৃত সুধা তখনো ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে...।
×