ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘাসের বীজ গুঁড়া করে রং মিশিয়েই মরিচ, হলুদ

প্রকাশিত: ১১:০৪, ২০ মার্চ ২০১৯

ঘাসের বীজ গুঁড়া করে রং মিশিয়েই মরিচ, হলুদ

শাহীন রহমান ॥ বাঙালীর বিভিন্ন ধরনের রান্নাবান্নায় যে উপাদন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় তা হলো মসলা। দেশে হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা ইত্যাদি মসলা হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এসব মসলার একটি বিশাল অংশ আবার খোলাবাজারে বিক্রি হয়। এসবের ক্রেতা আবার শহর এবং গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ঘাসের বীজ, রং, চাল ও ডালের গুঁড়া, ধানের তুষ মিশিয়ে এসব মসলা তৈরি ও বিক্রি করা হয়। এসব ভেজাল মসলার বড় ক্রেতা রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল রেস্তরাঁ। আবার চট্টগ্রামের সামাজিক মেজবানগুলোতেও ব্যবহার হচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষকে নিরুপায় হয়ে এসব মসলা ব্যবহার করতে হচ্ছে। বিএসটিআইয়ের ভেজাল বিরোধী অভিযানে মসলার সঙ্গে ভেজাল মিশিয়ে তৈরি বিক্রি করার ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে রাজধানীর কাওরানবাজার, শ্যামবাজার, মৌলভীবাজার, মিরপুর, টঙ্গী এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের মসলা তৈরির কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা থেকে মসলার গুঁড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যায়। রাজধানীর কাওরান বাজারে ভেজাল বিরোধী অভিযানে মসলায় ভেজাল মেশানোর বিষয়টি হাতেনাতে ধরা পড়ে। এখানে গড়ে ওঠা কয়েকটি কারখানায় হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরাসহ বিভিন্ন মসলা ভাঙ্গানোর কাজ চলে। এসব অনেক কারখানায় ঘাসের বীজের সঙ্গে রং মিশিয়ে ভেজাল গুঁড়ামসলা তৈরি কার্যক্রম হাতেনাতে ধরা পড়ে। এতে দেখা যায়, ঘাসের বীজ বা কাউন যা পাখির খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তা ভেজাল মসলার মূল উপকরণ। ঘাসের বীজ গুঁড়া করে ক্ষতিকর রং মেশানো হয়। এতে লাল রং মেশালে তৈরি হয়ে যায় মরিচের গুঁড়া। আর হলুদ রং মেশালে একই গুঁড়া হয়ে যাচ্ছে হলুদের। এর সঙ্গে কিছু পচা কাঁচামরিচ শুকিয়ে দিলে মরিচের গুঁড়ায় হাল্কা ঝাল হয়। আর নকল হলুদের গুঁড়ায় কিছু আসল হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে দিলে কেউ ভেজাল মসলা হিসেবে আর চিহ্নিত করতে পারেন না। কাওরান বাজার এলাকায় একটি কারখানায় ভেজাল গুঁড়া মসলা তৈরির সঙ্গে সরাসরি জড়িত গিয়াস উদ্দিন জানান, ১৫ বছর ধরে এ প্রক্রিয়ায় তিনি ভেজাল মসলার গুঁড়া তৈরি করছেন। সাধারণত গভীর রাতে রং মেশানোর কাজ করা হয়। এখান থেকে তৈরি ভেজাল গুঁড়া মসলার বেশিরভাগই বিক্রি হয় ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। অধিক লাভের আশায় বাইরের পার্টি এসে এখানে ভেজাল মসলার অর্ডার দেয়। আসল হলুদ ও মরিচের গুঁড়া আড়াই শ’ টাকা কেজি হলেও ভেজাল এ মসলার গুঁড়া মেলে ১৩০ টাকায়। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী কাওরানবাজারের সব কারখানায় এভাবে এই ভেজাল দেয়া হয়। তাদের যুক্তি, মসলায় ভেজাল না দিলে কারখানা চলবে না। কাস্টমার অন্যখানে চলে যাবে। অন্য একটি কারখানার মালিক মনিরের স্বীকারোক্তি, তার বাবা তাকে এই ভেজাল মসলার কাজ শিখিয়েছেন। এখন তিনি নিজেই কর্মচারী দিয়ে এসব কাজ করান। তার বাবা বিক্রির কাজ করেন। সুমন জানান, গুঁড়া মসলায় যে রং মেশানো হয় তা কাপড় তৈরির রং। কাওরানবাজারের কিচেন মার্কেটের দোতলায় ৩শ’ টাকা কেজিতে এসব রং পাওয়া যায়। অথচ খাদ্যের পরিপূরক হিসেবে যে