ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সড়কে মৃত্যু- অবরোধ কোনটাই কাম্য নয়

প্রকাশিত: ১১:০৯, ২২ মার্চ ২০১৯

সড়কে মৃত্যু- অবরোধ কোনটাই কাম্য নয়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ প্রতিনিয়ত সড়কে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। আর তা নিয়ে দেশব্যাপী মাঝে মধ্যেই রীতিমতো তোলপাড় হচ্ছে। প্রাণহানির ঘটনার জেরে রাস্তা অবরোধ, যানবাহন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, চালককে মারধর, আবার কোন কোন জায়গায় পিটিয়ে চালক হত্যার ঘটনাও ঘটে। সড়কে যেমন প্রাণহানি কাম্য নয়, তেমনি প্রাণহানির কারণে সড়ক অবরোধ করে জনদুর্ভোগও কাম্য নয়। তারপরেও থেমে নেই সড়কে প্রাণহানির ঘটনা। আর সেই প্রাণহানিকে ঘিরে সড়ক অবরোধ করে যানবাহন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টির ঘটনাও থেমে নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ সড়ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে চালক থেকে শুরু করে যারাই সড়কে চলাচল করেন, তাদের প্রত্যেককেই সচেতন হতে হবে। অন্যথায় নিরাপদ সড়ক গড়ে তোলা অসম্ভব। পাশাপাশি সড়ক যাতে নিরাপদ হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ভাঙ্গা সড়ক মেরামত করা, সড়কে লেন নির্ধারণ করা, নির্ধারিত লেনে নির্দিষ্ট যানবাহন চলাচল করা, যত্রতত্র যানবাহন না দাঁড়ানো ও পার্কিং না করা, সড়ক অনুযায়ী নির্ধারিত গতিতে যানবাহন চলাচল করা, ট্রাফিক আইন মেনে চলাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর সমন্বয় হলেই সড়ক নিরাপদ হবে। গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে জাবালে নূর পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম মীম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আবদুল করিম রাজিব নিহত হয়। আহত হয় অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী। এ ঘটনার পর থেকেই সারাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের পর সেই আন্দোলনে যোগ দেয় স্কুলের শিক্ষার্থীরাও। সর্বশেষ গত ১৯ মার্চ ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটে যাত্রীবাহী সুপ্রভাত পরিবহনের দুইটি বাস প্রতিযোগিতা করে যাওয়ার সময় চাপা দিলে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হওয়ার সময় নিহত হয় বিইউপির (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনাল) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের আবরার আহমেদ চৌধুরী (২২)। এমন ঘটনার পর টানা দুই দিন ঢাকায় রাস্তাঘাট অবরোধ করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। বাস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। শেষ পর্যন্ত সরকারের আশ্বাসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। রাস্তায় হরহামেশাই যানবাহন চাপায় প্রাণ হারানোর বিষয়ে বিশিষ্ট অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ সচেতনতার অভাব। নিরাপদ সড়ক গড়ে তুলতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তবে সড়ক নিরাপদ করার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। বিশেষ করে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। ঢিলে-ঢালা ট্রাফিক আইনই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম মূল কারণ। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাস-ট্রাকের চালকরা পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালায়। তা শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। ওভারটেকিং, যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানামা, পিছনের বাসকে সামনে আসতে না দেয়ার প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। এসব অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে একদিকে যেমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটছে, অন্যদিকে রাস্তায় সৃষ্টি হচ্ছে দুঃসহ ট্রাফিক জ্যাম। আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি রয়েছে অনভিজ্ঞ চালক, মাদকাসক্ত, ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে নিয়ম কানুন না জেনেই গাড়ি চালানোও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। শারীরিকভাবে সামর্র্থ্যবান অনেক মানুষকেই হরহামেশাই মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে, রাস্তা পার হতে দেখা যায়। অদূরে ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও, তা ব্যবহার করেন না। এটি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সবার সচেতনতা প্রয়োজন। অন্যথায় সড়ক নিরাপদ কঠিন। তবে এটি ঠিক, সড়ক সবার স্বার্থেই নিরাপদ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। নতুবা এই বিপদ সবার। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন। ট্রাফিক আইন মানলে এসব দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারত। পাশাপাশি অদক্ষ চালকদের বেপরোয়া স্বভাবের কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে বলে প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এজন্য সড়কে আর যাতে প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে এজন্য যানবাহনকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করা হবে। ট্রাফিক আইন অমান্যকারী চালকদের তাৎক্ষণিক জেল জরিমানা করা হবে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকদের আইন না মানার অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের মানসিকতা। নগর-মহানগরীর রাস্তা এবং হাইওয়েগুলোতে ট্রাফিক সিগন্যালের বালাই নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত ট্রাফিক সার্জেন্ট বা পুলিশ গাড়ির