ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নীরব বিপ্লব ॥ স্কুল ফিডিং

প্রকাশিত: ১১:০৬, ২২ মার্চ ২০১৯

নীরব বিপ্লব ॥ স্কুল ফিডিং

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বাইরে বিষয়টির আলোচনা খুব একটা নেই। সচেতন নাগরিক বলতে মানুষ যাদের চেনেন তাদেরও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে শোনা যায় না। গণমাধ্যমে যেন বিষয়টি অনেকটা উপেক্ষিত। অথচ নীরবেই এক প্রকল্প রীতিমতো পাল্টে দিচ্ছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র। যার নাম ‘স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম বা কর্মসূচী’। যেটি শুরুর পর শিশুদের মাঝে এক ধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। প্রভাবও যুগান্তকারী। খাবারের বিশাল আয়োজন নেই সত্যি। তবে আগে অর্ধেকেরও বেশি শিশু স্কুলে ঠিকমতো আসত না, আবার এলেও দুপুরের পর থাকত না। কিন্তু স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালু হওয়ার পর আজ ঝরে পড়ার পরিবর্তে দেশজুড়ে শিশুদের ধরে রেখেছে প্রিয় বিদ্যালয়। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা শিশুদের একটি বড় অংশই তুলনামূলকভাবে দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। খোদ রাজধানীর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা শিশুদের একটি বড় অংশের বসবাস বস্তিতে। আছে সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিকদের সন্তান। যাদের অধিকাংশই সকালে সন্তানকে ভাল কিছু খেতেও দিতে পারেন না। বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবারসহ সন্তানকে পাঠানোর মতো অবস্থা নেই অনেকেরই। বিনা মূল্যের নতুন পাঠ্য বই এমন লাখ লাখ পরিবারকে আশার আলো দেখাচ্ছে বটে কিন্তু বিদ্যালয়ে খাবারও শিশুকে ধরে রাখছে বিদ্যালয়ে। মঙ্গলবার দুপুর সোয়া ১টা। রাজধানীর বিজি প্রেস সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতরে বসে কথা হচ্ছিল শিশু আলফা ও রুমার সঙ্গে। পাশে তখন তার ক্লাসের সকল সহপাঠীরা খাবার নিয়ে রীতিমতো আনন্দ করছে। আলফা ও রুমার সারাদেশের প্রায় ৩০ লাখ বেশি শিশু শিক্ষার্থীর দুজন যারা স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম (এসএফপি) থেকে উপকৃত হচ্ছে। আলফা ও রুমা দুজনের বসবাস বেগুনবাড়ী বস্তিতে। তাদের বাবা চালান রিক্সা। মা বুয়ার কাজ করেন বিভিন্ন বাড়িতে। নিয়মিক স্কুলে আসো তোমরা? এমন প্রশ্ন খাবার খেতে খেতে শিশুরা বলছিল, ‘হ স্কুল কামাই করি না। স্যারেরা আমাগো স্কুলে এক বাক্স বিস্কুট দেয়। ওইয়া খাইয়া জল খাইলে আর ক্ষিধা থাকে না’। প্রায় একই কথা বলছে কামরাঙ্গীরচর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরাও। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী রাবেয়াকে দুপুরের খাবারের কথা জিজ্ঞেস করতেই একটা বলে যাচ্ছিল তাদের খাবারের কথা। শিশুটি বলছিল, ‘সকালে বাসা থেকে মুড়ি খাইয়া আইলেই স্কুলে থাকতে পারি। দুপুরেই যে স্যারেরা খাবার দেয়।’ শিক্ষকরা বললেন, খাবারের বিশাল আয়োজন নেই তা সত্যি। তবে স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর কারণে আজ দারিদ্র্যপীড়িত সব শিশুকেই নিয়মিত স্কুলে দেখা যায়। আগে অর্ধেকেরও বেশি শিশু স্কুলে ঠিকমতো আসত না, আবার এলেও দুপুরের পর থাকত না। স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালু হওয়ার পর শিশুরা ক্লাসে নিয়মিত হয়েছে। আমরা সন্তুষ্ট। একে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা ও সরকারের যৌথভাবে