ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৯:১০, ১৮ মার্চ ২০১৯

বাংলার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

॥ তিন ॥ (ইতিপূর্বে একই শিরোনামে এই নিবন্ধটির আরও দুটি কিস্তি ছাপা হয়েছে। সেই কিস্তি দুটিতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে। এটি এই নিবন্ধের শেষ কিস্তি) বাংলাদেশের শিক্ষার বাহন বাংলা। কিছুসংখ্যক ইংরেজী মাধ্যম ও ইংরেজী সংস্করণ স্কুল ছাড়া দেশের সকল ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলায় অন্তত উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করে। আমি অবাক হয়েছি এটি দেখে যে, এমনকি বিদেশীরা পর্যন্ত এখন বাংলা ভাষা ব্যাপকভাবে শিখছে এবং চর্চা করছে। তাদের আগ্রহ আমাদের অভিভূত করার মতো। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর মনসুর মুসা মনে করেন যে, এটি আরও বাড়বে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে বিদেশীরা আরও ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষা শিখবে। আমি ৎসুয়সি নারা নামক একজন জাপানী প-িত, যিনি জাপানের প্রফেসর ইমেরিটাস, তাকে বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপির ওপর গবেষণা করতে বাংলাদেশ সফরে আসতে দেখে স্তম্ভিত হয়েছি। ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি পুরো দেশ সফর করে গেছেন। পুঁথি এবং পা-ুলিপি ঘেঁটে তিনি খুঁজে দেখছেন, বাংলা লিপির ভিন্ন রূপগুলো কেমন করে তৈরি হলো। ২০১৯ সালের বইমেলায় ওয়াতানাবি নামক একজন জাপানী বাংলা ভাষায় লেখা বই প্রকাশ করেছেন। বাংলা ভাষার প্রতি এই আগ্রহের অন্যতম কারণ হলো যেÑ তিনি মনে করেন, বাংলা বিশ্বের কেবল যে চতুর্থ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষা, তাই নয়, এটির ভবিষ্যত অত্যন্ত উজ্জ্বল। অন্যদিকে বাংলা ভাষায় এখন বিপুলসংখ্যক দেশী-বিদেশী টিভি চ্যানেল অবিরাম বাঙালীর ভাষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি, সরকার, জনগণ ও জনপদের উপর অনুষ্ঠান প্রচার করছে। বাংলাদেশের বাংলা চ্যানেলের সংখ্যা অনেক। ভারতেও দূরদর্শন ছাড়াও আলফা, একুশে, তারা, স্টার ইত্যাদি বেশ কয়েকটি বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেল জনপ্রিয়তার সঙ্গে তাদের সম্প্রচার অব্যাহত রাখছে। এমনকি আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্যেও বাংলা টিভি এবং রেডিও খুবই জনপ্রিয়। সার্বিকভাবে যদি আমরা হিন্দী বা অন্য কোন ভারতীয় ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার তুলনা করি, তবে বাংলা ভাষাকে ছোট করে দেখার মতো অবস্থা মোটেই নেই। বাংলা সিনেমার হয়ত সেই সোনালি দিন নেই। সেই অর্থে ইংরেজী আর হিন্দী ছাড়া অন্য কোন ভাষার চলচ্চিত্রই এখন আর আগের মতো চলতে পারছে না। কিন্তু অনলাইন মিডিয়া যেমন ইউটিউব এবং টিভি মিডিয়া সিনেমার সেই শূন্যতাকে ব্যাপকভাবে পূরণ করছে। এই নিবন্ধের শুরুতে আমরা বাংলা ভাষা ও লিপির সাফল্য এবং সম্ভাবনার কথা বলেছি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, বাংলা ভাষার কোন সমস্যা নেই। এই বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর সব মাতৃভাষাকেই ইংরেজীর মতো দানবের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। বিশে^র ৭২টি দেশের রাষ্ট্রভাষার এই দাপটকে ছোট করে দেখার নয়। ইংরেজীর ব্যবহারিক প্রয়োগ, এর জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা হওয়ার যোগ্যতা, বাণিজ্যিক ভাষা হিসেবে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং কম্পিউটারের ভাষা হওয়ার যে দক্ষতা এর রয়েছে, ফলে বিশ্বের অন্য সব ভাষা থেকেই ইংরেজী এগিয়ে আছে। তাতেও আমি আশা করি, আমাদের পাঠকরা জানেন যে, ইংরেজী পৃথিবীর এক নম্বর মাতৃভাষা নয়। এই ক্যাটেগরিতে প্রথমে রয়েছে চীনা ভাষা। এরপর ইংরেজী। তবে আমরা যদি ডিজিটাল যুগের কথা বলি তবে এই কথাটিও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে যে, এই জগতে কোন্ ভাষার ব্যবহার কেমন? ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত ইন্টারনেটে ইংরেজীর ব্যবহার সর্বোচ্চ ছিল। এই হিসাবে বিশ্বের ৫৩.৬৬ কোটি লোক ইংরেজী ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহার করত। অন্যদিকে বিশ্বের প্রায় ৪৪.৪৯ কোটি লোক ইন্টারনেটে চীনা ভাষা ব্যবহার করত। তার মানে মাতৃভাষার নেতৃত্ব চীনা ভাষা তখন ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু ২০০০ থেকে ২০১১ সালের হিসাব দেখলে বোঝা যাবে যে, চীনা ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর পরিমাণ বেড়েছে শতকরা ১৪৭৯ ভাগ। অন্যদিকে ইংরেজী ভাষার ব্যবহারকারীর পরিমাণ বেড়েছে শতকরা মাত্র ৩০১ ভাগ। বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২০০৮ সালে যেখানে ৮ লাখ ছিল সেটি ২০১৮ সালে ৯ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। ফলে ধারণা করা যায়, ইন্টারনেটে ইংরেজী ব্যবহারকারীর একচ্ছত্র দাপট আর খুব বেশিদিন থাকবে না। ফলে এক সময়ে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বাংলা ভাষা এখন ইন্টারনেটেরও একটি বহুল ব্যবহৃত ভাষা। ইংরেজীর ডিজিটাল ভবিষ্যত বিবিসির খবরে পেয়েছি আমি। বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, ‘ইংরেজী হলো বিশ্বের ফেভারিট লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা-অর্থাৎ যখন দুই দেশের দুই ভাষার মানুষকে এর ওপর নির্ভর করতে হয়। যেমন কোন চীনা নাগরিক একজন ফরাসী নাগরিকের সঙ্গে আলাপে দুজনই তাদের ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতে না পেরে তখন নির্ভর করেন ইংরেজী ভাষার ওপরই। বছর পাঁচেক আগেও সম্ভবত সেটাই ঘটত। কিন্তু এখন আর নয়। সেজন্য ধন্যবাদ দিতে হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যান্ত্রিক অনুবাদ এবং কণ্ঠ শনাক্তকরণ প্রযুক্তিকে। এর ফলে এখন দুই দেশের দুজন নাগরিক নিজ নিজ দেশের ভাষাতেই কথা বলতে পারছেন এবং একে অন্যের সংলাপ মেশিনের অনুবাদের মাধ্যমে শুনতে পারছেন। সুতরাং বিশ্বের শীর্ষ ভাষা হিসেবে ইংরেজীর দিন সম্ভবত ফুরিয়ে এসেছে। আমাদের বহমান আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো বাংলা ভাষাটি ডিজিটাল যুগে কেমন আছে সেটি অবলোকন করা। যদি ইন্টারনেট বা কম্পিউটারে বাংলার ব্যবহারের কথা বিবেচনা করি, তবে এ কথা বলতেই হবে যে, আগের যে অবস্থা ছিল এখন তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এক সময়ে কম্পিউটারে বাংলা মানে ছিল অফিস আদালতে চিঠি লেখা এবং প্রকাশনার কাজ করা। এখন বিপুলসংখ্যক ওয়েবসাইট বাংলায় তৈরি হচ্ছে। বাংলায় ওয়েবসাইট তৈরির সীমাবদ্ধতাও দূর হয়েছে। এমনকি আমাদের আসকি এনকোডিং সম্বলিত বিজয় সিস্টেমের সুতন্বিএমজে ফন্ট দিয়ে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে ইন্টারনেটে। ইউনিকোড মানকে সরকারীভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অপারেটিং সিস্টেম এবং ওয়েব ব্রাউজারগুলোর সবক’টি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সবক’টি ইন্টারনেটে বাংলা ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এখন এমন কোন ওএস ডিজিটাল যন্ত্র বা ব্রাউজার নেই যেটি ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা বা আসকি কোড সমর্থন করে না। সবাই কয়েক বছর আগেও তাদের ওয়েবসাইটে কেবলি ইংরেজী ভাষার কথা ভাবত। কিন্তু এখন সম্ভবত সকলেরই