ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মাসুদ রানা

গণহত্যা ১৯৭১ ॥ সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ১৭ মার্চ ২০১৯

গণহত্যা ১৯৭১ ॥ সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা

একাত্তরের ২০ মে পাকিস্তানী বাহিনী খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের চুকনগরে গণহত্যা চালিয়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করে। ২০ মে চুকনগর গণহত্যা চালানোর পূর্বে চুকনগর থেকে কিছু শরণার্থী পরিবার ভারতে যাওয়ার জন্য খুব ভোরে বের হয়ে যশোরের কেশবপুরের প্রায় ১২-১৩ কি:মি: পশ্চিম দিকে ত্রিমোহিনী নামক জায়গায় রাত যাপন করে। ২১ মে ভোরবেলা আবার যাত্রা শুরু করে। সরসকাঠি, ধানদিয়া, ক্ষেত্রপাড়া জনপদ পেরিয়ে তারা সাতক্ষীরা জেলার সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গা বাজারে এসে পৌঁছায়। অন্যদিকে খুলনার দাকোপ উপজেলার বাজুয়ায়, বটিয়াঘাটা উপজেলার বাদামতলা বাজারে, ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে ব্যাপক গণহত্যা ও লুটপাটের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া খুলনার বটিয়াঘাট, ডুমুরিয়া, যশোরের মনিরামপুর, বাগেরহাটের ফকিরহাট, রামপাল ও পিরোজপুর অঞ্চলের হাজার হাজার শরণার্থী ভারতে যাওয়ার জন্য ঝাউডাঙ্গা উপকণ্ঠে ভারতের কাছাকাছি এসে পৌঁছায়। ২১ মে শরণার্থীরা যখন ঝাউডাঙ্গা বাজারের পূর্বপাশে পাথরঘাটা গ্রামের ওপর দিয়ে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক অতিক্রম করছিল, তখন যশোর থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দুটো ট্রাক সাতক্ষীরার দিকে যাচ্ছিল। পাকিস্তানী বাহিনীর গাড়ি দেখে শরণার্থীরা ভয়ে আশপাশের দোকানের ভেতরে বাজারের বিভিন্ন জায়গায় এবং ঝাউডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। ঝাউডাঙ্গা বাজার অতিক্রম করে ট্রাক দুটো বাজারের দক্ষিণ দিকে ছোট ব্রিজের উপরে থামে। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ‘ঝাউডাঙ্গা বাজারের পূর্বপাশে পাথরঘাটা গ্রামের মতিয়ার রহমান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চলন্ত ট্রাক ব্রিজের উপরে থামায়।’ মতিয়ার রহমান পাকিস্তানী সেনাদের বোঝায় যে, ‘এরা ভারতের দালাল। এদের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর লোক আছে এবং এরা অস্ত্র, প্রচুর টাকা-পয়সা ও সোনাদানা নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে।’ মতিয়ার রহমানের কথা শুনে পাকিস্তানী সেনারা রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে দ্রুত নেমে মহাসড়কের পশ্চিম দিকের মাঠের ভেতর দিয়ে দৌড়ে গোবিন্দকাঠি গ্রামের দিকে, ঝাউডাঙ্গা বাজারের আধা কি: মি: দূরে কালভার্টের উপরে গিয়ে অবস্থান নেয়। মহাসড়ক থেকে পাকিস্তানী সেনাদের আসতে দেখে শরণার্থীরা পালানোর চেষ্টা করে। বিলের মধ্যে ছোটাছুটি করা লোকজনদের পাকিস্তানী সেনারা ধরে এনে কালভার্টের ওপর একত্রিত করে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী দীপা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘খুলনা একাত্তর : আমার মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সামনে এগিয়ে যাওয়া মানুষের সারি হানাদারদের ছুটে আসতে দেখে ছত্রভঙ্গ হয়ে রাস্তা থেকে নেমে দু’পাশে বিলের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়। ততক্ষণে রাস্তার ওপর ট্রাইপডে মেশিনগান বসানো হয়েছে। পাকিস্তানী সেনারা বিলে নেমে যাওয়া মানুষদের ধরে ধরে রাস্তার ওপর জড়ো করছে। পাগলের মতো আমি চারদিকে তাকিয়ে খুঁজতে থাকি মা-বাবা আর ভাইদের। দোকানের পেছনে আড়াল খুঁজে যখন আমি দাঁড়িয়েছিলাম তখন ওরা সামনে এগিয়ে গেছে। মেশিনগানের গুলির শব্দ কানে আসছে। হঠাৎ দেখি মা আর বাবা সামনে এগোতে না পেরে উন্মুক্ত বিলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে লুকোবার কোন জায়গা নেই। অনেক দূরে পাটগাছের ঝোপ দেখা যাচ্ছে। হানাদারদের থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে আমরা, ওরা আমাদের দিকে পিছন ফিরে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে একনাগাড়ে, গুলিবিদ্ধ প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ছে রাস্তার ওপর, রাস্তা থেকে বিলের মধ্যে, পিছনে মাত্র কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছি।’ অন্যদিকে সেনাবাহিনীর গাড়ি চলে গেছে ভেবে গোবিন্দকাঠির রাস্তা ধরে শরণার্থীরা এগোতে থাকে। কিছুদূর গিয়ে তারা দেখতে পারে পাকিস্তানী বাহিনী মানুষদের ব্রাশফায়ার করছে। ভয় পেয়ে সবাই রাস্তার পাশে ছোট ছোট গর্তের রাস্তার আড়ালে শুয়ে পড়ে। দিনের বেলা ফাঁকা বিলের মধ্যে, রাস্তার পাশে, রাস্তার উপরে, ছোট কোন গাছের আড়ালে থাকা মানুষদের হত্যা করতে পাকিস্তানী সেনাদের তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। পাকিস্তানী সেনারা ঐদিন তরুণ ও যুবক পুরুষদের বেশি হত্যা করে। অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তানী সেনারা প্রায় তিন শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শী জ্ঞানদানন্দ বিশ^াস বলেন, ‘মাত্র কয়েকঘণ্টার মধ্যে ৫-৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য শত শত মানুষকে হত্যা করেছিল। প্রথমে তারা মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করেছিল। তারপর তারা রাস্তার দু’পাশের ঢালুতে আত্মরক্ষার জন্য শুয়ে থাকা মানুষদের এক এক করে গুলি করে হত্যা করে। আনুমানিক মিনিট বিশেক পর পাকিস্তানী বাহিনী স্থানটি ত্যাগ করে দ্রুত চলে যায়।’ এই গণহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত রয়েছে ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর ট্রাস্ট প্রকাশিত শংকর মল্লিকের গবেষণা গ্রন্থ ‘ঝাউডাঙ্গা গণহত্যা’ নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালায়। প্রকাশকাল ভাদ্র ১৪২৪/ সেপ্টম্বর ২০১৭। এই গ্রন্থমালার সম্পাদক ‘মুনতাসীর মামুন’ ও সহযোগী সম্পাদক ‘মামুন সিদ্দিকী’। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের গণহত্যা নিয়ে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর ট্রাস্ট’ ৭০টি নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালা প্রকাশ করেছে। লেখক : কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা
×