ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এদের ক্যাডার বাহিনী কায়েম করেছে ত্রাসের রাজত্ব

পাহাড়ে শান্তির প্রধান অন্তরায় জেএসএস ও ইউপিডিএফ

প্রকাশিত: ১১:২২, ২২ মার্চ ২০১৯

পাহাড়ে শান্তির প্রধান অন্তরায় জেএসএস ও ইউপিডিএফ

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) পাহাড়ে স্থানীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের অভিহিত করে থাকে। অথচ, পাহাড়জুড়ে এ দুটি নাম এখন স্থানীয়দের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত জেএসএসের সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী (শান্তিচুক্তির পর বিলুপ্ত) নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। শান্তিচুক্তির পর পরই জেএসএসের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের কারণে সৃষ্টি হয় ইউপিডিএফ। ইউপিডিএফ ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি শুরু থেকে মানেনি এখনও মানে না। এ নিয়ে চলে আসছিল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস ও প্রসিত খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। পরবর্তী সময়ে অন্তর্কোন্দলের কারণে এ দুটি সংগঠন ভেঙ্গে চার টুকরো হয়ে যায়। বর্তমান জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (প্রসিত) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে এসব সংগঠনের ক্যাডার বাহিনী গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। বিভিন্ন সময়ে এরা পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এসব হত্যাকা-কে ‘প্ল্যান্ড এ্যাম্বুস’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে আসছে। গত ১৮ ও ১৯ মার্চ বাঘাইছড়িতে ও বিলাইছড়িতে হত্যাকা-ের ঘটনা দুটিও এই প্ল্যান্ড এ্যাম্বুসের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় পাহাড়ী দুর্বৃত্তরা অর্থাৎ জেএসএস ও ইউপিডিএফের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী এ পরিকল্পিত হত্যাকা- চালিয়ে আসছে। এরা কখনও বাঙালীদের পাড়া, ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্রে হামলে পড়ছে। কখনও বাঙালীদের ফলদ বাগান ধংস করে দিচ্ছে আবার এর পাশাপাশি এরা পাহাড়ী বিপরীত গ্রুপের সদস্যদেরও প্রাণপাত ঘটাচ্ছে নৃশংস কায়দায়। এরা সবুজের পাহাড়কে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত করেছে। পাহাড়জুড়ে ৪ হাজারেরও বেশি সশস্ত্র ক্যাডার এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। স্থানীয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্রে অভিন্ন কণ্ঠে জানানো হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে এরা অতিমাত্রায় বেপরোয়া অবস্থান নিয়েছে। এরা ত্রিমুখী বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দ্বিতীয়ত, নিজেদের বিপরীত গ্রুপ এবং তৃতীয়ত প্রতিপক্ষের সঙ্গে এরা সশস্ত্র অবস্থানে রয়েছে। কখনও কখনও জেএসএস সন্তু গ্রুপ সংস্কারপন্থীদের আবার কখনও কখনও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গ্রুপের সদস্যদের আবার উভয় গ্রুপ নিরাপত্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও হামলার ঘটনা ঘটিয়ে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, পার্শ¦বর্তী প্রতিবেশী দুদেশ থেকে এদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ হয়ে থাকে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের অস্ত্র কেনাবেচার সঙ্গেও এসব গ্রুপের সদস্যরা জড়িয়ে আছে। স্বয়ংক্রিয় থেকে বিভিন্ন ধরনের ভারি অস্ত্র এবং গোলাবারুদের একাধিক মজুদ রয়েছে এদের নিয়ন্ত্রণে। এরা গড়ে তুলেছে অবৈধ অস্ত্রের মিনি ক্যান্টনমেন্ট। মূলত জেএসএস এবং ইউপিডিএফ পাহাড়ে শান্তি সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে আছে। এ দুটি সংগঠনের বিভক্তির পর চারটি হয়েছে। এদের পক্ষ থেকে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মকা-ের কথা সর্বদা বলা হয়ে থাকলেও এরা মূলত চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজিতে লিপ্ত থেকে ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত। পাহাড়ের বাঙালী ও পাহাড়ীদের মধ্যে যারা শান্তিকামী তারা বছরের পর বছর মারাত্মক ভীতির মুখে রয়েছেন। কখন কোথায় হামলার ঘটনা ঘটে, কে কখন কাকে হত্যা করছে এ নিয়ে সর্বক্ষণিক উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে এদের দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। এর নেপথ্যের ঘটনা অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, মূলত শান্তি চুক্তির পর বিভিন্ন স্থান থেকে সেনা চৌকি প্রত্যাহারে পর অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তদের রামরাজত্ব কায়েম হয়েছে। দুর্গম পাহাড়ের দুর্গম স্থানে সেনাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় বহুলাংশে কম থাকায় এরা এ সুযোগ গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন সময় হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটিয়ে দুর্বৃত্তরা অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে ওপারে গা ঢাকা দিয়ে থাকে। ফলে বড় বড় সহিংস ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের হাতে সোপর্দ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কঠিন একটা বিষয়ে পরিণত হয়ে আছে। বাঘাইছড়িতে সাত খুনের ঘটনার পর শুরু হয়েছে কম্বিং অপারেশন। অপরদিকে, বাঘাইছড়ি পুলিশের পক্ষে ঘটনার তদন্ত কাজও শুরু হয়েছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোন বাহিনীর হাতে দুর্বৃত্তদের কেউ ধরা পড়েনি। বিষয়টি কঠিন ও কষ্টসাধ্যও বটে বলে প্রশাসনের বিভিন্ন সূত্রে স্বীকার করা হয়ে থাকে।
×