ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এলিজা খান

গণহত্যা ১৯৭১ ॥ পটিয়ার মুজাফরাবাদ

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ২২ মার্চ ২০১৯

গণহত্যা ১৯৭১ ॥ পটিয়ার মুজাফরাবাদ

‘বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে মাহবুব উল আলম লিখেছিলেন, যদি গণহত্যা কাকে বলে দেখতে চান, তাহলে মুজাফরাবাদ গ্রামে এসে দেখে যান। সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক নাসিরউদ্দিন চৌধুরী মুজাফরাবাদকে তুলনা করেছেন কুখ্যাত ‘মাইলাই’-এর সঙ্গে। পাকিস্তান বাহিনী এবং স্থানীয় রাজাকার ও মুসলিম লীগ যেভাবে হত্যাযজ্ঞ, লুটতরাজ ও নারী নির্যাতন চালিয়েছিল, তা মানবেতিহাসে এক জঘন্যতম অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। মুজাফরাবাদ সেই জঘন্যতম অধ্যায়েরই একটি উদাহরণ। পটিয়া উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে আরাকান সড়ক সংলগ্ন মুজাফরাবাদ একটি ছবির মতন গ্রাম। তিন মে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিভীষিকাময় তা-বে চিত্রপটের এই গ্রামটি পরিণত হয় হত্যাযজ্ঞের এক ধ্বংসস্তূপে। প্রায় তিন শতাধিক শহীদের রক্ত ও দুই শতাধিক বীরাঙ্গনার আর্তনাদে ভারি হয়ে যাওয়া মুজাফরাবাদকে হয়তো ‘শহীদদের গ্রাম’ বলে চিহ্নিত করলেও কম হবে। একাত্তরের ষোলোই এপ্রিল পর্যন্ত মুজাফরাবাদ মূলত স্বাধীনভাবেই চালিত হয়েছে, তবে ওই দিন পটিয়া কলেজ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আক্রমণের মধ্য দিয়ে পটিয়ায় প্রশিক্ষণার্থী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙ্গে পড়ে এবং মুজাফরাবাদসহ সম্পূর্ণ দক্ষিণ চট্টগ্রাম পাকিস্তান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পাকিস্তান আর্মি ধারণা করে যে, মুজাফরাবাদ গ্রামটি আসলে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম এবং এখানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরা লুকিয়ে আছে এবং গ্রামের যুবকদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। তিন মে, সোমবার স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তান বাহিনী গ্রামটিকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। গ্রামের পূর্ব দিকে আরাকান সড়কে বসানো হয় ছয়টি ভারি কামান আর উত্তর সীমান্তের তমালতলা আশ্রমের সামনে দিয়ে পশ্চিমের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত এমনভাবে মেশিনগান বসানো হয়, যেন গ্রাম থেকে কেউ পালাতে না পারে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, মোট তিনটি জীপ নিয়ে পাকিস্তান বাহিনী দোহাজারী ক্যাম্প থেকে মুজাফরাবাদ গ্রামে প্রবেশ করে, শতাধিক পাকিস্তান সৈন্যের সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশজন স্থানীয় রাজাকার এই পৈশাচিক অভিযানে অংশ নেয়। ভোর থেকে শুরু হওয়া এই আক্রমণ চলে প্রায় দুপুর দুটো পর্যন্ত। মাত্র আট ঘণ্টায় পাকিস্তান আর্মি গ্রামের প্রায় তিন শ’ সাধারণ মানুষ হত্যা করে, জ্বালিয়ে দেয় প্রায় ছয়শ ঘর-বাড়ি, ধর্ষিত হন প্রায় দু’শ’ নারী। যারা পালাতে সক্ষম হয়, তারা গিয়ে আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী গ্রামে। কিন্তু নরপশুরা কাউকেই রেহাই দেয়নি, খাল-বিল-পুকুর, ঝোপঝাড় বা খড়ের গাদায়, গোয়ালঘর কিংবা পবিত্র উপাসনালয়- যেখানেই মানুষকে লুকিয়ে থাকতে দেখেছে, রাজাকারদের সহায়তায় তাদের খুঁজে বের করে হত্যা করেছে নির্মমভাবে। গ্রেনেড ফাটিয়ে, জ্বলন্ত ঘর ও খড়ের গাদায় বন্দুকের নল ঢুকিয়ে এমন কী