ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ১১:১০, ২১ মার্চ ২০১৯

অগ্নিঝরা মার্চ

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতি খুঁজে পেয়েছিল তার শেকড়ের সন্ধান। বাংলাদেশের হাজার বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন খ-িত ইতিহাস ছাপিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ মূর্ত করেছে আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতা। ২৩ বছরের পাকিস্তানী শাসন থেকে এই দেশকে মুক্ত করতে অনেক রক্ত ঝরেছে। অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে এক একটি স্মরণীয় মুহূর্ত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, জেড এ ভুট্টোর সঙ্গে দফায় দফায় চলে রুদ্ধদ্বার বৈঠক-আলোচনা। কিন্তু এর আড়ালে ছিল অন্যকিছু। পৃথিবীর ইতিহাসে আলোচনার নামে এতবড় প্রহসন আর হয়েছিল বলে মনে হয় না। বাঙালী জাতি পথ খুঁজে নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সকল নির্দেশনা ছিল সেখানে। তার ওপর ভিত্তি করে প্রস্তুতি চলছিল সমগ্র বাংলাদেশে। একদিকে অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলাদেশে। অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণ, ছাত্রদের কুচকাওয়াজ এবং মুক্তিযুদ্ধের আনুষঙ্গিক প্রস্তুতির কার্যক্রম। আজ দেশব্যাপী চলমান অসহযোগ আন্দোলনের ২১তম দিন। সরকারী-বেসরকারী ভবনে কালো পতাকা। মিছিল প্রতিটি জেলাশহরে, শহরের প্রতিটি রাস্তায়। সকালে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পঞ্চম দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পূর্বে তার নিজ বাসভবনে বিশিষ্ট আইনজীবী এ কে ব্রোহির সঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনায় মিলিত হন। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ৫ম দফা বৈঠকের সময় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের বিংশতম দিনে মুক্তিপাগল হাজার হাজার মানুষের দৃপ্ত পদচারণায় রাজধানী ঢাকা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত মিছিল ‘জয়বাংলা’, ‘জয়বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান তুলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে এগিয়ে চলে। সেখানে মুক্তি অর্জনের শপথ নিয়ে মিছিল যায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। বিকেলে চট্টগ্রামে ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসভায় বলেন, আলোচনায় ফল হবে না। এদেশের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে চাপরাশি পর্যন্ত যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে মানে না, তখন শাসন ক্ষমতা শেখ মুজিবের হাতে দেয়া উচিত। ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে সেনা মোতায়েন করা হয়। সাংবাদিকদের বিমানবন্দরে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। ভুট্টোকে বিমানবন্দর থেকে হোটেল ইন্টার-কন্টিনেন্টালে নিয়ে আসার সময় রাস্তার দুপাশে পথচারীরা ভুট্টোবিরোধী স্লোগান দেয়। সন্ধ্যায় পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো কড়া সেনা প্রহরায় প্রেসিডেন্ট ভবনে যান। সেখানে ভুট্টো দু ঘণ্টারও বেশি সময় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক শেষে হোটেলে ফিরেই ভুট্টো তার উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। এর আগে হোটেল লাউঞ্জে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের ভুট্টো বলেন, এ মুহূর্তে আমি এটুকু বলতে পারি যে, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। ভুট্টো সাংবাদিকদের আর কোনো সময় না দিয়ে সরাসরি লিফটে চড়েন। সাংবাদিকরা তার সহগামী হতে চাইলে ভুট্টোর ব্যক্তিগত প্রহরীরা অস্ত্র উঁচিয়ে বাধা দেয়। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে জারিকৃত কারফিউ দুপুর ১২টায় ৬ ঘণ্টার জন্য প্রত্যাহার করা হয়। পরে সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পুনরায় কারফিউ বলবৎ করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন আগামী ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচীর প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করে। স্বাধীন বাংলাদেশ শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য বর্জন সপ্তাহ পালনের কর্মসূচী ঘোষণা দেয়। মগবাজারে মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক মহিলা সমাবেশে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন বাঙালী সৈনিকদের নিয়ে একটি প্যারা-মিলিটারি ফোর্স গঠনের আহ্বান জানানো হয়। বিক্ষুব্ধ লেখক-শিল্পীরা শহীদমিনারে বিপ্লবী সাহিত্য ও গণসঙ্গীতের আয়োজন করেন। বঙ্গবন্ধু মিছিলকারীদের উদ্দেশে বলেন, জনতার জয় অবধারিত। অন্যদিকে, প্রতিদিন ৬ থেকে ১৭টি পিআইএ ফ্লাইট, বোয়িং ৭০৭ বিমান ও জাহাজযোগে সেনা ও যুদ্ধ রসদ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী থেকে শ্রীলঙ্কার কলম্বো হয়ে ঢাকা আসতে থাকে। জেনারেল ইয়াহিয়া তার সামরিক উপদেষ্টা জেনালের হামিদ খান, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা প্রমুখদের নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে (ইস্টার্ন হেডকোয়ার্টারস) সামরিক প্রস্তুতি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে প্রয়াসী হন।
×