ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোদির বিপজ্জনক মুহূর্ত

প্রকাশিত: ১১:৫৮, ২০ মার্চ ২০১৯

মোদির বিপজ্জনক মুহূর্ত

পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তান সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটেছে মনে করার কারণ নেই। কাশ্মীর সীমান্তে এখনও দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলছে। দুদেশের মধ্যে গুলিবিনিময় সেখানে মাঝেমধ্যেই হয়ে থাকে। উত্তেজনা বাড়লে সেটা কামান মর্টারের গোলাবিনিময়েরও রূপ নেয়। কখনও কখনও এক পক্ষের সৈন্য অন্যের ভূখণ্ডে ঢুকে ছোটখাটো হামলা চালায় এমন ঘটনাও ঘটে। কিন্তু ১৯৯০ এর দশকের শেষ দিকে এই দুই চিরশত্রু প্রতিবেশী পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার পর থেকে কেউই অন্যের ভূখ-ে জঙ্গী বিমান পাঠানোর দুঃসাহস করেনি। সেই দুঃসাহস ভারত এবারই প্রথম দেখিয়েছে। পুলওয়ামার জঙ্গী হামলার জবাবে ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের এক ঝাঁক জঙ্গী বিমান পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন পাওয়ায় ঢুকে বোমাবর্ষণ করে সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস ও তিনশ’ জঙ্গীকে হত্যার দাবি করে। পাকিস্তানও এরপর পাল্টা বিমান হামলা চালায় ভারতের টার্গেটগুলোতে এরপর আটক ভারতীয় বৈমানিকের মুক্তিলাভের মধ্য দিয়ে দুদেশের টান টান উত্তেজনা স্তিমিত হলেও সীমান্ত সংঘর্ষ থামেনি। বর্তমান পরিস্থিতি নরেন্দ্র মোদিতে উভয় সঙ্কটে ফেলেছে। সংঘর্ষের বিস্তার ঘটানো এবং সংঘর্ষ থামানো দুটো কৌশলই তার হাতে আছে। কিন্তু আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি কোন কৌশলটি প্রয়োগ করবেন সেটাই এখন মস্তো প্রশ্ন। এক্ষেত্রে হিসাবে সামান্য একটু গরমিল এবং ভুল চাল দেয়া হলে সংঘর্ষের মারাত্মক বিস্তার ঘটতে এবং তার পরিণতিতে মহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে। অতএব লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে মোদি এখন কঠিনতম হিসাব নিকাশের সম্মুখীন যার ওপর তাঁর প্রধানমন্ত্রী থাকা না থাকাটাও নির্ভর করছে। মোদি সর্বদাই নিজেকে এমন এক সাহসী ও আপোসহীন নেতা হিসেবে হাজির করার চেষ্টা করেছেন মিনি পাকিস্তানের উস্কানি মোকাবিলায় বিন্দুমাত্র সঙ্কুচিতবোধ করেন না। ২০১৬ সালের উবি ঘটনা তার দৃষ্টান্ত। আশঙ্কার কথা হচ্ছে তার এমন প্রবণতাই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের মুখে তাকে পাক-ভারত সংঘর্ষের বিস্তার ঘটানোর দিকে ঠেলে দিতে পারে এবং সেক্ষেত্রে সেই সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। মোদি আগুন নিয়ে খেলতে ভালবাসেন। আগুন দিয়ে খেলার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার সময় তিনি সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। দাঙ্গায় তাঁর হাত থাকার ব্যাপারে গুরুতর অভিযোগ আছে তবে প্রমাণ নেই। সে সময় তার ভূমিকা উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও ধর্মান্ধ মহলে দারুণ সমাদৃত হয়। তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই হিন্দুত্ববাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভেসেই নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে। তারপর থেকে হিন্দুত্ববাদী ভাবধারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বব্যাপকতা লাভ করে। গোহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়। হিন্দুত্ববাদী দর্শনের মূল বাহন আরএসএসএর লোকদের মোদি ভারতীয় রাজনীতির সমস্ত অংশে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আরএসএসএর প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ফার্ম ও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অভিযোগ আছে পুলিশ সেনাবাহিনী ও আদালতে পদোন্নতিতেও আরএসএসএর ছায়া পড়েছে। মোদির এই উগ্রজাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্ববাদী কার্যক্রম ভারতের সাধারণ মানুষ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে। এটা ঠিক যে তার আমলে অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৭ শতাংশ হারে। তিনি কিছু সংস্কারও এনেছেন যেমন দেশব্যাপী পণ্য ও সার্ভিস কর (জিএসটি)। কিন্তু তার সরকার কা-জ্ঞানহীনভাবে কালো টাকা উদ্ধারের জন্য হঠাৎ করে বড় নোট বাতিল জনগণকে নিদারুণ ভোগান্তিতে ফেলে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষেত্রে ৩ লাখ কোটি রুপী লোকসান হয় এবং ২৫ লাখেরও বেশি লোক বেকার হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জিএসটির কারণে শিল্প ও ব্যবসায় উদ্যোগ মার খায়। ব্যাংক খাত দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ নীতি ও পরিকল্পনার শিকার হয়েছে যার ফলে এই খাতে নিট লোকসান হয়েছে ৪৪ হাজার কোটি রুপী। তেলের দাম ২০১৪ সালের পর থেকে কম থাকলেও ভারতে আবগারী