ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ১৯ মার্চ ২০১৯

ঢাকার দিনরাত

পাঠক জানেন, এ কলাম লেখার নির্ধারিত দিন রবিবার। এ সপ্তাহের রবিবারটি ছিল অন্যরকম। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসই যদি ছুটির দিন হয় তাহলে সেটি কর্মব্যস্ত মানুষের জন্য বিশেষ হয়ে ওঠে। আমরা সংবাদপত্রের লোকেরা তেমন ছুটিটুটি পাই না। জনকণ্ঠ ভবনে পত্রিকা ছাড়াও মালিক পক্ষের অন্য অফিস রয়েছে। তারা যথারীতি ছুটি উপভোগ করছে। আমরা মানে সারা দেশেরই সাংবাদিকরা কাজ করছি। সকালে অফিসে আসতে আসতে মহাব্যস্ত ঢাকাকে মনে হলো কিছুটা অবকাশে রয়েছে। তবে এটা তো নিশ্চয়ই আমাদের জানা যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শুভ জন্মদিনটিও এবার বিশেষ, মানে ১০০তম জন্মদিন। ফলে রবিবার এই বিশেষ দিবসে ঢাকায় অনেক আয়োজন হচ্ছে। দিনটিকে শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করায় শিশুদের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ উল্লাস লক্ষ্য করে থাকি ফিবছর। শিশুদের কবিতা আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ছিল এ দিনের বাঁধাধরা বিষয়। এ বছর দেখলাম এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু আয়োজন। গল্প বলা, উপস্থিত বক্তৃতা দেয়া, বিতর্ক করা, চিত্রনাট্য অনুযায়ী নৃত্যানুষ্ঠান করা- সব মিলিয়ে বিচিত্র আয়োজন। হঠাৎ অনলাইনে একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল। ভারি মিষ্টি ছবি। এক ঝাঁক শিশু সাদা-পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছে, সঙ্গে রয়েছে মুজিব কোট। এই বিশেষ পোশাকটি যে শিশুদেরও এত মানায়, সেটি আগে বুঝতে পারিনি। যা হোক, অফিসে এসে লেখা শুরুর আগে অনলাইন বার্তামাধ্যম এবং খবরের কাগজের ফাইলে চোখ বুলোনো আমাদের বহুকালের পেশাগত অভ্যেস। এমন একটি দিনের শুরুতেই দুঃসংবাদ দেখলে খারাপই লাগে। আমরা বড় বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছি। আমাদের মোবাইল ফোনেও নতুন নতুন খবর, বলা ভাল খারাপ খবর প্রবেশ করতে থাকে। যত ভাবি দেখব না, তা কী আর হয়। দেখতেই হয়। তবে শিরোনাম দেখে মনটাকে সরিয়ে ফেলতে পারলে ভাল। বুদ্ধিমানেরা তাই করেন সময় বাঁচাতে। তবে কোন কোন খবর এমনই থাকে, আর তার শিরোনামও এমনভাবে দেয়া হয় যে কৌতূহল জাগে পুরো খবরটি পড়তে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রীনিবাসের ট্রাঙ্ক থেকে নবজাতককে মৃত অবস্থায় বের করা হয়েছে- এমন খবর আমাদের মনুষ্যত্ববোধের তন্ত্রীতে নেতিবাচক এবং ক্ষোভ ও হতাশার নিঃশব্দ গর্জন তোলে। এই কলামেই দুয়েকবার লিখেছি নর্দমা থেকে সদ্য জন্মগ্রহণকারী শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার নিয়ে ক্রোধ ও বিষণ্ণতায় ভরা কথামালা। প্রতিটি নতুন শিশুর জন্মগ্রহণের নেপথ্যে রয়েছে এক জোড়া মানব-মানবী। