ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : লিওনিদ বারশিদস্কি;###;রূপান্তর : এনামুল হক

ইংরেজী আর ইংরেজদের ভাষা নয়

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ২২ মার্চ ২০১৯

ইংরেজী আর ইংরেজদের ভাষা নয়

ব্রেক্সিট নিয়ে যে তামাশা চলছে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেরূপ অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তার ফলে এ্যাংলোস্ফিয়ারের ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ্যাংলোস্ফিয়ার বলতে বোঝায় ইংরেজী ভাষাভাষী দেশ ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক প্রভাব। আমেরিকান ও ব্রিটিশরা বাইরের পরিমণ্ডল থেকে নয় বরং তারা তাদের নিজেদের পরিচিত ও অভ্যস্ত পরিম-লের ভেতর থেকেই ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী মাতৃভাষা ইংরেজীতে কথা বলা মানুষের সংখ্যা মাত্র ৩৭ কোটি ৯০ লাখ। অথচ প্রায় ১৭০ কোটি লোক দরকারি পর্যায়ে ইংরেজীতে কথা বলে থাকে। এ কারণেই এটা দীর্ঘদিন সুনিশ্চিত হয়েছিল যে অন্য যে কারোর চাইতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কণ্ঠই অধিকতর উচ্চকিত ছিল। এমন কোন লক্ষণ নেই যার ভিত্তিতে বলা যায় যে ওই দুই দেশের সফট্্ পাওয়ার বা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব সাম্প্রতিককালে খর্ব হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজী ভাষার জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে। গত বছর ব্রিটিশ কাউন্সিলের পূর্বাভাস ছিল যে ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ইউরোপে সম্ভাব্য ইংরেজী ভাষা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮.৮ শতাংশ বা প্রায় ১ কোটি ৫৩ লাখ হ্রাস পাবে। এর সঙ্গে ব্রেক্সিটের কোন সম্পর্ক নেই। ইউরোপের স্কুলগুলোতে ইংরেজী শিক্ষার প্রসারের ফলে ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালিত ইংরেজী শিক্ষা কোর্সের চাহিদা হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজীর বাজার বছরে ১৭ শতাংশ করে বেড়ে ২০২৪ সালে ২২০০ কোটি ডলারে পৌঁছবে বলে পূর্বাভাষ রয়েছে। সেটা বহুলাংশে এশিয়ায় ইংরেজীর অতৃপ্ত চাহিদার কারণেই হবে। আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে ইংরেজী শিখেছি। আমাকে স্বীকার করতে হবে যে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সফট্ পাওয়ার তথা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের কারণেই আমি এই ভাষা শিখেছি। আমি রক সঙ্গীতের লিরিক বা কথাগুলো বুঝতে চেয়েছি। মূল ভাষায় হলিউডের ছায়াছবিগুলো দেখতে চেয়েছি এবং এমন সব বই পাঠ করতে চেয়েছি যেগুলোর অনূদিত রূপ ছিল না। তবে ১৯৮০-এর দশকে মস্কোতে আমাকে যে উন্নত মানের ইংরেজী ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছিল তার কারণ এগুলো ছিল না। ইংরেজী ছিল প্রতিপক্ষের মাতৃভাষা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের ভক্ত ছিলেন না। তবে দোভাষী ছাড়াই অন্যান্য বিদেশী নেতার সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনি এদের ইংরেজী ভাষা ভালভাবেই রপ্ত করেছিলেন। ইংরেজী ভাষাকে এড়িয়ে যেতে পারা অসম্ভব। বিশ্বে যত ওয়েবসাইট আছে তার ৫৪ শতাংশই ইংরেজী ভাষায়। ইংরেজীর পর সবচেয়ে ব্যাপক পরিসরে চালু ভাষা হচ্ছে রুশ ভাষা। তাও ৬ শতাংশ। গুগলের বিষয়বস্তু