আগুনের জ্বলন্ত মশাল ঢুকিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, অনেকে ভেতরে থাকা অবস্থায় আগুনে সেদ্ধ হয়েও প্রাণ হারিয়েছেন, মানুষকে জ্যান্ত জবাই করতেও পিছপা হয়নি পাকিস্তান বাহিনী। অমানবিক নির্যাতনের পর মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়েও গুলি করে হত্যা করা হয় বহু মানুষ। রক্তে ভেসে যায় মুজাফরাবাদের মাটি। ‘মুজাফরাবাদ গণহত্যা’র মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে সবার প্রথমে যার নাম আসে, সে রমিজ আহমেদ চৌধুরীÑ তৎকালীন মুসলিম লীগের পটিয়া অঞ্চলের সভাপতি ও খরনা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। মূলত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই বেশ কিছু বিষয়ে মুজাফরাবাদবাসীর সঙ্গে তার মতানৈক্য ছিল। স্থানীয় একটি স্কুলের নাম পরিবর্তনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রমিজ আহমেদের সঙ্গে এলাকার যুব সম্প্রদায়ের তিক্ততা চরমে ওঠে, রমিজ আহমেদ তার নামের আদ্যাক্ষর স্কুলটির নামের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইলে, এলাকাবাসীর তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে তা সফল হয়নি- ঘটনাটি ষাটের দশকের। পরবর্তী সময়ে তার এই বিদ্বেষ আরও তীব্র আকার ধারণ করে তৎকালীন ‘খরনা ইউনিয়ন মাল্টিপারপাস ব্যাংক’-এর বিরুদ্ধে তারই করা একটি মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার ঘটনার জের ধরে। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সে গ্রামবাসীকে শায়েস্তা করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। ষোলোই এপ্রিল পটিয়া পতনের পর পাকিস্তান বাহিনী যখন দোহাজারীর দিকে যাত্রা শুরু করছিল, তখন রমিজ আহমেদই তাদের মুজাফরাবাদ গ্রামটি চিনিয়ে গণহত্যায় ইন্ধন দেয়। সৃষ্টি হয় তিন মে ভয়াল রাতের, যেদিন বারংবার ধর্ষিত হওয়া নারীর আর্তচিৎকার, সন্তান হারা মায়ের কান্না, শৃগালে টেনে নেয়া লাশের বিকৃত রূপ, স্বামী-সন্তান হারা স্ত্রীর কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে পুরো গ্রাম, লাশের গন্ধে নিশ্বাস নেয়ার অনুপযোগী হয়ে ওঠে মুজাফরাবাদের নির্মল বাতাস। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্যাতিত নারী তার দেয়া সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আমার বয়স তখন কম... বাবা আমাকে রাজাকারদের ভয়ে ঘরের বাইরে যেতে দিতেন না... কিন্তু তারপরও আমি নিজেকে বাঁচাতে পারিনি। তিন মে যখন পাকিস্তানী হানাদাররা গ্রাম আক্রমণ করল আমি তখনও ঘুম থেকে উঠিনি। বাবার চিৎকারে ঘুম ভাঙে। আমি তাড়াতাড়ি করে খাটের তলায় ঢুকে যাই। প্রায় ঘণ্টাখানেক আমি এখানেই ছিলাম। এরপর পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের ঘর আক্রমণ করে, তিনজন পাকিস্তানী সেনা পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে। আমি প্রায় মৃতের মতো পরে থাকি... পাকিস্তানী বাহিনীর পাশাপাশি রাজাকাররাও আমাকে নির্যাতন করেছে। যাদের দু’জন আমার পূর্ব পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে রাজাকারদের ভয়ে আমি প্রায় সময় গায়ে কালি মেখে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতাম।’ ‘মুজাফরাবাদ গণহত্যা’র আরও ইতিহাস জানতে ‘গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘণ্ট’ গ্রন্থমালার তৃতীয় গ্রন্থ ‘মুজাফরাবাদ গণহত্যা’ পড়ার আহ্বান জানাচ্ছি। গ্রন্থটির লেখক চৌধুরী শহীদ কাদের। লেখক : গবেষণা কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র
×