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, তারা জনক-জননী। অথচ তাদের অনেকেই তাদের সন্তানের জন্মক্ষণেই পরিত্যাগ করেন, তার মৃত্যুই চান! নিজেদের রক্ষার জন্য নিজ সন্তানের মৃত্যু! কিসের রক্ষা? লোকলজ্জার ভয় থেকে? এই পৃথিবীতে যত প্রজাতির প্রাণী রয়েছে সে সবের মধ্যে একমাত্র মানুষের পক্ষেই সম্ভব সদ্যজাত সন্তানকে মৃত্যুপুরীতে নিক্ষেপ করা। একটি হায়েনা কিংবা একটি কুকুর বা কোন শকুন কি কখনও তার সদ্য জন্মগ্রহণকারী শাবকটিকে ছুড়ে ফেলে! ঢাকায় নর্দমায় বা গোরস্তানে নবজাতককে ফেলে দেয়ার বিষয়টিকে আমরা উপেক্ষা করে যেতে পারি না। এটি স্বার্থপর মানুষের এক অজ্ঞাত মানসিক অবস্থা, তার চূড়ান্ত বিকার। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে! যে নগরে বা যে সমাজে মানুষ তার সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে অস্বীকার ও নোংরা ন্যাকড়ার মতো পরিত্যাগ করতে পারছে, ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করছে- সেই নগর বা সমাজেরও কি কোন দায়ভাগ নেই এতে? কালক্রমে সদ্যমৃতের তালিকায় উঠে যাচ্ছে মানুষের বিবেক, তার মনুষ্যত্ব। চৈত্রের দিনলিপি প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি বোধহয়। বলছিলাম আমাদের সংবাদকর্মীদের দিনানুদৈনিক অভ্যেসের কথা। নিত্যনতুন সংবাদকে গ্রহণ ও হজম করার কথা। কলাম লেখার শুরুতেই যদি ঢাকায় কোন আগুন লাগার কোন খবর শুনি তাহলে নড়েচড়েই বসতে হয়। রাজধানীর মহাখালীর একটি বাসায় জমে থাকা গ্যাস লিকেজ থেকে আগুনে নারীসহ ৩ জন দগ্ধ হয়েছেন। রবিবার সকাল ৮টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। খবর পড়ে জানা গেল, দগ্ধ অবস্থায় তারা নিজেরাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আসেন। পরে তাদের বার্ন ইউনিটে ভর্তি রাখা হয়। অগ্নিকা-ের শিকার একজনের বক্তব্য : সকাল ৮টার দিকে কাজের বুয়া আসেন বাসায়। এ সময় দরজা খুলে দিয়ে সিগারেট জ্বালানোর জন্য ম্যাচ জ্বালান তিনি। এর সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে তিনিসহ, পাশের রুমে ঘুমিয়ে থাকা শিশু ও রান্নাঘরে থাকা গৃহকর্মীও দগ্ধ হন। চৈত্র মাস এসে গেছে। বসন্ত ফুড়ুত করে কখন যে চলে গেল, যদিও পঞ্জিকামতে পুরো চৈত্র মাসই বসন্তকাল থাকবে। নিশ্চয়ই থাকবে, কিন্তু আমরা নগরবাসীরা তা টের পাব না। ঢাকায় এখন বেশ গরম, রোদে দারুণ তেজ। তার ওপর ধুলাবালিতে সব সয়লাব। গত সপ্তাহেই ঢাকার বিষাক্ত বাতাস নিয়ে লিখেছি। তাই এখন আবারও বিষয়টি টেনে নিয়ে এলে আপনারাই বিরক্ত হবেন। কিন্তু আমরা ঢাকাবাসীরা হাড়ে হাড়ে প্রতিদিন প্রতিবেলা বুঝছি পরিবেশের কোন স্তরে আমরা বসবাস করছি। এত ধুলা নিয়ে বিশ্বের আর কোন দেশের কোন শহরের মানুষ বাস করে? নতুন যে তথ্য পেলাম তা লুকনোর কিছু নেই। সংবাদপত্র সব ফাঁস করে দিচ্ছে; জানাচ্ছে : গত