কর বৃদ্ধির ফলে পেট্টল ও ডিজেলের দাম বহুগুণ বেড়েছে। এতে পণ্যের দাম বেড়েছে। তার আমলে বেকারত্ব না কমে বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষমতায় আসার সময় মোদি অনেক লম্বা লম্বা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যার অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এসব কারণে সামনের নির্বাচন মোদির জন্য মস্তো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা আরও ঘটেছে এই কারণে যে জনগণের মধ্যে মোদি সরকারের উপর অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো নতুন শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস জয়ী হয়েছে। অন্যান্য দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গঠনের চেষ্টা করছে। মোদি ম্যাজিক জনগণের কাছে ম্লান হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সামনের নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেয়া মোদির জন্য যে সহজ হবে না তা বলাই বাহুল্য। পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন মোদি সম্ভবত জিতবেন তবে আগের মতো বিশাল ব্যবধানে নয়। আবার অনেকের মতে তার জিতবার সম্ভাবনা ৫০:৫০। এই যখন অবস্থা তখন পুলওয়ায়ার জঙ্গী হামলা ও তার জের ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষ মোদিকে এর বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে। জনগণের দৃষ্টি এখন এমন এক দিকে সরে গেছে সেখানে মোদি সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। সেটা হলো জাতীয় নিরাপত্তা। তিনি জনমনে এমন ধারণা দিতে পেরেছেন যে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টা উপযুক্ত ব্যক্তির হাতেই আছে যিনি ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানকে সমুচিত শিক্ষা দেয়ার ক্ষমতা রাখেন এবং যিনি এ প্রশ্নে কোনরকম আপোস করেন না। তার নির্দেশে খাইবার পাখতুন খাওয়ায় জঙ্গী ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমান হামলা মোদির এই ইমেজকে আরও জোরদার করেছে। কিন্তু এরপরই পাকিস্তানের পাল্টা বিমান হামলা, একটি ভারতীয় মিগকে ঘায়েল ও পাইলটকে বন্দীর ঘটনা ভারতীয়দের উদ্দীপনায় পানি চেলে দিয়েছে। অথচ পাকিস্তানবিরোধী উগ্রমনোভাব ধরে রাখা মোদির জন্য এখন বড়ই প্রয়োজন। তাই কাশ্মীর সীমান্তে চলছে দু’পক্ষের গোলাগুলি। ভারতের অনেকে এমন মন্তব্য করেছেন যে ভোট পাওয়ার জন্য মোদি এই লড়াই জিইয়ে রেখেছেন। সীমান্ত সংঘর্ষ এখনই থেমে গেলে তা ভারতের পরাজয় বলে গণ্য হবে এবং তার জন্য মোদি সরকারকে দায়ী করা হবে। ইতোমধ্যে বিরোধী দলগুলো ভারতের আজকের এই পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দূষছে। ২১টি দল যৌথ বিবৃতিতে বলেছে যে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর ত্যাগ স্বীকারকে শাসক দলের নেতা নগ্নভাবে রাজনীতিকরণ করছেন। অর্থাৎ পরিস্থিতির নিষ্পত্তি ভারতের অনুকূলে না হলে তার জন্য মোদিকে ব্যক্তিগতভাবে টার্গেট করা হবে। অর্থাৎ আজকের যে পরিস্থিতি তা অব্যাহত থাকলে ভারতের জয় হয়েছে একথা বলা মোদির জন্য কঠিন হবে। এতে লৌহমানব হিসেবে মোদির ভাবমূর্তিও ম্লান হবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের যে পথ মোদির জন্য খোলা তা আরও বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। সেটা হলো সংঘর্ষের বিস্তার ঘটানো। সংঘর্ষ বিস্তৃত হলে শেষ পর্যন্ত ভারতের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হবে এবং সেটা ভারতের বিজয় হিসেবে গণ্য হবে। তবে যে কোন সংঘর্ষের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ফলে যুদ্ধ তখন দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেবে। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধও ভারতের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে তবে তার জন্য ভারতকে অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট মূল্য দিতে হবে। ভারতীয় জনগণের সমস্যাবলী প্রকট থেকে প্রকটতর আকার ধারণ করবে। সেগুলো মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হবে সরকারকে। তার চেয়েও অনেক ভয়াবহ বিপদ আছে। যুদ্ধের বিস্তার এমন এক পর্যায়ে উপনীত হবে যখন পাকিস্তান কোণঠাসা হয়ে পড়বে। এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহ’র্ত। নিজের পরাজয় আঁচ করতে পেরে পাকিস্তান পরমাণু বোমা ব্যবহারে দ্বিধা করবে না। ভারতও তখন পাল্টা পারমাণবিক হামলা চালাবে। যুদ্ধ তখন পরমাণু যুদ্ধের রূপ নেবে। পরমাণু যুদ্ধ মানেই দুটি দেশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। কোন পক্ষেরই জয় হবে না। আর সেই যুদ্ধের ধ্বংসলীলা গোটা বিশ্বকে গ্রাস করবে। সুতরাং মোদির জন্য এ মুহূর্তটা অতি বিপজ্জনক-সংঘর্ষ একেবারে বন্ধ করা নাকি সংঘর্ষের বিস্তার ঘটানো। কোন পথে যাবেন তিনি? সূত্র : দি ইকোনমিস্ট ও অন্যান্য
×