পরিচালিত সবচেয়ে সফল কর্মসূচী বলে অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সুফল পাওয়ায় সকলেরই দাবি যে, দেশের প্রতিটি উপজেলাকে যেন ক্রমান্বয়ে এ কর্মসূচীতে নিয়ে আসায় হয়। জানা গেল, কেবল এ দুটি স্কুলই নয়। অনেকটা নীরবেই এক প্রকল্প রীতিমতো পাল্টে দিয়েছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র। সংশোধিত আকারে ২০১০ সাল থেকে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে স্কুল এলাকায় শিশুদের মাঝে এক ধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। যার ফলে শিশুরা দল বেঁধে প্রতিদিন স্কুলে আসছে। শিশু শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ, শিক্ষার হার ও গুণগত মান ঠিক রাখা, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করার উদ্যোগকে সামনে রেখে সফলতার সঙ্গে কাজ চলছে দেশের ১০৪টি দারিদ্র্যপ্রবণ উপজেলার ১৫ হাজার ৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৫শ’ ৭৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর আওতায় প্রতিদিন উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ এক প্যাকেট বিস্কুট পাচ্ছে লাখ লাখ শিশু শিক্ষার্থী। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীসহ দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় রীতিমতো বিপ্লব সাধিত হচ্ছে স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়নের কারণে। যার সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। নিশ্চিত হয়েছে- শিক্ষার্থীর শতভাগ ভর্তি, উপস্থিতির হার বেড়েছে আগের তুলন্য়া ১৩ শতাংশ পর্যন্ত। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমেছে, শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে, শিক্ষার গুণগতমান উন্নত হচ্ছে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার চেহারা পাল্টে দেয়া এ কর্মসূচীর গোড়াপত্তন ও বর্তমান সরকারের মেয়াদে কর্মসূচীর ব্যাপকতা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী তাদের ইমারজেন্সি প্রোগ্রামের আওতায় ২০০১ সালে যশোর জেলায় অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে স্কুলে ফিডিং কার্যক্রম চালু করে। পরে যশোর জেলার অভিজ্ঞতা ইতিবাচক হওয়ায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচীকে তাদের নিয়মিত কান্ট্রিপ্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত করে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর তত্ত্বাবধায়নে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পরার্শক দ্বারা সম্পাদিত সমীক্ষা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যে সকল উপজেলাতে ফিডিং কর্মসূচী চালু আছে সে সকল উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার্থী ভর্তির হার, উপস্থিতির হার, প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপনীর হার, নন ফিডিং উপজেলার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। এছাড়া ফিডিং উপজেলায় ঝরে পড়ার হারও নন ফিডিং উপজেলার তুলনায় কম। