ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আটক জঙ্গী রিপনের স্বীকারোক্তি

হলি আর্টিজান জঙ্গীদের ছিনিয়ে নেয়ার ছক ছিল জেএমবির

প্রকাশিত: ১১:৩৫, ১৯ মার্চ ২০১৯

হলি আর্টিজান জঙ্গীদের ছিনিয়ে নেয়ার ছক ছিল জেএমবির

শংকর কুমার দে ॥ গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলা-মামলার আসামিদের আদালতে আনা-নেয়ার সময়ে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবি। ২০১৪ সালে প্রিজনভ্যানে হামলা করে তিন জঙ্গী ছিনিয়ে নিয়েছিল জেএমবির জঙ্গীরা। ঠিক একই কায়দায় গুলশান হলি আর্টিজানের জঙ্গীদের আদালতে আনা-নেয়ার সময়ে ছিনতাইয়ের যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা ভ-ুল করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী এক জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে তদন্তকারীরা। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান মামলার আসামি মামুনুর রশিদ রিপন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালের জঙ্গী ছিনতাইয়ের ঘটনার মতো গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলা-মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামিদের কারাগার থেকে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা ছিল জঙ্গী সংগঠন জেএমবির। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যানুযায়ী ময়মনসিংহের ত্রিশালের মতো আরেকটি ঘটনা ঘটিয়ে জঙ্গীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিল জঙ্গী সংগঠনটি। মূলত গুলশান হলি আর্টিজান হামলা-মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামিদের ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা ছিল তাদের। রিপন নামের যেই জঙ্গী এই ধরনের জবানবন্দী দিয়েছে সে জেএমবির আমির আব্দুর রহমানের মেয়ের জামাই আওয়ালের ভাগ্নে। এ জন্য রিপনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে জঙ্গী সংগঠনটিতে। রিপনের গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়। সে ঢাকার মিরপুর, বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও নওগাঁর বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে। ২০০৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাদ্রাসাতুল দারুল হাদিস থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করে সে। এরপর বগুড়ার একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চাকরি নেয়। ২০১৩ সালে ডাঃ নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে জেএমবির শীর্ষ ও নেতৃত্ব প্রদানকারীদের অন্যতম এবং একাংশের আমির। জেএমবির এই অংশের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে রিপন। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে তিন জঙ্গীকে ময়মনসিংহ আদালতে অন্য মামলায় হাজিরা দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়ার পথে ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় গুলি ও বোমা ফাটিয়ে তিন জঙ্গীকে ছিনিয়ে নেয় হামলাকারী জঙ্গীরা। তিন জঙ্গীর মধ্যে ছিলেন মৃত্যুদ-াদেশ পাওয়া রাকিব হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাসেল, সালাউদ্দিন সালেহীন ও যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ পাওয়া বোমারু মিজান। ঘটনার দিন বিকেলে টাঙ্গাইলের সখীপুরে পুলিশের চৌকিতে ধরা পড়ে রাকিব হাসান। রাতে তাকে নিয়ে পুলিশ অভিযানে বের হলে বন্দুকযুদ্ধে রাকিব নিহত হয়। ওই জঙ্গী ছিনতাই করার জন্য জঙ্গীরা যে হামলা করে তাতে প্রিজনভ্যানে কর্তব্যরত পুলিশ নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটায় জঙ্গীরা। একই কায়দায় গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী ও গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের আদালতে আনা-নেয়ার সময়ে ছিনতাই করার পরিকল্পনা করেছিল নব্য জেএমবির জঙ্গীরা। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত জঙ্গী রিপন জানিয়েছে বিকাশের দোকান লুট করে ৬ লাখ টাকা, সিগারেটের দোকান লুট করে ১ লাখ এবং গাইবান্ধা থেকে এক লাখ টাকাসহ মোট আট লাখ টাকা জেএমবির আমির সারোয়ার জাহানের কাছে পৌঁছে দেয় সে। সারোয়ার জাহানের মাধ্যমে জঙ্গী আব্দুল্লাহার সঙ্গেও পরিচয় হয় তার। পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গী নেতা তামিম চৌধুরীর সঙ্গে সারোয়ার জাহানের একটি বৈঠকে সমঝোতা স্মারক প্রস্তুত করা হয়েছিল। ওই সমঝোতার ভিত্তিতে সারোয়ার জাহানকে আমির নির্বাচিত করা হয়। তার সাংগঠনিক নাম দেয়া হয় শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। ওই বৈঠকে জেএমবি সদস্য সাদ্দাম ওরফে কামাল, শরিফুল ওরফে রাহাত ও রিপনসহ আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিল। তার মধ্যে মামুনুর রশীদ রিপন শূরা সদস্য নির্বাচিত হয়। জেএমবিতে রিপনের দায়িত্ব ছিল অর্থ সংগ্রহ, সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও অস্ত্র সরবরাহ করা এবং জঙ্গীদের সঙ্গে তার ভাল যোগাযোগ ছিল। ২০১৬ সালের এপ্রিলে রিপনের নেতৃত্বে একটি জঙ্গী দল ভারত যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার। গুলশান হলি আর্টিজান হামলার আগে আনুমানিক ৩৯ লাখ টাকা সারোয়ার জাহানকে পাঠায় রিপন। সে হলি আর্টিজান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহের সঙ্গেও জড়িত ছিল। এছাড়াও উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল রিপন। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, গুলশান হলি আর্টিজান হামলার পর আইনশৃঙ্খল বাহিনীর অভিযানের জন্য ভারতে আত্মগোপনে চলে যায় রিপন। সে জেএমবিকে সুসংগঠিত করার চেষ্টা করে। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ফের বাংলাদেশে আসে। সম্প্রতি তারা ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা নিয়েছিল। গুলশান হলি আর্টিজান হামলার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার বিষয়ে ২০১৫ সালে গাইবান্ধায় মিটিং করে জঙ্গীরা। এরপর হলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনা করে। রিপন হামলার জন্য তিনটি একে টু, একটি পিস্তল সরবরাহ করেছিল। জঙ্গী মারজানের মাধ্যমে সরোয়ার জাহানকে এসব পাঠায় রিপন। গুলশান হলি আর্টিজান হামলার আগের দিন বারিধারায় মিটিং করেছিল জঙ্গীরা। এই দুর্ধর্ষ জঙ্গী সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে, সে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী ও পরিকল্পনাকারী গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের আদালতে আনা-নেয়ার সময় ত্রিশালে জঙ্গী ছিনতাইয়ের মতোই ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সে নিজেও পরিকল্পনাকারী জঙ্গীরা ধরা পড়ে যাওয়ায় গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের আদালতে আনা-নেয়ার সময়ে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনার ঘটনা ভেস্তে যায় বলে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের দাবি।
×