সবচেয়ে জনপ্রিয় যে ভাষায় অনুবাদের জন্য অনুরোধ করা হয়ে থাকে তা হলো ইংরেজী। বিশ্বের একাডেমিক সমাজের লোকজন ইংরেজী ভাষায় কথা বলে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ শুধু এই কারণেই যে তারা ইংরেজী ভাষায় বলেন তা নয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবই যদি কাল বন্ধ হয়ে যায় তারপরও তাদের একটা অভিন্ন ভাষা প্রয়োজন এবং তারা যে আরেকটা ভাষা অবলম্বন করার জন্য ভোট দেবেন তা নয়। বিশ্বের রাজনৈতিক সম্প্রদায়ও তা করবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিষয়টা এখানে উল্লেখ করার মতো। ব্রেক্সিটের পর ইংরেজী ভাষা এই জোটের কাজের ভাষাগুলোর অন্যতম হিসেবে তার মর্যাদা হারাতে পারে। কারণ ইইউর বাকি সদস্য দেশগুলোর কেউই ইংরেজীকে সরকারী ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে না। তথাপি ইইউর সকল পরিচালন সংস্থার আইন বিভাগগুলো একমত হয়েছে যে ইংরেজী সূক্ষ্ম এই যুক্তিতে তার মর্যাদা অক্ষুণ্ণণ্ণ রাখতে পারে যে এই ভাষা আয়ারল্যান্ড ও মাল্টার আইনে ব্যবহৃত হয়। পূর্ব ইউরোপের সকল কর্মকর্তা যারা কখনই ফরাসী বা জার্মান ভাষা শেখেনি তাদের জন্যও ইংরেজী হলো লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বা আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা। ব্রেক্সিটের পরও ইংরেজী ইইউতে সবচেয়ে ব্যাপক পরিসরে কথ্য ভাষা হিসেবে জার্মান ভাষার সঙ্গে সমমর্যাদা লাভ করবে- অর্থাৎ যতক্ষণ অস্বদেশীয় ভাষাভাষীদের হিসাবের মধ্যে গণ্য করা হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্রেক্সিট-উত্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা এ্যাংলোস্ফিয়ারের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। এক বিশাল আমলাতন্ত্র ও গোটা রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্ট ইংরেজীতে এজেন্ডা নির্ধারণ করবে। কিন্তু ইংরেজী যে দেশের ভাষা সে দেশের কোন বক্তা তাতে অংশ নেবে না। সুইডেনের গ্যাভলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কো মদিয়ানো সম্প্রতি এক নিবন্ধে (ইংরেজীতে লেখা অবশ্যই) লিখেছেন : ‘ইংরেজী ভাষা নিজেকে এক অনন্য শয্যাসঙ্গী হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ইংরেজী ভাষা ব্যবহারের সময় ইইউ নাগরিকরা সবাই একই অবস্থানে থাকবে। অর্থাৎ তারা দ্বিতীয় একটি ভাষায় যোগাযোগ করবে এবং সেই কারণে খুব সামান্য সংখ্যক লোক অন্যায় সুবিধা পাবে।’ ‘ইউরো ইংরেজী’তে ‘ইনফরমেশনস’-এর মতো বহুবাচনিক শব্দ, ‘অফ’-এর মতো পদান্বয়ী অব্যয়ের অতিব্যবহার কিংবা ‘উইওয়্যার ফাইভ পিপল এ্যাট দ্য পার্টি’র মতো বাক্য গঠনের বৈচিত্র্য রয়েছে। এই ইউরো ইংরেজী ইতোমধ্যেই একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। ইংরেজী যে দেশের ভাষা সে দেশের বক্তাদের তত্ত্বাবধানে ব্যতিরেকেই একে ছেড়ে দেয়া হলে ইউরো ইংরেজী এক পৃথক পথ ধরে ভালভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে। ঠিক যেমন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন পরবর্তী এশিয়ায় ইংরেজীর ক্ষেত্রে ঘটেছে। এই ইংরেজী আরও বেশি ধ্বনিগত ও আভিধানিক বিশেষত্ব এবং সেই এর নিজস্ব বাগধারাগত সম্পদ অর্জন করেছে। ব্রিটেনরা এই ইংরেজীকে বাজে ইংরেজী বলতে পারে। কিন্তু অইংরেজ বক্তা হিসেবে আমি বলব না। লোকে শিশু বয়সে যে ভাষায় কথা বলতে শিখেছে