ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আশ্রয় শিবিরে শরণার্থী আইন প্রয়োগ নেই, যেখানে-সেখানে অবাধ যাতায়াত

ক্যাম্পে হদিস নেই দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গার

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ২২ মার্চ ২০১৯

ক্যাম্পে হদিস নেই দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গার

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ রোহিঙ্গাদের বেলায় শরণার্থী আইন চালু না থাকায় ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা। নিবন্ধিত হওয়ায় ক্যাম্প ত্যাগ করলেও তাদের বিরুদ্ধে দেশে প্রচলিত আইন প্রয়োগ করতে পারছে না প্রশাসন। এতে তারা মিশে যাচ্ছে লোকালয়ে। বাসাভাড়া নিয়ে আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে শহরে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হচ্ছে প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে এদেশে থেকে যাওয়া। সূত্রে জানা যায়, বিএনপি সরকারের (জিয়াউর রহমান) আমলে অনুপ্রবেশকৃত বহু রোহিঙ্গা নেতা প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে থেকে গেছে এদেশে। বিদেশে গিয়ে এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য করে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ওসব রোহিঙ্গা। এদের এ ভাল অবস্থা দেখে নিবন্ধিত রোহিঙ্গারাও ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। মঙ্গলবার রাতে ক্যাম্প ত্যাগকারী ১২ রোহিঙ্গাকে একটি বাড়ি থেকে আটক করেছে চকরিয়া থানা পুলিশ। ইতোপূর্বে বান্দরবান, কক্সবাজার, এমনকি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকেও বহু রোহিঙ্গাকে আটক করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। পরবর্তীতে আটক রোহিঙ্গাদের ফের আশ্রয় শিবিরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, উখিয়া টেকনাফে আশ্রয় ক্যাম্পের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা বলেই তাদের বিরুদ্ধে দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মামলা টুকে দেয়া যাচ্ছে না। প্রত্যেহ শরণার্থী আইন বহির্ভূত কাজ করে চলেছে রোহিঙ্গারা। শরণার্থী আইন অনূসারে ক্যাম্প ত্যাগের প্রাক্কালে কয় ঘণ্টার জন্য বাইরে যাওয়া হচ্ছে, তা উল্লেখ করে ক্যাম্প ইনচার্জের কাছ থেকে অনুমতিপত্র নিতে হয়। রোহিঙ্গারা ওই নিয়মও মানছে না। তবে বেআইনী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার অপরাধে বহু রোহিঙ্গাকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা। সূত্রে প্রকাশ, বৈদেশিক নাগরিক আইন অনুসারে আটকের পর সাজা শেষ হওয়ায় সম্প্রতি ভারত সরকার দুই ধাপে ৩১ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সরকারের কাছে সোপর্দ করেছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশেও ঠিক একই নিয়ম ছিল। কক্সবাজার ছাড়াও বান্দরবানসহ উত্তরবঙ্গ থেকেও সাজা শেষে রোহিঙ্গাদের এনে উখিয়ার বালুখালী অথবা ঘুমধুমের সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার সরকারের সীমান্তরক্ষীদের নিকট সোপর্দ করা হতো। বিভিন্ন এনজিওর অনুরোধে বিএনপি (খালেদা জিয়া) সরকারের আমল থেকে ওই পুশব্যাক বা সোপর্দ প্রথা উঠে যায়। তখন থেকে রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বেড়ে যায় সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের স্পর্ধা। বর্তমানে রাতের বেলায় অবৈধ অস্ত্র হাতে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে ঘোরাফেরা করতেও কাউকে তোয়াক্কা করছে না। সরকার মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় এবং তাদের নামের পেছনে একেকটি নম্বর থাকায় নিবন্ধিত ওই রোহিঙ্গাদের বেলায় বৈদেশিক নাগরিক আইনও প্রয়োগ করতে পারছে না। এদিকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কোন কথা বললে ফুঁসে ওঠে কিছু এনজিও। অথচ ভারত সরকার সাজা শেষে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সরকারের কাছে সোপর্দ করার সময় স্বার্থপরায়ণ ওই এনজিওগুলো একদম চুপ ছিল। পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা তাদের নিজেদের সাফাই গাওয়া একাধিক অনলাইন পোর্টালে ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ ও একটি মানবাধিকার সংস্থার সদস্যরা প্রতিবাদ জানিয়েছিল মাত্র। তবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা শত অপরাধ করেও কিছু এনজিওর কারণে পার পেয়ে যাচ্ছে অহরহ। সরকার মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং তারা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত বলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৈদেশিক নাগরিক আইন প্রয়োগ করতে পারছে না। