ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মঞ্চে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

প্রকাশিত: ১২:৩০, ২১ মার্চ ২০১৯

মঞ্চে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

নানা আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনার পর শেষাবধি তৃপ্তি নিয়ে পর্দা নামল স্পর্ধা প্রযোজিত ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নাটকের। শহীদুল জাহীরের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস অবলম্বনে নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন কিংবদন্তি নাট্য ব্যক্তিত্ব সৈয়দ জামিল আহমেদ। মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা করেছেন তিনি নিজেই। ১৭ মার্চের মঞ্চায়ন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন উপলক্ষে উৎসর্গ করা হয়েছে। সপ্তাহব্যাপী মঞ্চায়নে দর্শকের উপস্থিতি ও মত প্রকাশের মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে এটি ছিল নিঃসন্দেহে একটি সফল মঞ্চায়ন। জাতীয় নাট্যশালার বিশাল মঞ্চজুড়ে কুশলীদের শারীরিক কসরত ও দৃশ্যের পর দৃশ্য দিয়ে একশত বিশ মিনিটের যে মালা গাঁথা হয়েছে তা ঐকান্তিক পরিশ্রম আর ভালবাসারই নামান্তর। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-নির্ভর শিল্পসৃষ্টির তাগিদ থেকে মঞ্চায়নের যে প্রয়াস তা আক্ষরিক অর্থেই প্রতিফলিত হয়েছে। ব্যাপক বিস্তৃত মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো আর একটি নাটক দিয়ে তুলে আনা সম্ভব নয়। পুরাতন ঢাকার একটি ছোট্ট মহল্লায় যুদ্ধকালীন সময় ও তার পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই নাটকের মূল উপজীব্য ছিল। নাটকে কিছু স্যাটায়ার করা হয়েছে। যেমন বদু মাওলানার নির্দেশে একদিনে সাতজন এলাকাবাসীকে হত্যা করা হয় এবং তিনজন নারীর শ্লীলতাহানি করা হয়। ঠিক তখন বদু মাওলানা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে কারণ তার আদরের সন্তানের পালিত কুকুরটা মারা যায়। এরই নাম নাটকীয়তা। আবার পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন জনসম্মুখে প্রশ্রাব করে যখন বদু মাওলানার গায়ে হাত মুছে তখন সে সুগন্ধী মাখা আলখাল্লা যতœ করে সংরক্ষণ করে। এটাই বাস্তবতা। এই কঠিন বাস্তবতাকে মঞ্চায়িত করতে পারলেই ইতিহাস সঠিক জায়গা খুঁজে পাবে। নাটকটি নিয়ে গুণীজন নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেছেন, ‘বিরক্তিকর লেগেছে, উপন্যাসটাই পড়ে গেছে বাগবাগ করে। নাটকীয়তা ছিল না। এক কথায় আশাহত। তিনি নাটকে ইতিহাস বিকৃতির কথাও উল্লেখ করেছেন।’ তবে বেশিরভাগ দর্শকই ইতিহাস বিকৃতির কথায় একমত পোষণ করেননি। অধ্যাপক আবদুস সেলিমের মতে ‘খুব যে ভাল লেগেছে বলব না। বার বার একই বিষয় চলে এসেছে। উপন্যাসের একটা নিজস্ব ঢং আছে। লেখক ঘুরে ফিরে কিছু ঘটনাকে বার বার সামনে নিয়ে আসেন ইচ্ছাকৃতভাবে। নাটকে উপন্যাসের সেই ছাপ রয়ে গেছে।’ উনাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আরেক নাট্যমহারথী আতাউর রহমান বলেন, ‘বাচ্চাদের ওয়ার্কশপ হয়েছে। সংলাপ ও মুভমেন্টের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।’ উল্লেখ্য, দর্শকদের মধ্যে অনেক নাট্যকর্মী ছিলেন। তাদের কাছে নাটক খুব ভাল লেগেছে। দুই ঘণ্টাব্যপী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখেছেন। কোথাও কোন ছেদ ঘটেনি। এত বড় মঞ্চ পুরোটাকে ব্যবহার করে মুভমেন্ট ও সংলাপের মধ্য দিয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন প্রযোজনার জন্য নির্দেশককে ধন্যবাদ দিয়েছেন। সৈয়দ জামিল আহমেদ সরাসরি আমার শিক্ষক। উনার আরও প্রযোজনা আমি দেখেছি। প্রথমেই বলব জামিল আহমেদ যে ধরনের নির্দেশনা ইতিপূর্বে দিয়েছেন এ নাটকটি সে মানের হয়নি। পুনরাবৃত্তির বিষয়টি আমারও চোখ এড়ায়নি। তবে নাটকে ইতিহাস বিকৃতির মতো কিছু হয়নি। পুরো মঞ্চটা সবসময় ব্যবহার হয়নি। তাই মঞ্চটাকে আরও একটু ছোট করলে হয়ত ভাল লাগত। ডিজাইনিংয়ের জায়গা যেমন লাইট, সেট, কস্টিউমেও জামিল আহমেদের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রিজওয়ান দেখার পর যে তুষ্টি নিয়ে দর্শকদের হল ত্যাগ করার অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছিল এ নাটকে দর্শকদের মাঝে সেই ভাললাগাটা দেখা যায়নি। এ বিষয়ে নির্দেশকের ব্যাখ্যা ছিল, ‘বিতর্ক হয় না মৃতের। বিতর্ক মানে আপনার সঙ্গে মেলেনি। তার মানে এটি ছুড়ে ফেলে দেয়া নয়। ভিন্নমত আসতে পারে বা আসবেই, তাতে শঙ্কিত বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তিনি আরও বলেন পাবলিক স্পেস দিনে দিনে সংকোচিত হচ্ছে। সিভিল সোসাইটি সবসময় সরকারের সঙ্গে বড় ভূমিকা পালন করে। ভিন্ন রকম কথা না আসলে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় সুবিবেচনার পথ দেখাতে পারে না। বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন ৬৬’ ৬৯’এর ধারাবাহিকতায় ৭১ এ মানুষটির ডাকে আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম। নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশকে ভালবেসে এ নাটক নির্দেশনা দিয়েছি। নাটক কেমন হয়েছে বিবেচনার ভার দর্শকের।’ আশার কথা এই, শিল্পকলা চত্বর মুখরিত হয়েছে দর্শকের উপস্থিতিতে। মানুষ মঞ্চমুখী হচ্ছে। সংস্কৃতি চর্চার লীলাভূমি এ বাংলা ফিরছে তার নিজস্ব সংস্কৃতিতে।
×