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী পরিচালিত সমীক্ষা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে অপেক্ষাকৃত দারিদ্র্যপীড়িত উপজেলাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্কুল ফিডিং প্রকল্প গ্রহণ করে ২০১০ থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী এ প্রকল্পে একদিকে যেমন কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে, অন্যদিকে তেমনি একই প্রকল্পের অধীনে নিজস্ব অর্থায়নে ফিডিং কর্মসূচীও বাস্তবায়ন করে চলেছে। অনেকে একে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা ও সরকারের যৌথভাবে পরিচালিত সবচেয়ে সফল কর্মসূচী বলে অভিহিত করছেন। প্রকল্পের নাম, ‘দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচী’। বাস্তবায়নকারী সংস্থা হচ্ছে- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছে দেশের দারিদ্র্যপীড়িত ও প্রত্যন্ত এলাকার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশুকল্যাণ ট্রাস্ট পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রকল্প এলাকার স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা। ফিডিং কর্মসূচী বাস্তবায়নে এনজিও নির্বাচন, বিস্কুট ফ্যাক্টরি নির্বাচন, বিস্কুটের মান যাচাই করার জন্য নির্বাচন, মনিটরিং, প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কাজে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী সহায়তা প্রদান করছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রতি স্কুল দিবসে এক প্যাকেট করে উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ বিস্কুট সরবরাহ করা হচ্ছে। শিশুদের এ বিস্কুটে আছে, গমের ময়দা, চিনি, উদ্ভিদ ফ্যাট/ভেজিটেবল ফ্যাট, সয়া ময়দা। এছাড়া আছে প্রয়োজনী আয়োডিন যুক্ত লবণ, জিংক, লৌহ, বেকিং সোডা এবং ১৩ রকমের ভিটামিন। প্রত্যেককে বিশুদ্ধ পানি দেয়া হচ্ছে। প্রধান শিক্ষক পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করেন। অন্যদিকে মনিটরিংয়ের জন্য রয়েছে একাধিক স্তরবিশিষ্ট ব্যবস্থা। মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, প্রকল্প অফিস, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী যৌথভাবে পরিদর্শনের মাধ্যমে প্রকল্পের কার্যক্রম মনিটরিং করছে। এছাড়া প্রকল্প অফিস পৃথকভাবে প্রকল্পের কার্যক্রম মনিটরিং করে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর পৃথকভাবে মনিটরিং করে, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে প্রকল্পের কার্যক্রম মনিটরিং করেন। জানা গেছে, সরকারী অর্থায়নে ৯৩টি উপজেলায় ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর অর্থায়নে ১১টি উপজেলায় শিক্ষার্থীরা প্রতি দিন স্কুলে খাবার পাচ্ছে। যেসব স্কুলে খাদ্য কর্মসূচী চলছে, সেখানকার প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারাসহ সংশ্লিষ্টরা ব্যতিক্রমী এ কর্মসূচীতে সন্তুষ্ট। আর সুফল পাওয়ায় সকলেরই দাবি যে, দেশের প্রতিটি উপজেলাকে যেন ক্রমান্বয়ে এ কর্মসূচীতে নিয়ে আসা হয়। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলার প্রতিটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকরাই বলছেন, এই কর্মসূচী চালু হওয়ার ফলে ঝরে পড়া শিশুদের হার অনেক কমেছে। না খেতে পেয়ে অপুষ্টির শিকার হয়ে আগে দরিদ্র শিশুরা প্রায়ই নানা ধরনের অসুখে ভুগত। এখন আর তা হচ্ছে না বলে শিক্ষকদের অভিমত। দীর্ঘদিন গোপালগঞ্জের কোটলীপাড়া উপজেলা শিক্ষা অফিসারের (ইউইও) দায়িত্ব পালন করেছেন মোঃ শহিদুল ইসলাম। সম্প্রতি মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলায় বদলি হয়ে আাসা এ শিক্ষা অফিসার বলছিলেন, তার নতুন কর্মস্থলে স্কুল ফিডিং কর্মসূচী নেই। তবে কোটালিপাড়ার স্কুলগুলোর অভিজ্ঞতার অত্যন্ত ইতিবাচক। আগে দেখতাম শিশুরা স্কুলে আসতো নিয়মিত। উপস্থিতির হার ছিল খুবই কম। আবার যারা আসত তারাও শেষ পর্যন্ত বিদ্যালয়ে