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অপরাধের বিরুদ্ধে টু-শব্দ করলেও স্থানীয়দের ওপর প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে এনজিওসহ রোহিঙ্গা জঙ্গীদের বিভিন্ন সংস্থার লোকজন। সচেতন মহলের প্রশ্ন, তবে কেন? রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এটা শতভাগ সত্য। তারা এদেশের নাগরিক নয়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী। তারা স্বেচ্ছাই যেখানে সেখানে যেতে পারে না মোটেও। আশ্রিত লোকজন হিসেবে আশ্রয়কেন্দ্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে তারা। ক্যাম্প ত্যাগ করলে তাদের ফের ক্যাম্পে ফেরত দিতে হচ্ছে শুধু নিবন্ধনের কারণে। তাদের বেলায় বৈদেশিক নাগরিক আইন (১৪ দ.বি.) প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। তবে শারণার্থী আইন অনুসারে রোহিঙ্গাদের অপরাধ তো মওকুপ করা হয়নি। মানবিক কারণে বাংলাদেশে তাদের প্রাণে বাঁচতে আশ্রয় দেয়া হয়েছে মাত্র। এটাকে পুঁজি করে রোহিঙ্গারা দাপট দেখিয়ে চলেছে স্থানীয়দের ওপর। অপরাধ করেও রোহিঙ্গারা প্রশাসনের কাছে গিয়ে উল্টো নালিশ করছে স্থানীয়দের জন্য। সচেতন মহল থেকে জানানো হয়েছে, ক্যাম্পের বাইরে আটক রোহিঙ্গাদের রেশন স্থগিত করার ব্যবস্থা চালু হলে হয়তো রোহিঙ্গাদের স্পর্দা ও ক্যাম্প ত্যাগ কিছুটা কমে আসতে পারে। উল্লেখ্য, গত ছয়মাসে উখিয়া টেকনাফ এলাকার ৩০টি ক্যাম্প থেকে অন্তত দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে গেছে। তারা আশ্রয় নিয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কেউ কেউ উঠেছে এদেশের কথিত নাগরিক দাবি করে প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে থেকে যাওয়া স্বজনদের (পুরনো রোহিঙ্গা) বাসাবাড়িতে। আবার কেউ কেউ ঘাপটি মেরে রয়েছে বিভিন্ন ভাড়াবাসায়। তাদের স্বজনরা রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে। সরকার প্রত্যাবাসন কার্যক্রম চালু করলে হয়তো নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে সন্দেহে আগেভাগে ক্যাম্প ত্যাগ করেছে নিবন্ধিত ওইসব রোহিঙ্গা। ক্যাম্প পালানো ওইসব রোহিঙ্গার নামে নিবন্ধন থাকলেও ক্যাম্পে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। ক্যাম্প পালানো রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগ আত্মীয়স্বজন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে। তারা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাচ্ছে ক্যাম্প ত্যাগকারীদের জন্য। জানা গেছে, ক্যাম্প ত্যাগকারী চকরিয়ায় আটক ১২ রোহিঙ্গাকে ফের আশ্রয় শিবিরে পাঠানো হয়েছে। তারা হচ্ছে- উখিয়া বালুখালী ক্যাম্পের এ ব্লকের আবদু রহমানের পুত্র ছৈয়দ আমিন (৩০), আবদুল গণির পুত্র মো. হোসেন (২৫), তার ভাই মো. সাদেক (১৯), হারুন সালামের পুত্র রাহমত উল্লাহ (২৫), মোহাম্মদ মুছার পুত্র জোবায়ের (২৩), ফয়েজ আহমদের পুত্র আবদুর রব (২৫), নুর মোহাম্মদের পুত্র আলী আহমদ (২১), আবু ছৈয়দের পুত্র নুর সালাম (২০), ফয়জুর ইসলামের পুত্র সাদেক হোসেন (১৯), মোহাম্মদ ছৈয়দের পুত্র ইয়াদুল ইসলাম (১৯), আবদুল মালেকের পুত্র জোবায়ের (৩০) ও জামতলী ক্যাম্পে থাকা আবদুল গণির পুত্র নুর হোসেন (১৯)। চকরিয়ার খুটাখালী মেধাকচ্ছপিয়া এলাকা থেকে তাদের আটক করেছিল বলে নিশ্চিত করেন চকরিয়া থানার ওসি বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী। ওসি বলেন, আটক ওই রোহিঙ্গারা উখিয়া আশ্রয় ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসেছে। তাদের বাড়ি মিয়ানমারের আকিয়াব ও বুচিদং এলাকায়।
×