চৈতন্যোদয় হয়েছে এবং বাংলায় ইন্টারনেট প্রকাশনা ক্রমশ নতুন মাত্রা পাচ্ছে। এমনকি বিবিসির মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান এখন বাংলা ভাষায় ওয়েবসাইট প্রকাশ করেছে। ইন্টারনেটে বাংলার ব্যবহারও ব্যাপকভাবে বাড়ছে। দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি বাংলায় ডমেইন নেম লেখার সুযোগ তৈরি হওয়ার ফলে এর ব্যবহার আরও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ই-মেইলে, ফেসবুকে, ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজিং বা চ্যাটে চমৎকারভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলা। ওয়াজেদ হীরার প্রতিবেদনে বেসিসের সাবেক সভাপতি মাহবুব জামানের একটি উদ্ধৃতি আছে। তিনি বলেন, প্রযুক্তির কারণে বাংলার আরও সম্প্রসারণ হয়েছে বলে মনে করি। এখন অনেকেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্য ভাষা থেকে বাংলা ট্রান্সলেট করছে এটা প্রযুক্তির অবদান। তবে বিষয়টি নিয়ে কিছু কাজ করলে বাংলা আরও এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের ওসিআর অর্থাৎ অপটিক্যাল কারেক্টার বিষয়টি নিয়ে কাজ করা উচিত। কেননা ইংরেজীতে শব্দ লিখতে অটোমেটিক সংশোধন হয় আর বাংলার ক্ষেত্রে হয় না তাই এ বিষয়ে ভাল করে কাজ করা উচিত। যদিও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে বলে জানান তিনি। তার মতে, কাজ করা উচিত ‘স্পিচ টু টেক্সট’ নিয়ে। এতে বলার সঙ্গে সঙ্গে লেখা হয়ে যাবে। এটা অনেক ক্ষেত্রেই ইংরেজীতে করা যায়। তিনি মনে করেন, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং করা যেতে পারে যার মাধ্যমে মানুষের কিছু কাজ কমান্ডের সাহায্যে মেশিন করতে পারবে। এসব বিষয় নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা হচ্ছে তা মানুষের সামনে আনা উচিত বলেও জানান তিনি। আমি নিজে মনে করি প্রযুক্তি এমন জিনিস যা আয়ত্ত না করা গেলে বিপত্তি ঘটে। আমরা বাংলার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিতে পিছিয়ে ছিলাম। ১৪৫৪ সালে আবিষ্কৃত মুদ্রণ যন্ত্র দিয়ে আমরা ১৭৭৮ সালে বাংলা বই ছেপেছি। তবে এখন আর আমরা সেই পশ্চাৎপদতায় নেই। ৮৭ সালে আমি যে প্রযুক্তি দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করি সেটি তখন সারা দুনিয়ায় সদ্যপ্রাপ্ত প্রযুক্তি। ৮৮ সালে আমি বাংলার যে কীবোর্ড নকশা করি তা বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম প্রযুক্তিনির্ভর ছিল। দেরিতে হলেও আমরা বাংলা ভাষার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কাজ করছি। বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান গুগল বা ফেসবুক বাংলা নিয়ে কাজ করছে। বাংলা বিশ্ব এনকোডিং কনসোর্টিয়াম ইউনিকোডের মানভুক্ত হয়েছে। আমরা নিজের দেশেও বাংলা কোড ও কীবোর্ডকে প্রমিত করেছি। এখন চলমান আছে সরকারের ১৫৯ কোটি টাকার প্রকল্প। এই প্রকল্পটি দিয়ে বাংলা ভাষার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রায় সকল কাজই করা হচ্ছে। ওসিআর, টেক্সট টু স্পিচ, স্পিচ টু টেক্সট, বাংলা ইশারা ভাষা, বাংলা স্ক্রিন রিডার, মেশিন ট্রান্সলেশন, করপাস, বানান ও ব্যাকরণ শুদ্ধিকরণসহ এমনকি আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা করার জন্যও আমরা কাজ করছি। আমি মনে করি, সামনের পাঁচটি বছর বাংলা ভাষার সোনালি দিনের জন্য যথেষ্ট হবে। (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ঢাকা থেকে বার্সিলোনা যাবার জন্য আকাশভ্রমণের সময় লেখা। ১৬ মার্চ ১৯ সম্পাদিত) ঢাকা, ১৬ মার্চ ২০১৯ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সম্পাদক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক
×