থাকত না। দুপুর হলেই ক্ষুধার কারণে বাড়ি চলে যেত শিশুরা। এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। উচ্চ গুণসম্পন্ন বিস্কুট খেয়ে তারা খুশি। উপস্থিতি এখন খুবই ভাল। প্রায় শতভাগ। আবার শিশুদের শারীরিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। কুড়িগ্রামের উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোকসেদুর রহমান বলেন, বিস্কুট দেয়ার কারণে স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেড়েছে। ঝরে পড়ার হারও কমে গেছে। আগে এই হার ছিল ২০ ভাগ। এখন সেটা নেই বললেই চলে। দরিদ্র এলাকার জন্য এই কর্মসূচী খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছে বলে মনে করে অন্য কর্মকর্তারাও। তবে প্রত্যেকেই বলছেন, বিস্কুটের পরিবর্তে দুপুরে রান্না করা খাবার দিলে ফল আরো ভাল হবে। একই সঙ্গে কর্মকর্তারা প্রকল্পের আওতা বাড়ানোরও তাগিদ দিয়েছেন। কুড়িগ্রামের রসুলপুরের প্রাথমিক শিক্ষক রাবেয়া খাতুন বলছিলেন, বিস্কুট দেয়ার ফলে শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হয়েছে। আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের স্কুলে আনতে হতো। এখন তেমনটা করতে হয় না। বান্দরবনের লামা ও থানচি উজেলা নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রতিটি বৈঠকে গর্ব করেন এলাকার শিক্ষক ও কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এই প্রকল্প শুরুর অবস্থার সঙ্গে এখনকার অবস্থার দিনরাত পার্থক্য স্পষ্ট। আগে যেখানে উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশেরও কম এখস সেখানে প্রায় শতভাগ। দুর্গম এলাকায়ও এখন শিশুরা স্কুলে আসছে নিয়মিত। তবে জানা গেল, পরীক্ষামূলকভাবে বিস্কুটের পরিবর্তে রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে লামা উপজেলায়। যার ফলও অনেক ভাল বলে মনে করছেন সকলেই। পাবমাণ বেড়া উপজেলা শিক্ষা অফিসার তোফজ্জল হোসেন বলছিলেন, এলকাটি নদী মাতৃক। শিশুদের উপস্থিতি আগে ছিল খুবই কম। এখন অনেক বেড়েছে উপস্থিতি। কেবল তাই নয়, স্কুলে এসে এখন আর ক্ষুধার জন্য বাড়ি চলে যায় না শিশুরা। তাদের শারীরিক অবস্থাও ভাল হয়েছে। খুবই ইতিবাচক একটি কাজ এটি। এদিকে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর সফলতার ধারাবাহিকতায় আগামী জুলাই থেকেই ১৬টি উপজেলায় শিশুদের দুপুরে বিস্কুটের পরিবর্তে রান্না করা খাবার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বড়গুনার বামনা ও জামালপুরর ইসলামপুর ও বান্দবনের লামা উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে রান্না করা খাবার দেয়ার ইতিবাচক ফল পাওয়ার প্রেক্ষাপটে তার তাওতা বাড়ানো হচ্ছে। যদিও ২০১৭ সালেই এ উদ্যোগের কথা বলেছিলেন দেশী বিদেশী বিশেষজ্ঞরা। নতুন ১৬ উপজেলায় দুপুরে রান্না করা খাবার দিলে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ পরিচালনায় সরকারের ব্যয় বাড়বে, তবে যেহেতু স্কুল ফিডিং কর্মসূচীতে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমে যাওয়াসহ শিক্ষায় ব্যাপক সফলতা পাওয়া যাচ্ছে সেহেতু কর্মসূচীতে বিস্তৃত করতে চায় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই। দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের এ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন গণসাক্ষতা অভিযানের উপ-পরিচালক কে এম এনামুল হক। তিনি স্কুল ফিডিং কর্মসূচিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, শিশুদের প্রতিদিন পুষ্টিগুণ সম্পন্ন বিস্কুট দেয়া হচ্ছে। এর ফল খুবই ভাল কিন্তু আমাদের অবশ্যই বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো রান্না করা খাবারে যেতে হবে। এ দাবি দেশী বিদেশী বিশেষজ্ঞ দাতা সংস্থার পক্ষ থেকে অনেক আাগেই করা হয়েছিল। বাগামী জুলাই থেকে রান্না করার খাবার দেয়া হচ্ছে। যার ফল হবে আরো ইতিবাচক। শিশুদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি বাড়বে. তাদের শারীরিক অবস্থাও অনেক ভাল হবে। সার্বিক অর্থে একটি সুস্থ শিশু পাবে দেশ। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকা অঞ্চলের উপ পরিচালক ইন্দু ভুষণ দেব বলছিলেন, আসলে প্রাথমিক শিক্ষায় একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। আগে শিশুরা যেখানে স্কুলে আসতোনা, আসলেও ধরে রাখা যেতনা সেখানে এখন শতভাগ উপস্থিতি শিশুদের। এটি দেশের শিক্ষার অন্যতম একটি অর্জন। সারাদেশে চলমান দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর উপ-পরিচালক সোহেল আহমেদ বলছিলেন, এখন শিশুদের প্রতিদিন পুষ্টি গুণ সম্পন্ন বিস্কুট দেয়া হয়। আজ যেখানেই যাবেন প্রকল্প এরিয়া ও এর বাইরের স্কুলের তফাত রাত দিনের মতো স্পষ্ট। তিনি আরো বলেন, কর্মসূচী এরিয়ায় শিক্ষার্থী ভর্তি আজ শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে, উপস্থিতির হার পূর্বের তুলনায় গড়ে ৫-১৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, ঝরেপড়ার হার কমেছে, শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে, শিক্ষারগুণগত মান উন্নত হচ্ছে। বিস্কুটের পরিবর্তে রান্না করা খাবার বিতরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ১৬টি উপজেলায় রান্না করা খাবার দেয়া হবে। জানা গেছে, বাংলাদেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যেসব দেশকে মডেল হিসাবে ধরা হচ্ছে তার মধ্যে আছে বৃটেন, ফিনল্যান্ড, ভারত ও ব্রাজিল। কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে বিভিন্ন দেশের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে বিনামূল্যে মধ্যাহ্ন-খাবার দেয়া প্রায় স্বাভাবিক ও প্রচলিত একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু কিছু দেশ এ খাবারকে অবৈতনিক শিক্ষার একটি অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আবার কিছু কিছু দেশ এ খাবারকে ‘শিশুদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও মেধাবিকাশ তথা জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মের গুণগতমান উন্নয়নের’ একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এছাড়া আরও কিছু কিছু দেশ আছে যেখানে বিনামূল্যে খাবার বিতরণকে স্কুলে শিশুদের ভর্তির হার বৃদ্ধি করা এবং সমাজিক বৈষম্য দূর করার একটি প্রকল্প হিসেবে দেখছে। স্কুলে খাবারের ক্ষেত্রে ব্রিটেন বেশি সক্রিয় হচ্ছে। এ সুবিধার ফলে ব্রিটেনের প্রত্যেক শিশুর বাবা মা’ প্রতি বছর ৪ শ’ পাউন্ড সাশ্রয় করতে পারবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রতিদিন ২০ কোটিও বেশি শিশুকে স্কুলে রান্না করা খাবার দেয়। তারা মোবাইল কল ও সিগারেটের ওপর সারচার্জ আরোপ করে এই ব্যয়ের বড় একটি অংশ সংগ্রহ করে। ব্রাজিলের স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষির নানামুখী উন্নয়ন হয়েছে। স্কুলে রান্নার প্রয়োজনীয় সবজিসহ কৃষি উপকরণ সরবরাহের জন্য এলাকাগুলোতে গড়ে উঠেছে একাধিক খামার। এর মাধ্যমে ব্রাজিলের কৃষি ব্যবস্থা পাল্টে গেছে। সূত্রগুলো বলছে, বিদেশের এ সফলতাকে মাথায় রেখেই কাজ করছে বাংলাদেশ।
×