সামনে গিয়ে না দাঁড়ায় চালকরা তাদের গাড়ি থামানোর কোন প্রয়োজনই মনে করে না। ট্রাফিক সিগন্যাল চালু না থাকার কারণেই চালকদের এই মানসিকতা তৈরি হয়েছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কোন চালক ট্রাফিক আইন ভঙ্গের চিন্তা করে না। মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো, সড়কের তুলনায় অধিক যানবাহন চলাচলসহ নানা কারণে সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। খানাখন্দ, ছিনতাই, ডাকাতিও সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করে কমপক্ষে বিশ হাজার। যার মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। বৃহস্পতিবার ডিএমপি কমিশনার সড়ক দুর্ঘটনারোধে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হওয়া ব্যক্তিদের আটকসহ জরিমানা করার কথা জানান। এছাড়া লাইসেন্সবিহীন বা ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকদের গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, যে কোন আদর্শ নগরীর জন্য ওই নগরীর মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ সড়ক থাকতে হয়। ঢাকায় আয়তনের তুলনায় সড়ক রয়েছে শতকরা মাত্র ৮ ভাগ। এই ৮ ভাগের মধ্যে শতকরা ৩০ শতাংশ সারাবছর ধরে বেদখল থাকে। ঢাকায় সড়কের তুলনায় ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা বেশি। এটিও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। রাস্তায় উন্নয়ন কর্মকা- চলায় রাস্তার পরিমাণ কমে গেছে। এতে করে যানবাহনের চালকরা আগে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামে। যা দুর্ঘটনার আরেক কারণ। এজন্য ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের তাৎক্ষণিক জেল জরিমানা করা হবে। পাশাপাশি নগরবাসীকে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতন করতে চালু করা হচ্ছে নানা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম। রাজধানীর ৭০টি পয়েন্টে স্বয়ংক্রিয় বাতি মেরামত ও রাস্তার লেন মার্কিং করা হবে। ঢাকার রাস্তা থেকে ২০ বছরের অধিক পুরনো পাবলিক যানবাহন তুলে দেয়া হবে। এসব কাজ তদারকির জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের ১২ ডিসিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) -এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশের সড়ক মহাসড়কে রেজিস্ট্রেশনকৃত বিভিন্ন প্রকারের যানবাহন চলাচল করছে প্রায় ২৯ লাখ। যদিও বাস্তবে দেশে অন্তত ৩৫ লাখ যানবাহন চলাচল করে। এরমধ্যে অন্তত ২০ লাখ যানবাহন নিয়মিত যাতায়াত করে। আর বাদ বাকি যানবাহনের মধ্যে আরও প্রায় পাঁচ লাখ যানবাহন অনিয়মিতভাবে যাতায়াত করে। দেশে যে পরিমাণ রাস্তা রয়েছে তাতে প্রায় ১৫ লাখ যানবাহন মোটামুটি ভালভাবে যাতায়াত করতে পারে। আর সারাবছর গড়ে দেড় লাখ যানবাহন গ্যারেজে থাকে। বিপুল সংখ্যক এই যানবাহন চালানোর জন্য রয়েছেন প্রায় ১৬ লাখ বৈধ চালক। বাকি যানবাহনগুলোর স্টিয়ারিং ঘুরাচ্ছে অবৈধ চালকরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, দেশে যে পরিমাণ সড়ক- মহাসড়ক রয়েছে, আর যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করছে তা রীতিমতো বিস্ময়ের বিষয়। সড়ক-মহাসড়কের তুলনায় অধিক পরিমাণ যানবাহন চলাচল, সড়কের দুই পাশের শতকরা ৫০ ভাগ বেদখল থাকা, সড়ক মহাসড়কে খানাখন্দ, অদক্ষ চালক, ক্ষমতার অধিক মালামাল নিয়ে যানবাহনের চলাচল, মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, পাল্লাপাল্লি করে যাওয়া, চালকদের বেপরোয়া স্বভাব, ছিনতাই, চুরি ও ডাকাতির মতো অপরাধের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আবদুল মুক্তাদির জনকণ্ঠকে বলেন, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। অন্তত ২০ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে। সেই পরিকল্পনায় দেশের জনসংখ্যা বিশ বছর পর কত হবে, সেই পরিমাণ মানুষের জন্য কি পরিমাণ যানবাহন প্রয়োজন, আর সেই পরিমাণ যানবাহন চলতে, কি পরিমাণ সড়ক-মহাসড়ক প্রয়োজন সেই হিসাব করে সড়ক -মহাসড়ক নির্মাণ করতে হবে। অন্যথায় সড়ক মহাসড়ক দেশবাসীর জন্য এবং দেশের জন্য দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে আসবে। সড়ক দুর্ঘটনা বাড়বে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের হার বাড়বে আশঙ্কাজনক হারে। তিনি আরও বলেন, দেশে সাধারণত বিটুমিন দিয়ে সড়ক-মহাসড়ক নির্মিত হয়। যা সাময়িকভাবে সস্তা। কিন্তু একবছর না ঘুরতেই রাস্তার বেহাল দশা চোখে পড়ে। এজন্য দুর্ঘটনাও বাড়ে। একবার পানি উঠলেই পুরো সড়ক নষ্ট হয়ে যায়। ঢাকার সড়কগুলোর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। নষ্ট সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটা খুবই স্বাভাবিক। আর তাতে হতাহত হওয়াটাই স্বাভাবিক। দেশের সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করা জরুরী। এতে করে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে দীর্ঘস্থায়ী মহাসড়ক নির্মাণসহ নানা বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষা যদি জাতির মেরুদ- হয়, তাহলে সড়ক মহাসড়ক দেশের মেরুদ-। এই মেরুদ- শক্ত করতে উচিত বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিটের সড়ক-মহাসড়ক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা মোতাবেক নির্মাণ করা। কারণ বিটুমিনের সড়ক-মহাসড়ক দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। মেরামত করতে গেলেই রাস্তার এক পাশ বন্ধ করতে হয়। যা তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজটে বেকার বসে থাকেন মানুষ। কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আর নষ্ট রাস্তায় দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে।
×