ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গ্রাম শহর হবে, শহরেও গ্রাম আছে -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ২১ মার্চ ২০১৯

গ্রাম শহর হবে, শহরেও গ্রাম আছে -স্বদেশ রায়

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’। নির্বাচনী ইশতেহারে এটা যোগ করার প্রায় এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, এবার ক্ষমতায় আসতে পারলে প্রতিটি গ্রামকে শহর বানানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর ওই ভাষণের নিউজে জনকন্ঠে শিরোনাম করেছিলাম, ‘গ্রাম হবে শহর’। প্রধানমন্ত্রী যে সময়ে বলেছেন, গ্রামকে তিনি শহর বানাবেন, ততদিনে তিনি গ্রামকে অনেকখানি বদলে ফেলেছেন। বাস্তবে আজকাল অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে গ্রাম ও মফস্বল শহরগুলোর ভেতর খুব বেশি পার্থক্য নেই। আর এভাবে দশ বছর চললে স্বাভাবিকভাবেই অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে শহর ও গ্রামের কোন পার্থক্য থাকবে না। তাই, যে কাজটি স্বাভাবিক পথেই হচ্ছে, সেটা নিয়ে এমন কর্মসূচী নেবার দরকার কেন পড়ল? কেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটা তাঁর অন্যতম কর্মসূচী হিসেবে নিলেন? প্রধানমন্ত্রীসহ এই কর্মসূচী প্রণয়নকারীরা এ বিষয়ে পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। তবে বর্তমান পৃথিবীতে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি সন্ত্রাসকবলিত দেশ ও আফ্রিকার কয়েকটি দরিদ্র দেশ ছাড়া সব দেশই উন্নয়নের পথে ছুটছে। এই উন্নয়নের পথে যারা ছুটছে তাদের শীর্ষে রয়েছে চীন। আর দ্রুত গতিশীল যে দেশগুলো তার একটি বাংলাদেশ। তাই উন্নয়নের চূড়ায় যে দেশগুলো পৌঁছে যাচ্ছে তাদের অর্থনীতি ও সমাজে যে সব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, তার দিকে নজর রেখেই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নের পথে দ্রুত গতিশীল দেশগুলোকে এগুতে হবে। চীন অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে গ্রাম ও শহর বা বড় শহর ও ছোট শহরগুলোকে অনেকাংশে একই সমান্তরালে নিয়ে এসেছে। তারপরেও সাংহাইয়ের পাশের ছোট শহর বা গ্রামগুলো থেকে মানুষ সাংহাইতে চলে আসতে চায় বা চলে আসছে প্রতিনিয়ত। এর প্রথম কারণ কাজ। ছোট শহর থেকে সাংহাইতে এলে তারা কাজ পায় বেশি। তুলনামূলক কাজের মজুরিও বেশি পায়। অর্থাৎ, চীন এত উন্নয়নের পরেও ছোট শহর থেকে বড় শহরে আসা বা গ্রাম থেকে শহরে আসা বন্ধ করতে পারছে না। শহর ও গ্রামের পার্থক্য সেখানে থেকে যাচ্ছে। অবকাঠামোগতভাবে কোন পার্থক্য না থাকলেও আয়ের ও কাজের সুবিধার পার্থক্য থেকে যাচ্ছে। আর এটাই বড় শহর, ছোট শহর ও গ্রামের মধ্যে পার্থক্যটা রেখে দিচ্ছে। বাংলাদেশে তাই গ্রামকে শহরে পরিণত করতে গেলে প্রথমেই গ্রামের মানুষকে গ্রামে রাখতে হবে। মানুষ যতক্ষণ শহরমুখী হবে ততক্ষণ গ্রামের অবকাঠামো যাই হোক না কেন ওটা গ্রামই থেকে যাবে। গ্রাম হবে শহর এই কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার প্রথম শর্ত হলো, গ্রামে শহরের সমান আয়ের ও কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা উৎপাদনশীল ও স্থায়ী কাজের মাধ্যমে করতে হবে। টেলিফোন টাইকুন থাকসিন সিনহট যখন থাইল্যান্ডের ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি একটি সহজ পথে এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়েছিলেন। তিনি প্রতিটি গ্রামে নগদ অর্থ প্রবাহের ব্যবস্থা করেছিলেন। সাধারণ মানুষকে অর্থ সাহায্যও করেছিলেন। কিন্তু এই ফিডিং অর্থনীতিতে কোন লাভ হয়নি। বাস্তবে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় অবধি সরকারী সহায়তা, ভাতা এসব দিয়ে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করে দেয়া যায়। তবে, এতে মানুষকে গ্রামে যেমন রাখা যায় না তেমনি শহর ও গ্রামের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য তাও দূর করা যায় না। