ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

বাংলার অনুভবে অনুধ্যানে

প্রকাশিত: ১২:১৯, ১৫ মার্চ ২০১৯

বাংলার অনুভবে অনুধ্যানে

‘বাংলার অনুভবে অনুধ্যানে’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে বেহুলা বাংলা। গ্রন্থটির শিরোনামই নির্দেশ করে তার বিষয়বস্তু, আঙ্গিক আর বৈশিষ্ট্য। শৈল্পিক সত্তার এমন সুবর্ণ সময়ে মনে পড়ে যাদের কারণে পৃথিবীর আলো দেখাই শুধু নয় যারা বটবৃক্ষের মতো সুশীতল স্নেহে, ছায়ায় পুরো জীবনটা গড়ে দিয়েছেন। উৎসর্গ পত্রে এসেছে সেই বাবা-মা আর বড় ভাইকে স্মরণ করার এক অনন্য বোধ। লেখক পেশায় একজন সাংবাদিক। এই জগতটা সমাজ, সংস্কার এবং মানুষ নিয়েই আবর্তিত। সব সময় ঐতিহ্যিক ও সুশোভিত বাংলাকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে চিরায়ত বোধ, সমৃদ্ধ চেতনা এবং নান্দনিক বাংলার হরেক রকম উৎসব আয়োজন ও লেখকের মনন শৌর্যের অনুষঙ্গ হয়েছে। সময়ের নিদ্রি আবর্তে পড়া চার পাশের পরি বেশ, পরিস্থিতি যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা অনমনীয় বাঙালীর সংস্কৃতি ও উৎসব পার্বণ যেন ঘটনা পরম্পরা। এরই অবধারিত পরিণতিতে ১৯৭১-এর মুক্তি সংগ্রাম সেই পর্যায়ক্রমিক কালান্তরের এক অনবদ্য নির্মাণ সৌধ। সেই চৈতন্যে লেখক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিয়তই শাণিত করেন, যুদ্ধাপরাধীদের বর্জন করতেও তার সুচিন্তিত অভিব্যক্তি একটুও নড়চড় হয় না। উদ্দীপ্ত চেতনায় সময় ও আধুনিক প্রজন্ম যদি লড়াই-সংগ্রামের অনিবার্য পর্বকে তার চিন্তাশীলতায় গভীরভাবে গেঁথে নেয় সেখানে ভবিষ্যত ও নতুন বাংলাদেশ ইতিহাসের যথার্থ পরিক্রমায় নিরন্তর এগিয়ে যাবে। লেখক তার প্রতিটি প্রবন্ধে সে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করে পাঠক সমাজকে যে মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যাবে তার জন্য বইটি পড়া সবার আগে জরুরী। বইটি শুরু করা হয় ‘ঐতিহ্যের বাঙালী বাঙালীর ঐতিহ্য’ দিয়ে। নদী-বিধৌত শ্যামল বাংলার প্রকৃতির কোলে লালিত সন্তানরা প্রতিদিনের যাপিত জীবনের অনুপম মাধুর্যে নিজেদের পরিতৃপ্ত করে তারই এক নান্দনিক বর্ণনা এই রচনা। উৎসব আর আয়োজনের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন বাঙালীর যে অবিমিশ্র হৃদ্যতা তারই একটি শিল্পীত রূপ আলোচ্য প্রবন্ধটিকে পাঠকের সামনে তুলে ধরে। উৎসবপ্রিয়তা বাঙালীর সহজাত। ষড়ঋতুর বৈচিত্রিক রূপসম্ভার আনুষ্ঠানিকতার যে ভা-ার খুলে দেয় সেখানে নিজেকে সমর্পণ করে বাঙালী আত্মপরিচয় আর অস্তিত্বে আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জীবিত হয়। এ ছাড়াও অনেকদিন ধরে চলে আসা এই উৎসব আর ঐতিহ্যিক অনুষ্ঠান সময়ের দুর্বার মিছিলে আধুনিকতায় রূপ নিয়ে যুগের উপযোগী হয়ে উঠেছে। ভিন্ন ভিন্ন নামে অনেক প্রবন্ধ বইটিতে সাজানো- গোছানো হলেও বাংলা ও বাঙালীর স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য, সংগ্রাম, আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ঘুরে ফিরে প্রতিটি রচনায় পাঠকের নজর কাড়ে। ‘সময়ের বিজয় গাঁথা’ও সেই মুক্তিযুদ্ধ আর অবিস্মরণীয় বিজয়। আবার একইভাবে এমন মহান বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে লুণ্ঠিত হওয়ার বেদনাও গ্রন্থের রূপকারকে বিমর্ষ করে দেয়। প্রাসঙ্গিকভাবে এসেই যায় ঘাতক দালালদের বিচারের প্রক্রিয়া। সঙ্গে উদ্দীপ্ত তারুণ্যের জ্বলে ওঠার এক যুগান্তকারী পর্ব। ২০১৩ সালের ‘গণজাগরণ মঞ্চে’র সেই উত্তাল আবেদনে সারা বাংলা শিহরিত হওয়ার ঐতিহাসিক পালাক্রমও লেখকের মনন দ্যোতনায় ভর করে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকরে দেশ যেন কলঙ্কমুক্ত হয়, শহীদানের রক্তের ঋণ যেন কিছুটা শোধও হয়। স্বাধীনতার শত্রুদের বোঝা বইতে বইতে জাতি যখন ক্লান্ত, অবসন্ন সেই ক্ষণে তাদের বিচার যেন দায়মুক্তির এক অনবদ্য সোপান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি নিবেদিত এই গ্রন্থকার ২০১৩ সালেই জাতীয় পতাকার বৃহদাকার অবয়ব যা বিশ্বের যে কোন পতাকার চাইতে বড় সেখানেও লেখক আত্মশক্তি আর স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে উদ্বেলিত। আবার কোটি কণ্ঠের জাতীয় সঙ্গীত একই সঙ্গে গাওয়া ২০১৩ সালের বিজয় দিবসে সেও দেশপ্রেমিক বাঙালীদের এক অসাধারণ মিলন উৎসব। মুক্তিযুদ্ধের গান নিয়ে লেখা ‘যে গান অনুপ্রেরণার’ প্রবন্ধটি যথার্থ চেতনায় মুক্তিযুদ্ধকে কথা ও সুরের অনবদ্য সংযোজনে সর্ব মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়াও জাতির দায়বদ্ধতা। যে দৃঢ় আদর্শে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত সুসংহত হয়েছিল সেখান থেকে সামান্য বিচ্যুতি এমন মহিমান্বিত লড়াইকে ম্লান করে দিতে পারে। আর সেই বোধে বাণী ও সুরে যথার্থ ইতিহাস যুক্ত হওয়া সময়ের দাবি। বইটি পাঠক সমাজকে বাঙালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রামকে নতুন ভাবে মনে করিয়ে দেবে। বইটি পড়ার জন্য সবাইকে বিশেষ অনুরোধ।
×