বছর ১৯৭ দিন রাজধানীবাসী দূষিত বাতাসে ডুবেছিল। আগের বছরগুলোতে রাজধানীর বাতাস বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১২০ থেকে ১৬০ দিন দূষিত থাকত। অর্থাৎ ঢাকার বায়ুদূষণ সময়ের বিবেচনায়ও বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। পরিবেশ অধিদফতরের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের উপাত্ত বিশেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। পরিবেশ অধিদফতর বলছে, রাজধানীর বাতাসে দ্রত দূষণকারী পদার্থ ছড়িয়ে পড়ছে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাজের কারণে। আর দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই সরকারী। পরিবেশ অধিদফতর এদের কয়েকবার চিঠি দিয়ে দায় সেরেছে। কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। নারীর কাছে প্রত্যাশা ঢাকার পথেঘাটে আগের তুলনায় বেশি সংখ্যক নারী দেখা যায় যারা ব্যক্তিগত গাড়ি চালাচ্ছেন। মোটরসাইকেল চালক নারীর সংখ্যা অবশ্য তেমন বাড়েনি। নারীর জন্য রাজধানীতে আর আলাদা পেশা বলে কিছু নেই। সব পেশাতেই নারী তাদের কর্মদক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ সুন্দরভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। সেদিন একটা দৃশ্য চোখে পড়ল যা আগে কালেভদ্রে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কিছু জনবিরল অংশে দেখা যেত। সেটি হলো তরুণীদের ধূমপান। ধূমপান অবশ্যই একটি মন্দ অভ্যাস। তবে পুরুষদের বেলায় এখনও এটিকে ‘ম্যানলি’ হিসেবে দেখার প্রবণতা রয়েছে। অথচ একই কাজ মেয়েরা করলে তাকে নিন্দামন্দ করার লোকের অভাব নেই। এখন অনেক তরুণী প্রকাশ্যেই ধূমপান করছেন তাদের পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে। আগে এটা আড়ালে আবডালে চলত। তার মানে হচ্ছে আজকের তরুণী ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এমন মানসিকতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি পুরুষ যা করছে সে সব কাজ করাকে নিজের অধিকার বলেও ভাবছেন। ধূমপানের বেলায় নয়, সর্বক্ষেত্রেই যদি এটা তারা ভাবেন এবং প্রথা ভাঙতে সমর্থ হন তা হলে এক ধাক্কায় নারী অনেকটা এগিয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। অনেক পরিবারে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা একটু রাত করে ঘরে ফিরলে সেটা স্বাভাবিকভাবেই দেখা হচ্ছে। ঢাকায় ইভটিজিং বহুলাংশে কমেছে। পথে-ঘাটে নারীর চলাচল শতভাগ নিরাপদ হয়েছে এমন দাবি করব না, তবে অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। এরা নাকি নাগরিক! এএইচ চঞ্চল নামে একজন ফেসবুকে যা লিখেছেন তার সঙ্গে আমার আপনার অভিজ্ঞতা মিলে যাবে। সেদিন মধ্যরাতেও যখন আমাদের পাড়ার এক বিয়েবাড়ির উচ্চৈঃস্বরে গান বাজানো থামল না তখন গরমের ভেতর সব জানালার কাচ বন্ধ করতে