ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

আবারও সেয়ানে সেয়ানে লড়াই

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ২০ মার্চ ২০১৯

আবারও সেয়ানে সেয়ানে লড়াই

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো ও লিওনেল মেসি আধুনিক ফুটবলের সেরা দুই তারকা। গত প্রায় এক যুগ ধরে ময়দানী লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছেন এ যুগল। কিন্তু গত বছর দু’জনই কিছুটা পথ হারিয়েছিলেন। অনেকে শঙ্কা করেছিলেন, এই বুঝি দম ফুরালো! কিন্তু না, দম ফুরায়নি মেসি-রোনাল্ডোর। দু’জনই স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়েছেন চলতি মৌসুমে। মৌসুমের শুরু থেকেই অসাধারণ ছন্দে এগিয়ে চলেছেন বার্সিলোনার আর্জেন্টাইন তারকা মেসি। অন্যদিকে রোনাল্ডোকে মৌসুমের অর্ধেক পর্যন্ত তেমনভাবে খুঁজে পাওয়া না গেলেও সম্প্রতি স্বরূপে ফিরেছেন। তাতে করে সি আর সেভেনের দল জুভেন্টাসও চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়ের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে। চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ‘রাজা’ বলা হয় ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোকে। কিন্তু চলমান মৌসুমে কেমন যেন অচেনা লাগছিল পর্তুগীজ সুপারস্টারকে। নতুন ক্লাব জুভেন্টাসের জার্সিতে ইউরোপ সেরার মঞ্চে মলিন দেখাচ্ছিল তাকে! অবশেষে সেই মঞ্চেই স্বরূপে ফিরেছেন পাঁচবারের ফিফা সেরা তারকা। যখন তার দল জুভেন্টাসও গভীর জলে হাবুডুবু খাচ্ছিল। সেই অবস্থা থেকে একাই তুরিনের ওল্ড লেডিদের টেনে তুলেছেন ৩৪ বছর বয়সী এই মহানায়ক। ১২ মার্চ রাতে তার করা দুর্দান্ত রেকর্ডগড়া হ্যাটট্রিকে ভর করে সব শঙ্কা কাটিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের কোয়ার্টার ফাইনালের টিকেট কেটেছে জুভেন্টাস। অবিশ্বাস্য কীর্তিটা সম্ভব হয়েছে রোনাল্ডোর অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্সে ভর করে। তাইতো ফুটবলবিশ্ব এখন সিআর সেভেনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এ নিয়ে অষ্টমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লীগে হ্যাটট্রিক করেছেন রোনাল্ডো। এর আগে ২০১৬ সালের এপ্রিলে জার্মান ক্লাব উলফসবার্গের বিরুদ্ধে রিয়াল মাদ্রিদ প্রথম লেগে ২-০ গোলে পরাজিত হলেও ফিরতি লেগে রোনাল্ডোর হ্যাটট্রিকে লড়াইয়ে ফিরে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল গ্যালাক্টিকোরা। এবার জুভেন্টাসের জার্সিতে একই কীর্তি গড়লেন রোনাল্ডো। দেখার পালা, শেষ পর্যন্ত তার এখনকার দল ১৯৯৬ সালের পর চ্যাম্পিয়ন হতে পারে কি না। চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা রোনাল্ডো। তার গোলসংখ্যা ১২৪টি। এর মধ্যে এবার এখন পর্যন্ত করেছেন পরশু রাতের হ্যাটট্রিকসহ চার গোল। এ্যাটলেটিকো বরাবরই পছন্দের প্রতিপক্ষ রোনাল্ডোর। এর আগে রিয়ালের হয়ে খেলার সময় প্রায়শই দলটির বিরুদ্ধে খেলতে হতো। ম্যাচটির আগে তাদের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক ছিল তিনটি। আর গোল ২১টি। এই ম্যাচের পর এ্যাটলেটিকোর বিরুদ্ধে চারটি হ্যাটট্রিকসহ রোনাল্ডোর মোট গোলসংখ্যা ২৪টি। সঙ্গত কারণেই বেজায় খুশি পর্তুগাল অধিনায়ক। ম্যাচশেষে রোনাল্ডো বলেন, আমাদের দারুণ একটা রাত কাটাতেই হতো। আর এটা অসাধারণ একটা রাতই ছিল। শুধু আমার গোলের জন্য নয়, দলের জন্যও। সম্ভবত এ কারণেই জুভেন্টাস আমাকে দলে নিয়েছে। আমি শুধু নিজের কাজটা করেছি। আর এটা ছিল স্বপ্নের মতো একটা রাত। আমরা খুব গর্বিত। মহাকীর্তির পর রোনাল্ডোর প্রশংসায় ব্যস্ত আছেন শত্রু-মিত্র সবাই। সাবেক ইংলিশ ফুটবলার ও ক্লাব সতীর্থ রিও ফার্ডিনান্ড এককথায় বলে দিয়েছেন, রোনাল্ডো জীবিত এক ফুটবলঈশ্বর। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে একসময় রোনাল্ডোর সঙ্গে খেলা ফার্ডিনান্ড বলেন, রোনাল্ডো জীবিত এক ফুটবলঈশ্বর। ও যা করছে, এতো রীতিমতো ছেলেখেলা। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে আপনি যা যা রেকর্ড কল্পনা করতে পারেন, এর সবই ওর দখলে আছে। এমনকি সর্বোচ্চ হ্যাটট্রিকের রেকর্ডটাও এখন মেসির সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। আগের পাঁচ ম্যাচে সব ধরনের প্রতিযোগিতাতেই এ্যাটলেটিকোকে কেউ গোল দিতে পারেনি। এমন জমাট পরিসংখ্যান নিয়েই ইতালিতে খেলতে এসেছিল দিয়াগো সিমিওনের দল। সিমিওনের বিশেষ পারদর্শিতাও আছে রোনাল্ডোকে আটকানোর ব্যাপারে। কিন্তু এবার আর পারেননি তিনি। ফার্ডিনান্ড তাই বলে দিলেন, রোনাল্ডোই বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। ও বড় ম্যাচের জন্য এ ধরনের পারফর্মেন্স জমিয়ে রাখে। ম্যাচটি মাঠে বসে দেখেছেন রোনান্ডোর স্ত্রী জর্জিন রড্রিগুয়েজ ও তার সন্তানরা। বাবার কীর্তি দেখে ছেলে হাততালি দিয়েছে। স্ত্রী তো চোখের জল সামলাতে পারেননি। ম্যাচশেষে ইনস্টাগ্রামে বীর রোনাল্ডোর প্রশংসা করে রড্রিগুয়েজ লিখেছেন, ৩-০ গোলের জয়টি আদায় করে নেয়া। এই রাতের তিন গোল তোমার প্রাপ্য। তুমি যখন যে ক্লাবে খেল, ত্যাগের বিনিময়ে তুমি সাফল্য চাও। তুমি তোমার সতীর্থ, কোচ ও সমর্থকদের জন্য নায়কের মতো। ঈশ্বর জানেন, ঈশ্বর বিশ্বাস করেন ফুটবল বিশ্ব তোমার। আমরা তোমাকে খুব বেশি ভালবাসী। রোনাল্ডোকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন মেসিও। তিনি বলেন, ‘ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পারফর্মেন্স ছিল মনোমুগ্ধকর। ছিল দারুণ বিস্ময়। কারণ আমি ভেবেছিলাম অ্যালেটিকো মাদ্রিদই শক্তিশালী। কিন্তু জাদুকরি এক রাত উপহার দিয়েছেন রোনাল্ডো’। সি আর সেভেনের পারফর্মেন্স নিয়ে মেসি আরও বলেন, রোনাল্ডো আর জুভেন্টাস যা করেছে সেটা আসলেই দারুণ। আমার মনে হয় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ আরও কঠিন। রোনাল্ডো তিন গোল করেছেন, তার জাদুকরী এক রাত ছিল। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে মেসির দলের প্রতিপক্ষ এখনও ঠিক হয়নি। তবে যে দলই পড়ুক, সেটা কঠিনই হবে মনে করছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিপক্ষ সবাই কঠিন। আয়াক্সেই দেখুন (শেষ ষোলোতে যারা রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়েছে)। তারা দেখিয়েছে তরুণদের নিয়ে তাদের দলটি দুর্দান্ত। তারা কাউকে ভয় করে না। যাদের সামনেই পড়ি, আমাদের জন্য কঠিন হবে। আমাদের কঠিন চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রোনাল্ডো যেমন স্বরূপে ফিরেছেন তেমনি মেসিও ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। ১৭ মার্চ লা লীগায় আরেকটি হ্যাটট্রিক করেছেন তিনি। জাদুকরী পারফরমেন্সের কারণে শত্রু-মিত্র প্রায় সবারই নয়ন মণি মেসি। ময়দানী লড়াইয়ে তাঁর জাদু দেখে মোহবিষ্ট হতে বাধ্য তারা! লা লীগায় রিয়াল বেটিসের বিরুদ্ধে মেসির করা তিনটি গোলই অবিশ্বাস্য। এমন ভঙ্গিতে তিনি গোলগুলো করেছেন যা অন্য ফুটবলারদের কাছে স্বপ্নের মতো! মৌসুমের আর্জেন্টাইন তারকার এটা চতুর্থ ও ক্যারিয়ারের ৫১তম হ্যাটট্রিক। অসাধারণ পারফরমেন্সের দরুণ রিয়াল বেটিসের খেলোয়াড়েরা তো বটেই এমনকি তাদের দর্শকরাও সম্মান জানিয়েছেন পাঁচবারের ফিফা সেরা তারকাকে। হ্যাটট্রিক হয়ে যাওয়ার পর গ্যালারিতে উঠে দাঁড়িয়ে তুমুল হর্ষধ্বনিতে মেসিকে সম্মান জানান রিয়াল বেটিস সমর্থকরা। ম্যাচ শেষে এ জন্য তাদের প্রতি ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ৩১ বছর বয়সী মেসি। চলমান লীগে গোলদাতার তালিকায় সবার উপরে থাকা মেসির গোলসংখ্যা ২৯টি। আর সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে মৌসুমে এ পর্যন্ত করেছেন ৩৯ গোল। মজার বিষয়, বেটিস সমর্থকরা সেভিয়ার বেনিটো ভিয়ামারিন স্টেডিয়ামে প্রায় পুরোটা সময়ই মেসিকে উৎসাহিত করেন। হ্যাটট্রিক হওয়ার পর ও ম্যাচ শেষে তারা দাঁড়িয়ে মেসিকে সম্মান জানান। মেসিও প্রতিপক্ষ সমর্থকদের এই অভিনন্দনে দারুণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। মসিকে সম্মান জানানোয় স্বাগতিক সমর্থকদের পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন বেটিস কোচ কিকে সেটিয়েন। তিনি বলেন, আমাদের সমর্থকরা অসাধারণ একজন খেলোয়াড়ের প্রতি তাদের সম্মান দেখিয়েছে। ব্যাপারটা আমি সত্যি খুব পছন্দ করেছি। তার এই পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি দেওয়াটা ন্যায্য ও সঠিক। আমাদের সমর্থকরা অসাধারণ আচরণ করেছে। আমি তাদের নিয়ে খুব গর্বিত। আমি দুর্দান্ত কিছু খেলোয়াড়কে অসাধারণ সব কাজ করতে দেখেছি। কিন্তু গত ১২ বছর ধরে মেসি যা যা করেছে তার সঙ্গে কোন কিছুরই তুলনা হতে পারে না। কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করেননি মেসি। বার্সিলোনা অধিনায়ক বলেন, সত্যি বলতে, একটা গোলের জন্য কখনও প্রতিপক্ষের সমর্থকরা আমাকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছে, এমনটা আমার মনে পড়ে না। রিয়াল বেটিসের সমর্থকদের আচরণের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। যখনই এই স্টেডিয়ামে আসি, আমরা খুব ভালো অভ্যর্থনা পাই। গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচ জিততে পেরে আমি খুব সন্তুষ্ট ও খুশি।
×