সে ভাষার অধিকারী হয় না। তেমনি দেশগুলোও তাদের সরকারী ভাষার ওপর তাদের স্বত্ব¡াধিকার দাবি করতে পারে না। এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো বিষয় ব্রেক্সিট পরবর্তী ইউরোপীয় ইউনিয়নই শুধু নয়, এমনকি চীন যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যায় তার পরও সে দেশের কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা তাদের এ সংক্রান্ত কাজকর্মকে এক ধরনের ইংরেজীতে (কতকটা বিচিত্র) বর্ণনা করবে। একাডেমিক ক্ষেত্রে চীনা পণ্ডিত ব্যক্তিদের ইংরেজীতে লেখা গবেষণাপত্র ও নিবন্ধের সম্প্রতি যে রূপ প্রসার ঘটেছে তা থেকে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ বছরের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সংস্থা ইউনেস্কো থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইংরেজী প্যারিসভিত্তিক এই সংস্থার ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ বা যোগাযোগের ভাষা হিসেবেই থেকে গেছে যদিও সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে ইংরেজীর আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুগিয়েছে। ইংরেজী ভাষা ১৯৮০-এর দশকে উদ্ভাসিত ভারতীয় ভাষাবিদ ব্রজ কাচরুর জনপ্রিয় ‘ত্রি-বৃত্ত মডেল’ থেকে বেরিয়ে এসেছে : নেটিভ ইংরেজী ভাষাভাষী দেশগুলোর অন্তর্বৃত্ত, সাবেক উপনিবেশগুলোর বহিঃবৃত্ত, এবং অন্য সকল দেশের প্রসারমান বৃত্ত যেখানে এই ভাষাটি প্রথম দুটি বৃত্তের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য শেখা হয়েছে। এখন লোকে কতটা ব্রিটেন বা আমেরিকানদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইংরেজী শিখে তেমনি শিখে অন্যান্য নন-নেটিভ (যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে) ভাষাভাষীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। এই যোগাযোগের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সুপরিচিত নয় এমন সব গল্পকাহিনী, ধ্যান-ধারণা ও রীতিনীতি এবং এই দেশ দুটিতে প্রত্যাখ্যাত হয় এমন সব বিষয় যার মধ্যে রয়েছে কর্তৃত্ববাদী ধারণা, রাজনৈতিক দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার সমালোচনা। এসব কথোপকথন বা সংলাপের সবগুলোর উদ্দেশ্য আমেরিকান ও ব্রিটেনরা যা করেছে ঠিক সেভাবেই তাদের তা ফিরিয়ে দেয়া নয় এবং এসব কিছুর জন্য তাদের ইনপুটের প্রয়োজনও পড়ে না। তবে এসব কিছুই ঘটছে বহুল সম্প্রসারিত এ্যাংলোস্ফিয়ারে যেখানে ইংরেজী ভাষার ওপর অধিকতর ভাল দখল থাকায় মানুষকে আলোচনা নমনীয় করার কিংবা এর সুর কি হবে তা নির্ধারণ করে দেয়ার দরকার পড়ে না। তারপরও অবশ্য আলোচনার প্রসঙ্গ এলে ব্রিটিশ ও আমেরিকান বক্তারা এখনও এক ধরনের অন্যান্য সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু সেটা আর কঠিন বা নরম কোন ধরনের ক্ষমতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত নয়। সেই দিক দিয়ে ইংরেজী ঠিক ডলারের মতো নয়। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারের যেরূপ আধিপত্য আছে, বৈশ্বিক সংলাপ বা কথোপকথনে ইংরেজীর ঠিক তেমন আধিপত্য নেই। আমরা সবাই আমাদের নিজস্ব ভার্সন বা সংস্করণ তৈরি করি এবং আজকের দিনে এ সবই হলো বৈধ মুদ্রা। [রুশ লেখক লিওনিদ বারশিদস্কি ‘ব্লুমবার্গ অপিনিয়ন’ সাময়িকীর ইউরোপ বিষয়ক কলাম লেখক। তিনি থাকেন বার্লিনে] সূত্র : দি জাপান টাইমস
×