ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতে ইসলামী খোলস বদলায়, স্বভাব বদলায় না

প্রকাশিত: ০৯:০১, ১৬ মার্চ ২০১৯

 জামায়াতে ইসলামী খোলস বদলায়, স্বভাব বদলায় না

(গতকালের সম্পাদকীয় পাতার পর) ১৯৭৯ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে আত্মপ্রকাশের পরই জামায়াতে ইসলামী ঘোষণা করেছিল ’৭১-এ তাদের রাজনৈতিক অবস্থান সঠিক ছিল এবং ’৭১-এ তারা কোনও ভুল করেনি। এরপর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্বে জামায়াতবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়েছে। ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সারাদেশে ‘যেখানে জামায়াত- সেখানেই প্রতিরোধ’-এর ঘোষণা দেয়। যার ফলে জামায়াত সারা দেশে একটি সমাবেশ করতে পারেনি। যেখানেই তারা সভা-সমাবেশ করতে চেয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে জনগণ তা প্রতিহত করেছে। ১-৭ মে (১৯৮১) মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ‘রাজাকার আলবদর প্রতিরোধ সপ্তাহ’ পালন এবং ২৫ মে সারা দেশে হরতাল আহ্বান করে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার বাধ্য হয়ে ২৩ মে দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল- মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জামায়াত নিষিদ্ধকরণের দাবি পর্যালোচনা করা। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান। ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর কিছু সময়ের জন্য জামায়াতবিরোধী আন্দোলন স্তিমিত হয়েছিল। এরপর জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন জোরদার হলে জামায়াত কৌশলে বিরোধী দলের আন্দোলনে ঢুকে পড়ে এবং বিএনপিকে প্রধান মিত্র হিসেবে বেছে নেয়। সে সময় বিচিত্রার একটি প্রচ্ছদ কাহিনীর শিরোনাম ছিল ‘আক্রমণাত্মক ভূমিকায় জামায়াত শিবির : সামনে বিভীষিকা।’ এতে আমি লিখেছিলাম- ‘বিচিত্রার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিএনপি’র মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদার বলেছেন- জামায়াত নাকি স্বীকার করেছে একাত্তরে তারা ভুল করেছিল। বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কোন জামায়াতী নেতা হয়তো এমন কথা বলতে পারেন কিন্তু এর প্রকাশ্য কোন নমুনা আমরা আজ পর্যন্ত দেখিনি। মাত্র দু’মাস আগে আল-বদর কমান্ডার আমিনুল হকের লেখা একটি বই বাজারে বেরিয়েছে। ’৭৩ সালে ৪০ বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত এই আল-বদর অধিনায়কের বইটির নাম ‘আমি আল-বদর বলছি’- নিজের একাত্তরের ভূমিকাটুকু বাদ দিয়ে কারাবাসের স্মৃতির কথা তিনি লিখেছেন এই গ্রন্থে। একাত্তরের কথা না বললেও সাজার মেয়াদ দেখে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান কী ছিল, যেখানে শহীদুল্লা কায়সারের হত্যাকারী অপর আল-বদর খালেক মজুমদারের শাস্তি হয়েছিল মাত্র ৭ বছর। বইটির প্রচ্ছদে স্টেনগান ধরা উদ্ধত হাতের ছবি। স্টেনগানের ওপর আরবীতে লেখা ‘ওয়াদুলাহুম মাস্তাফাতুম মিনকুওয়াতিন।’ সরল বাংলা তর্জমা হচ্ছে ‘সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে তাদের শত্রুতা কর।’ এই বইয়ের ৮৫ পৃষ্ঠায় তিনি একাত্তরে তার তৎপরতা সম্পর্কে শুধু এটুকু বলেছেন, ‘আমি জেনে শুনে ইমানের দাবিতে এ কাজ করেছি। আমি এ জন্য অনুতপ্তও নই ক্ষমাপ্রার্থীও নই।’ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জামায়াতীরা পাক-হানাদার বাহিনীর দোসর হয়ে সারাদেশে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল সেই সময়ের প্রতিদিনের খবরের কাগজে তার বিবরণ পাওয়া যাবে। একাত্তরে যা ছাপা যায়নি বাহাত্তরে ছাপা হয়েছে। এই নয় মাস তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘জারজ সন্তান’ ‘ভারতের চর’ বলে আখ্যা দিয়ে নির্মূল করার আহ্বান জানিয়েছে এবং যেখানে পেরেছে নির্মূল করেছে। ধর্ষণ ও লুণ্ঠনকে জায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছে। এর জন্য পরে কখনও তাদের লজ্জিত বা অনুতপ্ত হতে দেখা যায়নি। বরং ’৮০ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থ ও রাজনৈতিক সমর্থনের জোরে পায়ের নিচে একটু মাটি খুঁজে নিয়ে বলা শুরু করেছে, ’৭১-এ আমরা ভুল করিনি।’ ‘এটা ঠিক যে, ’৮১-তেও প্রতিরোধ ছিল প্রবল। ’৭৮-এর ১১ জুলাই অসুস্থ মাকে দেখার বাহানায় পাকিস্তানের নাগরিক গোলাম আযম তিন মাসের ভিসা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। এসেই তিনি পাসপোর্ট ভিসা ফেলে দিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে সংগঠিত করার কাজে ঝাঁপ দিলেন। প্রথম দিকে অতিথি হিসেবে জামায়াতীদের কয়েকটি পুনর্মিলনী সভায় তিনি যোগ দিয়েছিলেন বটে তবে জনসভা করতে গিয়ে জনতার রুদ্ররোষের শিকার হয়ে তাকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। ’৮১-র ১ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনের মুক্তিযুদ্ধের শহীদ দু’জন বাংলাদেশী নাগরিকের জানাজায় তিনি ঢুকে পড়েছিলেন এক ফাঁকে, জানাজা শেষ হওয়া মাত্র উপস্থিত নামাজীরা তাঁকে চিনে ফেলেন এবং শুরু হয় জুতোপেটা। সেবারও কোনরকমে পালিয়ে বাঁচেন তিনি। ‘জনতার হাতে বার বার লাঞ্ছিত হয়ে জামায়াত নেতা গোলাম আযম তাঁর শ্বাপদ বাহিনীকে লেলিয়ে দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। জামায়াতের অস্থায়ী আমির আব্বাস আলী খান ২৯ মার্চ (১৯৮১) এক সাংবাদিক সম্মেলনে আবার বললেন, ’৭১-এ আমরা ভুল করিনি।’ গোলাম আযমও পত্রিকান্তরে সাক্ষাৎকারে বললেন, ’৭১-এ যা ঠিক মনে করেছি তাই করেছি, এখনও তাই করব।’ (সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১৭ বর্ষ ২৪ সংখ্যা, ১১ নবেম্বর ১৯৮৮)। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর পুনর্জীবন ঘটেছে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানাবার আইএসআই-এর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। ১৯৭২-এর সংবিধানের দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীর প্রধান পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযম ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের বদান্যে বাংলাদেশে আসতে পেরেছিলেন এবং তার যোগ্য সহধর্মিণী খালেদা জিয়ার জমানায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেছিলেন আইএসআই-এর নীলনকশা অনুযায়ী। আত্মপ্রকাশের পর থেকে যখনই জামায়াত কোণঠাসা হয়েছে তখন কৌশল (খোলস) পাল্টেছে। ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররমে ফিলিস্তিন যুদ্ধে শহীদ দুই বাংলাদেশীর জানাজা পড়তে এসে গোলাম আযম কিভাবে উপস্থিত নামাজীদের স্বতঃস্ফূর্ত জুতোপেটা খেয়েছিলেন সে ছবি পরদিন সব দৈনিকে ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। গোলাম আযম সাময়িকভাবে আত্মগোপন করেছিলেন, ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে ১৯৯১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত দলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্বাস আলী খান। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পেছনে জামায়াতের হাত রয়েছে, কারণ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জামায়াতবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতার কারণে জেনারেল জিয়া নিহত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে জামায়াত নিষিদ্ধকরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন কর্নেল জামানদের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ১৯৯১-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে জামায়াতের সমর্থন ছাড়া খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার গঠন করতে পারত না। এই সমর্থনের বিনিময়ে জামায়াত গোলাম আযমের নাগরিকত্ব আদায় করেছিল এবং নাগরিকত্ব প্রাপ্তির আগেই ’৯১-এর ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াত দলের আমির ঘোষণা করেছিল। এর প্রতিবাদে সবার আগে মুক্তিযোদ্ধা সংসদই রাস্তায় নেমেছিল। প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদের ভেতরে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ এবং এর তিন সপ্তাহ পরে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং দ্বিধাবিভক্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সকল সংগঠনের সমন্বয় ঘটেছিল। জামায়াত সমর্থিত খালেদা জিয়ার সরকার জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন জামায়াতবিরোধী আন্দোলনের প্রবল বিরোধিতা করেছিল। ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ গণআদালতে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার করার জন্য শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ গণআদালতের ২৪ জন উদ্যোক্তা ও অংশগ্রহণকারীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও দায়ের করেছিল। তবে রাজপথে আন্দোলনের ব্যাপকতা এবং আন্দোলনের প্রতি সংসদের ভেতরে বিরোধী নেতা শেখ হাসিনার প্রবল সমর্থনের কারণে খালেদা জিয়ার সরকারবিরোধী দলের সঙ্গে চার দফা চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল, যার প্রথম দুই দফা ছিল- গোলাম আযমের বিচার এবং গণআদালতের ২৪ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার। বোধগম্য কারণে খালেদা জিয়ার শাসনামলে তা করা হয়নি। আত্মপ্রকাশের পর থেকে জামায়াত আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। এই প্রতিপক্ষের ভেতর প্রধান ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলসমূহ এবং তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের ক্যাডাররা বিএনপির ছাত্রদল, এমনকি ইসলামী ছাত্রসেনার মতো সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। যে কারণে খালেদা জিয়ার বিএনপি নির্মূল কমিটির আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রদলের কর্মীরা জাহানারা ইমামের জনসভায় যোগ দিয়েছে এবং জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। অবশ্য পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া তনয় তারেক জিয়ার কল্যাণে ছাত্রদল-শিবির এক মায়ের সহোদর সন্তানে পরিণত হয়েছিল। চলবে...
×