ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

সাত সতেরোর সন্ধিক্ষণে দুটি প্রস্তাবনা

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ২০ মার্চ ২০১৯

সাত সতেরোর সন্ধিক্ষণে দুটি প্রস্তাবনা

মার্চ মাসটা বোধ করি বাংলাদেশের জন্য ইংরেজী ক্যালেন্ডারের বারোটি মাসের মধ্যে সবচাইতে বেশি তাৎপর্য বহন করে। যে কোন জাতির ক্যালেন্ডারেই একাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা থাকে, যা উদ্যাপিত হয় জাতীয়ভাবে, অন্তর্ভুক্ত হয় রাষ্ট্রীয় ক্যালেন্ডারে। এই মার্চ মাসে আমাদেরও রয়েছে এরকম বেশকিছু জাতীয় দিবস। যেমন ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিন, জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস আর ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস, যেদিন জাতির পিতা ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আবার এই মার্চেই এমন কিছু দিন আছে যা রাষ্ট্রীয় ক্যালেন্ডারের সেই সংক্ষিপ্ত তালিকায় নেই। এসব দিনে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে না, রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপিতও হয় না দিনগুলো। সাধারণের গাড়িতে-বাড়িতে ওড়ে না রাষ্ট্রের পতাকাও। এ দিনগুলো বাঙালী স্মরণ করে প্রাণের তাগিদে। যেমন ৭ মার্চ, যেদিন ’৭১-এ তখনকার রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে ইউনেস্কো ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ৭ মার্চের ভাষণ আমার বিবেচনায় যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিটি এখনও পায়নি তা বোধ করি ‘বিশ্বের সর্বাধিক শ্রুত ভাষণ’ হিসেবে গিনেস বুকের অন্তর্ভুক্তি। আরও আছে ২৫ মার্চ, যে কালরাতে পাকিস্তান সূচনা করেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার, আমাদের দাবিতে যা আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস। এই মার্চে বাংলাদেশ দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার দ্বারপ্রান্তে। আগামী বছর আমরা উদ্যাপন করতে যাচ্ছি মুজিববর্ষ- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। তার পরের বছরই বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর, সুর্বণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুকে একে অপরের সমার্থক বলাটা বোধ করি বাড়াবাড়ি কোন বিষয় নয়। আর সে কারণেই বোধহয় বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুর এই দুটি মাইলফলক বাঙালীর কাছে একসঙ্গে এসে হাজির হয়েছে। আগামী দুটি বছর বাঙালী যখন প্রস্তুত হচ্ছে, পিতা আর মাতৃভূমির জন্মবার্ষিকীর উৎসব উদ্যাপনে, সেই প্রেক্ষাপটে এবারের মার্চ বহন করছে অন্যরকম তাৎপর্য। বাঙালী আর বাংলাদেশ ছাড়িয়ে ৭ মার্চের ভাষণ এখন সবার, সমগ্র মানবজাতির। কি প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চের ভাষণের এই কালজয়ী আবেদন তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়বস্তু। আমাদের ইতিহাসের দিকে পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায় গত হাজার বছরে খুব অল্প সময়ের জন্য এই ভূ-খ-টি বাঙালীর শাসনে ছিল। আমার জানায় ভুল না থাকলে এই ভূ-খ-ের সর্বশেষ বাঙালী শাসক ছিলেন পাল বংশীয় রাজারা। এরপর দফায় দফায় এদেশের শাসনক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। এখানকার ঔপনিবেশিক শাসকদের দীর্ঘ তালিকায় নাম লিখিয়েছেন ইউরোপীয়, আরবী, পারস্যের, এমনকি আফ্রিকার দাস বংশের শাসকরাও। ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে আমাদের যে অর্জিত জ্ঞান তা থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হিসেবে চিনতে শিখিয়েছে। অথচ এই সিরাজ বাঙালী বংশোদ্ভূত ছিলেন না। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের বিশাল বাহিনীর মুষ্টিমেয় ইংরেজ সেনার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন আশপাশের গ্রামগুলোর হাজারো বাসিন্দা। তারা সেদিন সিরাজের সমর্থনে এগিয়ে এলেও এই ভূ-খ-ের ইতিহাস অন্যভাবে লেখার প্রয়োজন পড়ত। আবার এই কদিন আগেও জোট সরকারের অন্ধকার সময়ে আমাদের শেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে খিলজী নামে জনৈক আরব সেনাপতি দেড় ডজন অশ্বারোহী নিয়ে নাকি বাঙালীকে স্বাধীন করেছিলেন। হাজার বছরের ঔপনিবেশিক শাসন, অনেক অপপ্রচার আর সবচেয়ে বড় কথা ৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত, মাঝে ৭২ থেকে ৭৫ আর ৯৬ থেকে ২০০১ এই কটি বছর বাদ দিয়ে, ক্রমাগত যে ইতিহাস বিকৃতি আর বিকৃত ইতিহাসের চর্চা তাতে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে অনেক। তার পরও এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বঙ্গবন্ধু শুধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীই নন, বরং হাজার বছরের মধ্যে তিনিই এই ভূ-খণ্ডের প্রথম বাঙালী শাসক। এই ভূ-খণ্ডটিকে আবারও স্বাধীন করে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘটনাটি আর দশটি দেশের স্বাধীনতার চেয়ে একেবারেই আলাদা, একদম স্বতন্ত্র। একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ম্যান্ডেট নিয়ে, একটি সাংবিধানিকভাবে বৈধ, কিন্তু সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অধুনা পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দেয়ায় বঙ্গবন্ধুর যে কৃতিত্ব তা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে এক এবং অদ্বিতীয়। কথায়-আলোচনায় নাম আসতে পারে আব্রাহাম লিংকন থেকে শুরু করে রুজভেল্ট, চার্চিল, দ্য গল, মহাত্মা গান্ধী, ফিডেল ক্যাস্ট্রো আর নেলসন ম্যান্ডেলারও। কিন্তু তাদের কারও ঝুলিতেই নেই এমন অসামান্য কৃতিত্ব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নয় মাসের