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হলে মূলত দেশজুড়ে কাজের সংস্থানের বিষয়টি সঠিকভাবে ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চীন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ থেকে বাংলাদেশের সুবিধা হচ্ছে- দেশটি ছোট ও প্রায় সবটুকুই সমতল ও উর্বর এলাকা। এছাড়া দেশের সব স্থানকে সহজে নৌবন্দর, স্থলবন্দর ও আকাশ বন্দরের সঙ্গে যোগ করা যায়। তাই, উৎপাদনমুখী যে কোন কাজের স্থান দেশের যে কোন প্রান্তে তৈরি করা যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের কম জমির কথা বিবেচনায় রেখে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিল্প কারখানা দেশের যে কোন স্থানে তৈরি করা সম্ভব। কারণ, মোটামুটি দেশের সব স্থানেই নৌযোগাযোগ ও রেল যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। যাতে শিল্প কারখানা তৈরির জন্যে ভারি কোন যন্ত্রপাতি টানায় কোন অসুবিধা নেই। বাংলাদেশের বর্তমান অবকাঠামো বিবেচনায় এবং যে সব অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে সব মিলে এখন বলা যায়, শেখ হাসিনা অত্যন্ত সঠিক সময়ে গ্রামকে শহর বানানোর কর্মসূচী হাতে নিয়েছেন। এখন থেকে মাস্টার প্ল্যান নিয়ে এগুলোয় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য কম রেখে দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। কম রেখে কথাটা এ কারণেই বলছি যে, শতভাগ অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয় এবং সেটা একটি অবাস্তব চিন্তা। সব সময় উন্নয়নের পথে সে চেষ্টাই ভাল যে বৈষম্যকে সর্বোচ্চ কতটা দূর করা যায়। এই বৈষম্য সর্বনিম্ন রেখে এগুতে হলে দক্ষতাও যাতে রাজধানীতে বা বড় শহরেই সীমাবদ্ধ হয়ে না পড়ে সে বিষয়টি সবার আগে সামনে আসে। দক্ষতা বড় শহরকেন্দ্রিক বা রাজধানীকেন্দ্রিক হয় এ কারণে যে স্পেশালাইজড সব কিছু রাজধানী বা বড় শহর ঘিরে গড়ে ওঠে। এটাকে ছড়ানো সম্ভব হয় না যে সব কারণে তার ভেতর শুধু অর্থনীতি থাকে না সামাজিকও অনেক কিছু থাকে। এগুলো দূর না করলে গ্রামকে শহর বানানো যায় না। কারণ, গ্রামে যদি দক্ষতা ব্যবহারের সুযোগ না থাকে তাহলে দক্ষতা সহজেই শহরে চলে আসবে। যেমন এই যে তথ্যপ্রযুক্তি, বলা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে হিসাব করলে শহরে বেশি ছড়িয়েছে, গ্রামে অনেক কম ছড়িয়েছে। কারণ, গ্রামে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে শুধু বাংলা ভাষার মাধ্যমে। কিন্তু এর শতভাগ না হোক সিংহভাগ ব্যবহার করতে হলে ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে করতে হবে। এই ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির সিংহভাগ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে কিন্তু কেবল শহরের কিছু লোক। একটা ছোট্ট উদাহরণ, যেমন রাজধানীর হাতেগোনা কয়েকটি স্কুলই শহরের স্কুল। বাদবাকি স্কুল গ্রামেরই স্কুল। মানের দিক থেকে রাজধানীর স্কুলগুলোর সঙ্গে গ্রামের স্কুলের কোন পার্থক্য নেই। রাজধানীতে অল্প কিছু মানুষই রাজধানীর সকল সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারের যোগ্যতা রাখে। বাদবাকিদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সব মিলিয়ে হিসাব করলে দেখা যাবে তারা রাজধানীতে বসেও গ্রামে বাস করছে। এই অবস্থা চীনও দূর করতে পারেনি। তারা সাংহাই শহরের বাসিন্দাদের বিশেষ সুবিধা দিয়েও সমাধান করতে পারছে না। সেখানে গ্রামের, ছোট শহরের কম দক্ষ মানুষ এসে কম সুবিধাতে সন্তুষ্ট হয়ে বাস করছে। বাংলাদেশেও রাজধানীতে নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভাল, আমাদের কিছু প্রযুক্তিবিদ মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তির সব সুবিধাই বাংলা ভাষার মাধ্যমে, বাংলা ভাষা জ্ঞান দিয়েই ব্যবহার করা যাবে। তাদের সঙ্গে বিতর্কে যাবার জ্ঞান আমার নেই। তবে বাস্তবতা যেটা দেখছি, চীন বা জাপান, তারা তাদের ভাষায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তারপরেও সেখানে যারা ইংরেজীতে দক্ষ তারাই প্রায় শতভাগ তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে। গ্রাম ও শহরের পার্থক্য ঘোচাতে গেলে এ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য ইতোমধ্যে তাঁর এক ভাষণে শিশুদের তিন চারটি ভাষা শেখানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। বাস্তবে এটাও তাঁর গ্রামকে শহর তৈরির একটি প্রস্তুতি। গ্রাম ও শহর মূলত অবকাঠামোর পার্থক্যটাই নয়। এর থেকে বড় পার্থক্য হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত বৈষম্য। এই বৈষম্য আমাদের কোন্ এলাকার গ্রামে কেমন পর্যায়ে আছে, কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে আছে, এমনকি শহরের মধ্যে কতটা আছে এসবই আগে চিহ্নিত করতে হবে। আর এই বৈষম্য দূর করার জন্য মোটামুটি একটা দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচী প্রয়োজন। ওই কর্মসূচীর যতটা বাস্তবায়ন হবে গ্রাম ততটাই শহর হবে। [email protected]
×