ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুসলিম-অভিবাসীদের হত্যাকারীদের নাম লেখা ছিল ব্রেনটনের আগ্নেয়াস্ত্রে

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ১৬ মার্চ ২০১৯

মুসলিম-অভিবাসীদের হত্যাকারীদের নাম লেখা ছিল ব্রেনটনের আগ্নেয়াস্ত্রে

অনলাইন ডেস্ক ॥ বিভিন্ন দেশের মুসলিম এবং অভিবাসীদের হত্যার কারণে যেসব লোকজনের সাজা হয়েছে তাদের অনেকের নামই লেখা ছিল ব্রেন্টন ট্যারেন্টের আগ্নেয়াস্ত্রে। ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলার ঘটনা ফেসবুকে লাইভস্ট্রীমিং করেছিলেন ওই হামলাকারী। আল নুর মসজিদে নির্বিচারে পুরুষ-নারী-শিশুদের ওপর তার গুলি চালানোর দৃশ্য এতটাই ভয়ংকর ছিল যে তা একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে বেশিক্ষণ দেখা সম্ভব নয়। খুবই পারদর্শীভাবে মুসজিদের ভেতরে থাকা নামাজরত মুসল্লিদের ওপর গুলি চালিয়েছে সে। ব্রেন্টন ট্যারেন্ট ওই হামলার আগেই তথাকথিত একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন যেখানে তিনি তার সহিংস কট্টর ডানপন্থী মতাদর্শ তুলে ধরেছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের ভাষায়, ব্রেন্টন ট্যারেন্ট আসলেই একজন ‘উগ্র ডানপন্থী সন্ত্রাসবাদী।’ হামলার ঘটনার যে ১৭ মিনিটের ভিডিও এবং তার আগে যে সুদীর্ঘ ইশতেহার তিনি প্রকাশ করেছেন, তা থেকে তার চিন্তা ও মতাদর্শ সম্পর্কে বেশ কিছু ধারণা পাওয়া গেছে। ব্রেন্টন ট্যারেন্ট যখন অস্ত্র বোঝাই গাড়ি নিয়ে আল নুর মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন তখন তার গাড়িতে যে গান বাজছিল, সেটি একটি সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদী রণসঙ্গীত। ‘চেটনিকস’ নামে পরিচিত সার্বিয়ান প্যারামিলিটারি ইউনিট ১৯৯২-৯৫ সালের বসনিয়ান যুদ্ধের সময় এটাকে তাদের কুচকাওয়াজ সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার করতো। এই সঙ্গীতে বসনিয়ার যুদ্ধের সময় সার্বদের নেতা রাদোভান কারাদযিকের প্রশংসা করা হয়েছে। গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রাদোভান কারাদযিক দোষী সাব্যস্ত হন। মুসলিমদের এবং অভিবাসীদের হত্যার কারণে যেসব লোকের সাজা হয়েছে, তাদের অনেকের নামও লেখা ছিল ব্রেটন ট্যারেন্টের আগ্নেয়াস্ত্রগুলোতে। একটি অস্ত্রের গায়ে বেশ কয়েকজনের নাম লেখা ছিল। এরা হলেন: ১. অ্যান্তন লুন্ডিন পিটারসন, সুইডেনে দুই অভিবাসী শিশুকে হত্যা করেছিলেন এই শিক্ষার্থী। ২. আলেকজান্দ্রে বিসোনেতে, ২০১৭ সালে কানাডার একটি মসজিদে হামলা চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করে সে। ৩. স্কেনডারবার্গ, আলবেনিয়ার এই নেতাকে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী করা হয়। ৪. অ্যান্তনিও ব্রেগাডিন, এই ভেনেতিয়ান সামরিক কর্মকর্তা একটি চুক্তি ভেঙে তুর্কি বন্দীদের হত্যা করেছিলেন। ৫. চার্লস মার্টেল, এই ফ্রাংকিস সামরিক নেতা আন্দালুসিয়ায় ব্যাটল অব ট্যুরস-এ মুসলিমদের পরাজিত করেন। এসব নামের পাশাপাশি ১৬৮৩ সালের কথাও উল্লেখ রয়েছে ব্রেন্টনের অস্ত্রে। ১৬৮৩ সালে দ্বিতীয়বারের মতো অটোমান সামাজ্যের অধীনে চলে যায় ভিয়েনা। একটি বন্দুকের গায়ে লেখা ছিল ‘ফর রদারহ্যাম।’ যুক্তরাজ্যের রদারহ্যামে শিশুদের ওপর এশিয়ান মুসলিম পুরুষদের যৌন নিপীড়নের যে কেলেঙ্কারির ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল, সেই ঘটনাকেই এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোর ঐতিহাসিক অনেক লড়াইয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বিভিন্ন শব্দ লেখা ছিল তার অস্ত্রে। অস্ট্রেলিয়ান গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ব্রেন্টন সিডনি থেকে প্রায় ৬শ কিলোমিটার উত্তরের শহর গ্রাফটনের বাসিন্দা। তার সাবেক বস ট্রেসি গ্রে দাবি করেছেন, ব্রেন্টনের মধ্যে তিনি কখনো কোন চরমপন্থী চিন্তাভাবনা বা পাগলামি আচরণ দেখেননি। দীর্ঘ ইশতেহারে ব্রেন্টন লিখেছেন, ২০১৭ সালে ইউরোপ ঘুরে আসার পর তিনি এই হামলার পরিকল্পনা শুরু করেন। বিশেষ করে তিনি উল্লেখ করেছেন, সুইডেনে একটি লরি চালিয়ে ইসলামিক স্টেটের সমর্থক এক ব্যক্তির চালানো হামলার কথা। এছাড়াও আছে ফ্রান্সে এমানুয়েল ম্যাঁক্রোর মতো লোকের প্রেসিডেন্ট হওয়া এবং ফ্রান্সে যে জাতিগত বৈচিত্র তা নিয়েও ক্ষোভ-হতাশার কথা বলেছেন তিনি। তার ওই দীর্ঘ ইশতেহারের শিরোনাম দেয়া হয়েছে, ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট।’ এতে যে ধরণের ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ তুলে ধরা হয়েছে, তা সাম্প্রতিককালে অনলাইনে দ্রুত প্রসার লাভ করছে। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীদের একটি ব্যাপক আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীও তৈরি হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মূল কথা হলো, ইউরোপীয়রা তাদের তুলনায় নিকৃষ্ট এবং বিপজ্জনক জাতি ও সংস্কৃতির দাপটে ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মূলত মুসলিমদের নিয়ে ঘৃণা এবং ভীতি ছড়ানোর সাংকেতিক আলোচনা বলে মনে করা হয় এসব আলোচনাকে। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে আরও বলা হয়েছে, পশ্চিমা দুনিয়ায় যে অভিবাসীদের আসার হার বেড়েই চলেছে, এর পেছনেও রয়েছে ষড়যন্ত্র। বিশ্ব পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখতে বড় বড় রাষ্ট্র এবং কর্পোরেশনগুলো ‘হোয়াইট জেনোসাইড’ বা ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যায়’ উৎসাহ যোগানোর নীতি নিয়েছে। এই ইশতেহারে এন্টি সেমিটিক (ইহুদী বিদ্বেষী) এবং নব্য নাৎসীবাদী কথাবার্তাও রয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়ায় যে উগ্র ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটছে তার পেছনে এ ধরণের ‘ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্বের’ বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। নানা ধরণের গোপন গোষ্ঠী ফেসবুকে এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে এসব প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
×