ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চালক আটক ॥ দিনভর বিক্ষোভ, অবরোধ ভাংচুর, আগুন

বেপরোয়া বাস আবার কেড়ে নিল এক ছাত্রের প্রাণ

প্রকাশিত: ১১:০৩, ২০ মার্চ ২০১৯

বেপরোয়া বাস আবার কেড়ে নিল এক ছাত্রের প্রাণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বেপরোয়া বাস চাপায় এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় উত্তাল কুড়িল, বাড্ডা, নর্দাসহ আশপাশের এলাকা। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে সাতটা থেকে শুরু করে ওই এলাকায় বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত টানা বিক্ষোভ চলে। শত শত শিক্ষার্থী সহপাঠীর মৃত্যুতে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে পুরো রাজধানী যানজটে একপ্রকার অচল হয়ে পড়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বিক্ষোভের সময় ছাত্রদের মধ্যে উপস্থিত হয়ে উত্তেজনা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। তিনি ঢাকায় সুশৃঙ্খলভাবে বাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলছেন। পাশাশাশি শিক্ষার্থীরা যাতে নিরাপদে রাস্তা পার হতে পারে, এজন্য প্রয়োজনীয় জায়গায় স্পীডব্রেকার বা ফুটওভারব্রিজ তৈরি করে দেয়ার কথা জানিয়েছেন। ছাত্রদের আট দফা দাবি মেনে নিয়েছেন তিনি। ছাত্র নিহতের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের মাঝে উপস্থিত হয়ে সংহতি প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নূর। নিরাপদ সড়ক ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের এই নেতা শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, সরকার বিরোধীরা অতীতের মত ছাত্র মৃত্যুর নতুন এই ঘটনাকে পুঁজি করার চেষ্টা করছে। তারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নামে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামানোর চেষ্টা করছেন। চালককে আটক করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটে যাত্রীবাহী সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় গুরুতর আহত হন বিইউপির (ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল) প্রথম বর্ষের ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী (২২)। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাস্তা পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ওঠার সময় সুপ্রভাত পরিবহনের বাসে চাপা পড়ে আবরার। বাসটি আবরারকে খানিকটা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে শুরু করে বাড্ডা নতুন বাজার পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে পড়েন। বিক্ষোভকারীরা দোষী চালকের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। আস্তে আস্তে সেই বিক্ষোভে যোগ দিতে থাকে আশপাশে থাকা বেসরকারী সব বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। দেখতে দেখতে সেখানে শত শত ছাত্র জড়ো হয়ে যান। শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এতে করে মহাবিপাকে পড়েন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশে বের হওয়া মানুষজন। পাশাপাশি অফিসগামী লোকজন পড়েন বিপাকে। বিক্ষোভকারীরা রাস্তার দুই পাশই বন্ধ করে দেয়। বিক্ষোভে যোগ দেন বেসরকারী নর্থ সাউথ ও ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। বিক্ষোভে বহু সাধারণ মানুষও যোগ দিয়েছিলেন। খবর পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভের মধ্যেই হাজির হন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি নিহতের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ১২ দফা দাবি জানিয়েছেন। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাসচালকের শাস্তি, নতুন বাসচালকেরা যেন যথাযথ নিয়মে ড্রাইভিং লাইসেন্স পান, গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার, জেব্রা ক্রসিংয়ের সামনে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, প্রগতি সরণির সামনে পথচারী-সেতু স্থাপন, পরিবহন সেক্টরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। প্রতি মাসে বাসচালকের লাইসেন্সসহ সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেক করতে হবে। আটক চালক ও সম্পৃক্ত সকলকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। মঙ্গলবার থেকেই ফিটনেসবিহীন বাস ও লাইসেন্স বিহীন চালককে দ্রুত সময়ের মধ্যে অপসারণ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সব স্থানে আন্ডারপাস, স্পীড ব্রেকার এবং ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। চলমান আইনের পরিবর্তন করে সড়কে হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দায়িত্ব অবহেলাকারী প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশকে স্থায়ী অপসারণ করে প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে বাসস্টপ এবং যাত্রীছাউনি করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। ছাত্রদের হাফ পাস (অর্ধেক ভাড়া) অথবা আলাদা বাস সার্ভিস চালু করতে হবে। মেয়র ছাত্রদের দাবি মেনে নেয়ার পাশাপাশি উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে থাকেন। মেয়র হ্যান্ডমাইক দিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, শিক্ষার্থীরা যাতে নিরাপদে চলাচল করতে পারে এজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনীয় সব জায়গায় স্পীডব্রেকার বা ফুটওভারব্রিজ করে দেয়া হবে। আগামী দুই থেকে সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে ঘটনাস্থলে আবরার চৌধুরীর নামে ফুটওভার ব্রিজ করে দেয়া হবে। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে কমিটি করে দেয়া হবে। কমিটিকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেন। সেখানে দাবি নিয়ে আলোচনা হবে। রাজধানীতে সুপ্রভাত পরিবহনের কোন বাস চলবে না। ইতোমধ্যেই বাস বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান মেয়র। এ ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করতে বাস মালিকদের সংযুক্ত করা হবে। মেয়র শিক্ষার্থীদের জনদুর্ভোগ কমাতে এবং জনগণের প্রতি মানবিক হতে রাস্তা থেকে সরে যেতে অনুরোধ করেন। মেয়রের আশ্বাসের পরেও শিক্ষার্থীরা রাস্তা থেকে সরেনি। দুপুর বারোটার দিকে মেয়র শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে জরুরী কাজে চলে যান। মেয়র চলে যাওয়ার পর বিক্ষোভকারীদের মধ্যে থেকে কয়েক যুবক দুপুর বারোটার পর পরই সেখানে বিক্ষোভের কারণে আটকে থাকা সুপ্রভাত পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস ভাংচুর করে। ভাংচুর শেষে বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। যদিও আগেই বাসটির যাত্রীরা নেমে যান। যার কারণে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত এভাবেই বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা রাশেদ খানকে নিয়ে বিক্ষোভকারীদের মাঝে উপস্থিত হন ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নূর। তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানান। এক বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে বলেন, ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় যে আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ একাত্মতা প্রকাশ করেছে। এর আগে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা আন্দোলনে রক্তক্ষয়ী হামলা চালানো হয়েছে। ছাত্রসমাজকে এবারের আন্দোলনেও সচেতন থাকতে হবে। শান্তিপূর্র্ণ আন্দোলন বানচালে বিভিন্ন মহল ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। সেই যড়যন্ত্র মোকাবেলা করে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আঘাত আসলে তার দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিতে হবে। এদিকে বাদ জোহর রাজধানীর মিরপুর সেনানিবাসের বিইউপি এডিবি গ্রেড গ্রাউন্ড মাঠে আবরারের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে মরদেহ বিকেল চারটায় বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজায় অংশ নিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আবরারের পিতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আরিফ আহমেদ চৌধুরী, বিইউপির ভিসি মেজর জেনারেল মোঃ এমদাদ-উল বারী, ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম, আবরার আহমেদের সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও আত্মীয়স্বজনরা। জানাজা পড়ান ২৫ নম্বর এডিবি গ্রেড মসজিদের ইমাম মওলানা তাজুল ইসলাম। নিহত আবরার রাজধানীর মালিবাগে পরিবারের সঙ্গে নিজস্ব বাড়িতে থাকতেন। গুলশান থানা পুলিশ জানায়, ঘাতক বাসটিকে জব্দ করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ঘাতক চালক সিরাজুল ইসলামকে। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। বাসটির হেলপারকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। বাসটির মালিকের সন্ধান চলছে। চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স সঠিক কিনা তা নিশ্চিত হতে বিআরটিএকে নোটিস করা হয়েছে।
×