রং ব্যবহার করা হয় তার দাম ৫ হাজার টাকা কেজি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাপড়ের রং শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ভেতরে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান রয়েছে। অক্সাইড জাতীয় এসব টেক্সটাইলের রং মেশালে প্রথমে এসিডিটি হয়। অব্যাহত ভাবে ভেজাল দেয়া এসব মসলা ব্যবহার করলে হেপাটাইটিস, ক্যান্সার, কিডনি ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার মতো কারণ ঘটতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মৌলিক চাহিদার (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য) মধ্যে খাদ্য একটি প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা। জীবন ধারণের জন্য খাদ্যের কোন বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর এ বিশুদ্ধ খাদ্য সুস্থ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি কঠিন করে ফেলছে কিছু বিবেকহীন ব্যবসায়ী ও আড়তদার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাওরানবাজারের একাধিক কারখানায় কয়েক বছর ধরেই এসব ব্যবসায়ী ভেজাল মসলা তৈরির কাজ করছেন। মাঝে মধ্যে অভিযানে তারা ধরা পড়লে জরিমানা দিয়ে আবার একই কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছেন বলে জানান বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা। তারা জানান বিএসটিআইয়ের যেসব ম্যান্ডেটরি আইটেম রয়েছে সেগুলো প্রস্তুত বা উৎপাদন ও বিপণন করতে হলে অবশ্যই বিএসটিআইয়ের অনুমোদন লাগবে। অনুমোদনহীন এসব প্রতিষ্ঠানেই মূলত ভেজালের কাজ বেশি হয়। তারা বলেন, বাজারের খোলা অবস্থায় বিক্রি হওয়ার কারণে মান নিয়ন্ত্রণে কোন ব্যবস্থা থাকে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রমজান এলেই এ ধরনের ভেজাল মসলার চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আবার এসব ভেজাল মসলার বড় ক্রেতা হলো রাজধানীর হোটেল রেস্তরাঁগুলো। সরাসরি মিলমালিকদের কাছ থেকে তারা পাইকারি দামে এসব মসলা সংগ্রহ করেন। হোটেল রেস্তরাঁয় এসব ভেজাল মসলা ব্যবহারের কারণে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের হানি ঘটছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এসব হোটেল রেস্তরাঁর খাবার পরীক্ষা করে দেখা গেছে বেশিরভাগ হোটেলের খাবার মানহীন। মানুষের খাবার উপযোগী নয়। সিটি কর্পোরেশনের হিসেবে দেখা গেছে, রাজধানীতে প্রায় হাজার খানেক মসলা তৈরি কারখানা রয়েছে। যেখানে মূলত এই ভেজাল মসলা তৈরি বেশি হচ্ছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম মহানগরীতেও রয়েছে অসংখ্য ভেজাল মসলা তৈরির কারখানা। সেখানে পরিচালিত অভিযানে এর তথ্য মিলেছে। এতে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে যেসব সামাজিক মেজবানের আয়োজন করা হয় সেখানে এই ভেজাল মসলার কদর রয়েছে বেশি। বিভিন্ন ব্রান্ডের নামেও চটকদার মোড়কে মানুষকে আকৃষ্ট করে অসাধু ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে এসব ভেজাল মসলা খাওয়াচ্ছেন। বন্দরনগরীর ষোলশহর বিবিরহাট এলাকায় এক অভিযানে ছোট ছোট বিভিন্ন কারখানায় রং মেশানো এবং নোংরা পরিবেশে ময়লা পানিতে সয়লাব হয়ে যাওয়া হলুদ-মরিচের গুঁড়া প্যাকেটজাত করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, এই এলাকার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। চট্টগ্রামে সাধারণত মেজবানের জন্য এসব কারখানা থেকেই বেশি পরিমাণে মসলা সরবরাহ করা হয়। এছাড়া বিয়ে, জন্মদিনসহ যে কোন অনুষ্ঠানেও মসলা সরবরাহ করার অর্ডার পেয়ে থাকে তারা। এর বাইরে খুচরা ও পাইকারিভাবেও হলুদ-মরিচের গুঁড়াসহ মসলা বিক্রি হয়।
×