ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিনের পর দিন ঘুরেও পাওনা টাকা আদায় করতে পারছেন না;###;১৩টি প্রতিষ্ঠানকেই ‘রেড জোন’ বা বিপজ্জনক বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক

আমানতকারী প্রতারিত ॥ নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম দুর্নীতি

প্রকাশিত: ১১:২২, ২২ মার্চ ২০১৯

আমানতকারী প্রতারিত ॥ নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম দুর্নীতি

রহিম শেখ ॥ ঋণ অনিয়মসহ বিভিন্ন কারণে আর্থিক দুরবস্থায় পড়েছে কিছু নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এতই নাজুক যে, তারা গ্রাহকের ‘এফডিআরের’ (আমানত) টাকা পর্যন্ত ফেরত দিতে পারছে না। টাকা না পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পুলিশের সহায়তা চেয়েছেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা। তাদেরই একজন মিরপুরের বাসিন্দা মোস্তফা কামাল। বেশি সুদের আশায় ৩০ লাখ টাকার ৬ মাস মেয়াদী আমানত (টিডিআর) রাখেন একটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। দশ লাখ টাকা করে তিনটি হিসাবে অর্থ জমা করেন গত বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে। বার্ষিক ১২ শতাংশ হারে সুদসহ গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তার টাকা ফেরত দেয়ার কথা। কিন্তু পিপলস লিজিং তার আমানত ফেরত দিচ্ছে না। তার পাওনা এক লাখ ৬০ হাজার টাকার সুদসহ মোট ৩১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। পিপলস লিজিংয়ের প্রধান কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করে কাজের কাজ না হওয়ায় নিরুপায় হয়ে এখন ধর্ণা দিয়েছেন পুলিশের কাছে। টাকা আদায় করে দেয়ার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন তিনি। জানা গেছে, দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৩৪টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই)। এর মধ্যে ১৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই ‘রেড জোন’ বা বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রেড জোনে থাকা এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই গ্রাহকদের আমানত পরিশোধ করতে পারছে না। আমানত তুলে নিতে প্রতিনিয়ত সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ধর্ণা দিচ্ছেন ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা। এসব প্রতিষ্ঠানকে কলমানি ও মেয়াদী আমানত দিয়ে বিপাকে আছে দেশের ব্যাংকগুলোও। অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানই ব্যাংকের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতের সুদও পরিশোধ করছে না ব্যাংকগুলোকে। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত অভিযোগ জমা হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকে। জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে টাকা রেখে ফেরত না পাওয়ার তালিকায় সাবেক সচিব, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সুপরিচিত অনেক ব্যক্তিও রয়েছেন। এদের অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না। এরপরও থেমে নেই পিপলস লিজিং এ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের আমানত সংগ্রহ। উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহে নানা উপায়ে টোপ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ব্যাংকগুলো যেখানে ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদে মেয়াদী আমানত নিচ্ছে সেখানে পিপলস লিজিং ১২ শতাংশ সুদে আমানতের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তির মোবাইলে এসএমএস দিচ্ছে। এ ছাড়া ৫ বছরে দ্বিগুণসহ আকর্ষণীয় নানা স্কিম নিয়ে হাজির হচ্ছে মানুষের কাছে। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে উচ্চসুদের প্রলোভন দেখিয়ে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করছে। আমানত সংগ্রহে কারও মোবাইলে এসএমএস দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানছে না এ প্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, গত ডিসেম্বর শেষে পিপলস লিজিংয়ে মোট আমানত রয়েছে ২ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। তবে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মতো নগদ টাকা প্রতিষ্ঠানটির নেই। বর্তমানে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে টাকা দরকার তার চেয়ে ৮৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা কম রয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির অনিরীক্ষত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গত বছর পিপলস লিজিং পরিচালন ব্যয় দেখিয়েছে ২৫ কোটি টাকা। আয় দেখানো হয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। ফলে গত বছরে পরিচালন লোকসান হয়েছে ২২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে যেসব ঋণ রয়েছে তার অধিকাংশই ভুয়া। ফলে তা আর ফেরত আসছে না। যে কারণে নগদ প্রবাহ কমে প্রতিষ্ঠানটি আমানতকারীর অর্থ ফেরত বা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না বলে জানা গেছে। এসব বিষয়ে বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করেও পিপলস লিজিংয়ের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে দেখা যায়, পিপলস লিজিং থেকে বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশই জালিয়াতির মাধ্যমে পরিচালকরা তুলে নিয়েছেন। ভুয়া কাগজ তৈরি করে প্রায় হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ২০১৫ সালে ৫ পরিচালককে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে শুধু প্রতিষ্ঠানের নামে জমি কেনার কথা বলে নিজ নামে জমি রেজিস্ট্রি করার মাধ্যমে আত্মসাত করেন প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। জমি রেজিস্ট্রির এ জালিয়াতির মাধ্যমে সাবেক চেয়ারম্যান মতিউর রহমান ১১৬ কোটি টাকা, সাবেক পরিচালক খবির উদ্দিন মিয়া ১০৭ কোটি টাকা, আরেফিন সামসুল আলামিন, নার্গিস আলামিন ও হুমায়রা আলামিনের ২৯৮ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য ওই সময়ে দুদককে জানানো হয়। গ্রাহকদের আমানত পরিশোধ করতে না পারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কর্পোরেশন লিমিটেড (বিআইএফসি)। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৭০৯ কোটি টাকা বের করে নেন বিআইএফসির সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব) আবদুল মান্নান। অনিয়মের দায়ে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক পদ থেকে অপসারণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ৮৪৪ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৭৯৪ কোটি টাকার ঋণ ও লিজ খেলাপী হয়ে পড়েছে। বিআইএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএম মোস্তফা বিলাল বলেন, পূর্ববর্তী পর্ষদের অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের কারণে বিআইএফসির বিপুল অঙ্কের ঋণখেলাপী হয়ে পড়েছে। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর সেগুলো পুনরুদ্ধারে সব আইনী পদক্ষেপ চালিয়ে যাচ্ছি। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ অল্প অল্প করে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টাও করছি। এরপরে রয়েছে ফার্স্ট ফিন্যান্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপী ঋণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩১ শতাংশ। ফার্স্ট ফিন্যান্সের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের কলমানি ও মেয়াদী আমানত আছে ১২০ কোটি টাকা।
×