বাধ্য হলাম। মানুষ তার রুচি অনুযায়ী গান শুনবে, তাতে বলার কিছু নেই। আমরা অপসংস্কৃতি বলে চেঁচালেও তার হুঁশ ফিরবে না। কিন্তু আনন্দ উৎসবের নামে অশ্রাব্য ‘গান’ অতি উচ্চমাত্রার শব্দে পুরো পাড়াকে রাত বারোটার পরেও শোনানোর মধ্যে কী মানসিকতা থাকতে পারে। অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষ থাকাটাই স্বাভাবিক একটি পাড়ায়। তাদের কথা বিবেচনা করা হবে না! উচ্চ শব্দে যেনতেন উপায়ে বানানো বহুতল ভবনেরও যে কাঁপুনি উঠে যায়, কাঠের দরোজাও কাঁপতে থাকে- সেটি হৈহল্লাকারীরা কবে বুঝবে? যা হোক, ওই ফেসবুকারের কথায় ফিরি। ভদ্রলোক রসিয়ে লিখেছেন বেশ। লিখেছেন, ‘ব্যাপক ভলিউমে ডিজে মিউজিক বাজছে, রাতের নীরবতার মাঝে দানবীয় হুঙ্কারের মতো তা বেজেই চলেছে। নিশ্চয় কারও বিয়ে বা ওই জাতীয় কোন উৎসব হচ্ছে। উৎসব উৎসের খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমার বাসা থেকে তা অন্তত আধা কিলমিটার দূরে। গ্রাম হওয়াতে তা অনেক নিকটেই বোধ হচ্ছে। ডিজে মিউজিকের আশপাশের বাসিন্দারা যারা এই উৎসবে নাই তাদের দশার কথা চিন্তা করে আমার কলিজা শুকিয়ে গেল। এই গ্রামই কেবল না, প্রায় পুরা কেরানীগঞ্জে প্রতি বৃহস্পতি শুক্রবারই আছে নানা আয়োজন। বিয়ে, জন্মদিন, মুসলমানি আরও কত কী। হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই তিন ঋতুতে প্রায় প্রতি বৃহস্পতি আর শুক্রবারে প্রায় ইউনিয়নজুড়ে মাইকের ব্যবস্থা থাকে। সমস্ত মাইক মিলে সে এক ভয়ানক শব্দ দূষণ হয়। আমি নিজে ২ কিলোমিটার অবধি অঞ্চল ঘুরে দেখেছি, সমস্ত মাইকের ইকোর কারণে আদতে কোন কথাই পরিষ্কার শোনা যায় না। ভয়ঙ্কর শব্দ দূষণ ছাড়া আমার কাছে এর কোন বাণীই এসে পৌঁছায় না। ডিজে মিউজিক চলে প্রায় সারা রাত। যে বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে তার পাশেই তো কারও বাড়িতে আছে শোক, থাকতে পারে মনোযোগী কোন শিক্ষার্থীর পরীক্ষা। আর পরিশ্রান্ত নাগরিকের রাতের ঘুম। ঈদ, পূজা আর জাতীয় উৎসবের দিনগুলোও একই শব্দ দূষণে এই অঞ্চলে থাকাই মুশকিল হয়ে ওঠে। আমাদের মতো ঘন বসতিপূর্ণ দেশে আদতে উৎসব বা অনুষ্ঠানে শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। লাউড স্পিকার ও অনুষ্ঠানস্থল নিয়েও ভাবার আছে। জনপদের মধ্যে তার কি ব্যবস্থা হবে তাও চিন্তার বিষয়। ঢাকা শহরের গাড়ির হর্নেরও একই অবস্থা। এত এত নয়েজের দরুন হয়ত আমরা গভীর সুরের শ্রোতাই হতে পারছি না, পাচ্ছি না মহান কোন সুরকারও। পোস্টটি লেখার পরে অতিরিক্ত নয়েজ, সাউন্ড পলুশন আমাদের কি কি ক্ষতি করে তা জানতে গুগলিং করে পিলে চমকে গেল। গর্ভবতী মা ও শিশুর যেমন মারাত্মক সমস্যা এতে, তেমনি, হার্ট, লিভার, ব্রেন, কান, মানসিক অবস্থার উপরে এর মারাত্মক ক্ষতি হয়ে আনতে পারে। এ বিষয়ে দ্রুতই সচেতনতা তৈরি করা দরকার।’ ১৭ মার্চ ২০১৯ [email protected]
×