ফ্রেমে বাঁধা যাদের স্বপ্ন তাদের বসবাস আসলে বোকার স্বর্গে। ‘হাত মে বিড়ি মুখ মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ কোন বিজাতীয় স্লোগান নয়। ওই স্লোগান মুখেই এই ভূ-খ-ের অধিবাসীরা একদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অবিভক্ত ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্মের পর বাঙালীর মোহভঙ্গ হতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি। এর প্রথম পাবলিক বহির্প্রকাশ যদি হয়ে থাকে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি, তবে তারও অনেক আগে এর ঘরোয়া বহির্প্রকাশ ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে, যেদিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুখের ওপর নো-নো বলে প্রতিবাদী হয়েছিলেন বাঙালী তরুণ ছাত্ররা। তারপর দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় একাত্তর। মাঝে ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, অসহযোগ আন্দোলন, আরও কত কি। এরই প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চ। একটি জাতি যখন একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত ঠিক তখনই সেদিনের রেসকোর্স ময়দানে লাখো বাঙালীর সামনে পরাধীন বাংলাদেশে তার শেষ জনসভায় উপস্থিত হন বঙ্গবন্ধু, রচিত হয় ৭ মার্চের মহাকাব্য। এই ভাষণের আগে আগে বঙ্গবন্ধু নানামুখী চাপের মধ্যে ছিলেন। চাপ যেমন ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার, তেমনি উল্টো চাপও ছিল প্রচ- রকমের পাকিস্তানী জান্তার দিক থেকে। সেদিন বঙ্গবন্ধু অসুস্থ ছিলেন। তিনি যখন ধানম-ি ৩২ নম্বর থেকে রেসকোর্সের উদ্দেশে রওয়ানা হন জ্বরে তখন তাঁর গা পুড়ে যাচ্ছিল। গাড়িতে ওঠার আগে আগে বঙ্গমাতা তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি নিজে যা ঠিক বলে বিশ্বাস করেন তাই যেন বক্তৃতায় তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এই অলিখিত, তাৎক্ষণিক ভাষণ শুধু কিছু রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্কলন নয়, বরং এটি ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেছিলেন। ব্যাখ্যা করেছিলেন ছাড় দিয়ে হলেও সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে তাঁর কতটা প্রয়াস ছিল। একই ভাষণে তিনি প্রতিরোধের ডাকও দিয়েছিলেন। বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন স্বাধীনতা আর মুক্তি সংগ্রামের সূচনার। নির্দেশ দিয়েছিলেন আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আর যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে। এই ভাষণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক এই যে, বঙ্গবন্ধু এই ভাষণে শুধু একটি স্বাধীন পতাকা আর নতুন মানচিত্রের নির্দেশনাই দেননি, বরং তাঁর নির্দেশ ছিল এমন একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার, যে বাংলাদেশ বাঙালীর রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতাও নিশ্চিত করবে। তাই তাঁর ঘোষণা ছিলÑ ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ’। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর ক্ষণস্থায়ী শাসনকালে বঙ্গবন্ধু সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছিলেন। আর এখন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছেন তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরও বৃহত্তর পরিসরে ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের শোষিত, পরাধীন মানুষের পূর্ণাঙ্গ মুক্তির নির্দেশনাও বটে। যে কারণে ৭ মার্চের ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি দিতে গিয়ে ইউনেস্কো বলেছে যে, এই ভাষণটির একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সার্বজনীনতা আর মানবিকতা। যে কোন নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এই ভাষণটি সব সময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী। ঠিক একই কারণে নিউজ উইক বঙ্গবন্ধুকে আখ্যায়িত করেছে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আর ৭ মার্চের ভাষণ স্থান পেয়েছে জ্যাকব ফিল্ডের বিশ্বসেরা ভাষণগুলোর সঙ্কলন গ্রন্থ ‘উই শ্যাল ফাইট অন দা বিচেস : দি স্পিচ দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টরি’-তে। আর ঠিক সেই একই কারণে নির্মলেন্দু গুণ যখন লেখেন ‘...গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তখন তিনি অমরত্বের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হন। বাঙালীকে জাতির পিতা দিয়েছেন অনেক, যার প্রতিদান দেয়ার দুঃসাহস এই জাতির নেই। আজ যখন আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের দ্বারপ্রান্তে তখন জাতির পিতার কাছে জাতির ঋণ একটু হলেও শোধ করার জন্য দুটি প্রস্তাবনা বিবেচনার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করি। ১. এখন পর্যন্ত জাতির পিতার কোন পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়নি। যতটুকু হয়েছে সে কাজটুকুও জাতির পিতা নিজেই করে গিয়েছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করে মুজিববর্ষে জাতির পিতার একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী প্রকাশ করা যেতে পারে। ২. বিশ্বের নিপীড়িত, শোষিত মানবতার মুক্তির জন্য যারা অবদান রেখে চলেছেন এমনি সব দেশী-বিদেশী বিশিষ্টজনকে স্বীকৃতি দেয়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুজিববর্ষে ‘বঙ্গবন্ধু পদক’ প্রবর্তন করা যেতে পারে। ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় এরই মধ্যে মহাত্মা গান্ধী ও নেলসন ম্যান্ডেলার নামে এ ধরনের পদক প্রবর্তিত হয়েছে। লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×