এমএ রকিব ॥ ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে, লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে....। এমন অসংখ্য মরমী গানের স্রষ্টা বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ। বাংলার বাউল সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এই মরমী সাধকের নাম স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে লালনের নাম আজ বহির্বিশ্বেও প্রচারিত। লালনের গানে কেবল অধ্যাত্ম দর্শনই নয়, বাংলার সমাজ, প্রকৃতি ও মানুষের কথাও প্রতিফলিত হয়েছে। লালনের গান কেবল পল্লী বাংলার হাজার হাজার মানুষকেই মুগ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করেনি; বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও করেছে অনুপ্রাণিত। প্রকৃতপক্ষে লালন শাহ আজ লৌকিক বাংলার কিংবদন্তি সঙ্গীত নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত। লালনের ‘দোল পূর্ণিমা’ বা ‘স্মরণোৎসব’কে ঘিরে এবার কুষ্টিয়া লালন একাডেমি আয়োজন করেছে তিন দিনব্যাপী বাউল সমাবেশ। ‘মনের গরল যাবে যখন, সুধাময় সব দেখবি তখন’ সাঁইজির অমর এ বাণীকে বুকে ধারণ করে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় (২০ মার্চ) আজ বুধবার দোল পূর্ণিমার রাত থেকে ছেঁউড়িয়ায় শুরু হচ্ছে এই উৎসব। লালন একাডেমির সভাপতি কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। অতিথি থাকছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এমপি, কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জ, পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী রবিউল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ সদর উদ্দিন খান প্রমুখ। সাধুসংঘের নিয়মানুযায়ী দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় ‘রাখল সেবা’র মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাউলদের দেড় দিনের মূল উৎসব। তাদের এই উৎসব চলবে বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘পূর্ণ সেবা’ পর্যন্ত।
এদিকে স্মরণোৎসব উপলক্ষে ছেঁউড়িয়ায় লালনের আঁখড়াবাড়ি চত্বর পরিণত হয়েছে এক উৎসবের পল্লীতে। দেশ-বিদেশ থেকে আগমন ঘটেছে লালনভক্ত, বাউল অনুসারী ও সুধীজনসহ অসংখ্য মানুষের। স্মৃতিচারণ মূলক আলোচনা, গান আর লোকশিল্প মেলা নিয়ে বসেছে জমজমাট এই আসর। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে শুরু হচ্ছে এসব অনুষ্ঠান। আলমডাঙ্গা থেকে আসা দুলাল সাঁই বলেন, ‘আমরা সাঁইজির দোল পূর্ণিমা উৎসব পালন করতে এখানে এসেছি। আমাদের অনুষ্ঠান দু’দিনেই শেষ হয়ে যায়। বাউল সাধুরা লৌকিকতা পছন্দ করেন না। তারা সাঁইজিকে ভক্তি, শ্রদ্ধা জানাতে এবং নিজের মধ্যে ভাববিনিময় খুঁজতেই ব্যস্ত থাকেন। তারা এখানে এসেছেন সাঁইজির সাক্ষাত পেতে। সেই সঙ্গে দেখা হয় তাঁর পুণ্যভূমিও’। লালন গবেষকদের কারও কারও মতে, দোল পূর্ণিমার সঙ্গে প্রেমময় আত্মার সম্পর্ক স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর এই রাতে লালন শাহ নিজেই ভক্ত শিষ্যদের নিয়ে ঘটা করে উৎসবটি পালন করতেন। সেই থেকে লালনের অগণিত ভক্ত ও অনুসারীরা আজও এ দিনটিকে ধারাবাহিকভাবে পালন করে আসছে। লালনের সেই স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে লালন একাডেমিও প্রতিবছর উৎসবটিকে ‘লালন স্মরণোৎসব’ হিসেবে পালন করে আসছে। প্রতিবারের মতো এবারও স্মরণোৎসবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারী-পুরুষ সমন্বয়ে অন্তত অর্ধলাখ লালনভক্ত, অনুসারী, দর্শক-শ্রোতা ও বাউলের সমাবেশ ঘটবে বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। রাতভর চলবে লালনের আধ্যাত্মিক গান ও তত্ত্ব আলোচনা।
লালন একাডেমির সভাপতি কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, স্মরণোৎসব ও গ্রামীণ মেলাকে কেন্দ্র করে মাজার প্রাঙ্গণ ও তার আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুরো মাজার এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। জেলা পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে। সেই সঙ্গে আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সেখানে দায়িত্বে থাকবে। লালনের জীবন কাহিনী অনেকাংশেই রহস্যাবৃত। তাঁর জীবনের ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে গবেষক ও ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন তথ্য, জনশ্রুতি বা অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। লালনের জন্ম, জাত ও ধর্ম নিয়েও যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। লালন নিজেও তার জাত ধর্ম সম্পর্কে নিস্পৃহ ও উদাসীন ছিলেন। তাঁর জাত-ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে তাই তিনি জবাব দিয়েছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে। লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে’। জানা যায়, লালন সিরাজ সাঁই নামের এক তত্ত্বজ্ঞ সিদ্ধ বাউল গুরুর সান্নিধ্যে এসে বাউল মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। দীক্ষা গ্রহণের পর গুরুর নির্দেশে লালন কালীগঙ্গা নদীর তীরে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামে এসে বাংলা ১৮২৩ সাল মতান্তরে ১৮৩০ সালে আঁখড়া স্থাপন করেন। এখানে তিনি স্থানীয় কারিকর সম্প্রদায়ের সাহায্যে ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তাদের দানে ও অনুদানেই আঁখড়াটি গড়ে ওঠে। অল্পদিনের মধ্যেই লালনের প্রভাব ও পরিচিতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। লালন আজ নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর অমর সৃষ্টি। যার মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন বাঙালীর মরমী মানসপটে।