ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ১১:০৫, ২০ মার্চ ২০১৯

অগ্নিঝরা মার্চ

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ অসহযোগ আন্দোলনের ১৯তম দিনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রাক্তন নৌসেনাদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে তারা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করার জন্য একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী কমান্ড গঠনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন বাঙালী সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানান। সকালে কঠোর সামরিক প্রহরা পরিবেষ্টিত রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চতুর্থ দফা আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ছয়জন শীর্ষ স্থানীয় সহকর্মী উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে, ইয়াহিয়ার উপদেষ্টার মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এ কে ব্রোহী, শরীফুদ্দিন পীরজাদা, মিঃ কর্নেলিয়াস। বৈঠকে আগের দিনের গোলাগুলির ঘটনার কথা উঠলে শেখ মুজিব স্পষ্ট বলেন, নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালানো হতে থাকলে পাল্টা গুলি চালানোর জন্যে শেষ পর্যন্ত তারা অস্ত্র হাতে তুলে নেবেই। তাঁর এমন কঠোর কথা ইয়াহিয়া খানকে কিছুটা বিব্রত করে তুলে। প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এসে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তিনি এর বেশি কিছু বলাতে অপারগতা জানিয়ে বলেন, সময় এলে অবশ্যই আমি সব কিছু বলব। মুক্তিপাগল মানুষের দৃপ্ত পদচারণায় রাজধানী টালমাটাল হয়ে ওঠে। মিছিলের পর মিছিল এগিয়ে চলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে শপথ গ্রহণ শেষে একের পর এক শোভাযাত্রা বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনে গিয়ে সমবেত হয়। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে একাধিক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, মুক্তি পাগল সাড়ে সাতকোটি বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোন শক্তিই রুখতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মওলানা মুফতি মাহমুদ পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হন। রাতে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে একটি অনুপ্রেরণাদায়ী দৃষ্টান্ত। সুপ্রীমকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম কৌঁসুলি একে ব্রোহি সকালে করাচী থেকে ঢাকায় আসেন। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তিনি লন্ডন পরিকল্পনা যা ১৯৬৯ সালে লন্ডনে বসে শেখ মুজিব, খান আবদুল ওয়ালী খান ও মিয়া মমতাজ মোহম্মদ খান দৌলতানা কর্তৃক প্রণীত তা মানবেন না। তিনি বলেন, ওই পরিকল্পনা আওয়ামী লীগ প্রধান কর্তৃক ঘোষিত ৬ দফার ভিত্তিতেই করা হয়েছে। জয়দেবপুরের রাজবাড়ীতে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন তাদের হাতিয়ার ছিনিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়। নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য শামসুল হকের নেতৃত্বে গ্রামের পর গ্রাম থেকে মানুষ এসে টঙ্গী-জয়দেবপুর মোড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চারু ও কারু শিল্পীরা ‘স্বাধীনতা’ পোস্টার লিখে বুকে বেঁধে অসহযোগ আন্দোলনে রাস্তায় নামেন। প্রত্যেক মহল থেকেই ২৩ মার্চের পাকিস্তান দিবসকে কেন্দ্র করে বেশ প্রস্তুতি চলছিল। ভাসানী সেই দিনটিকে ‘স্বাধীন পূর্ববাংলা দিবস’ হিসেবে উদযাপন করার আহ্বান জানান। এ দিনেই করাচীতে পিপিপি নেতা ভুট্টো সাংবাদিকদের জানান যে, তিনি পরবর্তী দিন ঢাকা আসছেন এবং বলেন যে, প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে সন্তোষজনক জবাব পেয়ে তিনি ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৮ তারিখে তৈরিকৃত সেই নীলনক্সা এই দিন টিক্কা খানকে পড়ে শোনানো হয় এবং এটা অনুমোদিত হয়। মিরপুর, চট্টগ্রাম, পার্বতীপুর, সৈয়দপুরে বাঙালীর সঙ্গে বিহারি ও সেনাবাহিনীর দাঙ্গা শুরু হয়।
×