ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মধ্যযুগের কবি দোনাগাজী

প্রকাশিত: ১২:৪১, ২২ মার্চ ২০১৯

মধ্যযুগের কবি দোনাগাজী

‘প্রেম সে পরমতত্ত্ব জানিঅ নিশ্চএ আদি অন্ত প্রেমেত সংসার উপজএ। প্রেম সে পরমতত্ত্ব প্রেম সে উত্তম প্রেম সে মজাএ মন প্রেমে সে জনম।’ -দোনাগাজী। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের ভূমিকে যে কয়েকজন সাহিত্যিক সমৃদ্ধ ও গৌরবোজ্জ্বল করেছেন তাঁদের মধ্যে কবি দোনাগাজী অন্যতম। তিনি বাংলায় ‘আলিফ লায়লা’ অবলম্বনে প্রথম রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’ রচনা করেন। তাঁর পরে মহাকবি আলাওল (১৫৯৭-১৯৭৩) ও মালে মুহম্মদ (ঊনবিংশ শতাব্দির প্রারম্ভ) একই কাহিনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করেন। আলাওল ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’ রচনা শুরু করেন ১৬৫৮ সালে। শেষ করেন ১৬৬৯ সালে। অর্থাৎ সতের শতাব্দীর মধ্যভাগে তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেন। অন্যদিকে গবেষকরা মনে করেন, দোনাগাজী আনুমানিক ষোলো শতকের মধ্যভাগ থেকে সতেরো শতকের প্রথমভাগের মানুষ। অর্থাৎ এ সময়েই তিনি ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’ রচনা করেছেন। দোনাগাজীর পুরো নাম দোনাগাজী চৌধুরী। তাঁর সঠিক জন্মসাল-তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তিনি কাব্যে, পুঁথিতে বা অন্য কেউ কোথাও তাঁর জন্মসাল উল্লেখ করেননি। তবে গবেষকরা একমত হয়েছেন যে, দোনাগাজী ষোড়শ শতাব্দীর কবি। বরেণ্য গবেষক ড. মুহম্মদ এনামুল হক মনে করেন, ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে দোনাগাজীর আবির্ভাব। ড. আহমদ শরীফ মনে করেন, ‘দোনাগাজী ষোল শতকের কবি হওয়াও অসম্ভব নয়। কাজেই অস্বীকৃতির আশঙ্কা না করেই নির্দ্বিধায় বলতে পারি তিনি সতেরো শতকের গোড়ার দিককার কবি।’ জন্মসালের মতো তাঁর জন্মস্থান নিয়েও কয়েকটি তথ্য প্রচলিত রয়েছে। দোনাগাজী তাঁর কাব্যে জানিয়েছেন ‘দোল্লাই’ দেশে তাঁর নিবাস। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সংগৃহীত পুঁথিতে তাঁর ভণিতা : ‘দোনাগাজী চৌধুরী দোল্লাই নামে দেশ রচিল বিরহ পুঁথি চিত্তের আবেশ। দারুণ বিরহ ভাব ধরে যার প্রাণে জাতিকুল লজ্জা জ্ঞান হারায় ধেয়ানে।’ দোনাগাজীর ‘দোল্লাই দেশ’ অর্থাৎ দোল্লাই পরগনা। দোল্লাই পরগনা বর্তমান কুমিল্লার জেলায় অবস্থিত। ড. আহমদ শরীফ দোনাগাজী রচিত ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘‘আধুনিক চাঁদপুর মহাকুমার ‘সোসাইর দ্বীপে’ এক পরিবার কবি দোনাগাজীর বংশধর বলে দাবি করেন। এই ‘সোসাইর দ্বীপ’ পুরানো দোল্লাই পরগনার অন্তর্ভুক্ত।’’ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ লোকমুখে শুনেছেন, মধ্যযুগের এ কবির জন্ম চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার উজানিনগর গ্রামে। তাহলে দোনাগাজীর জন্ম কি বর্তমান কুমিল্লায়, নাকি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায়Ñএই প্রশ্ন থেকে যায়। দোনাগাজী যে দোল্লাই দেশের কথা বলেছেন, বর্তমানে দোল্লাই নামে কেবল কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায় ‘দোল্লাই নবাবপুর’ নামে একটি ইউনিয়ন রয়েছে। ইউনিয়ন থাকলেও দোল্লাই নামে কোন গ্রাম নেই। আবার কোন গবেষকও দোনাগাজীর জন্ম বর্তমান কুমিল্লায় বলে দাবি করেননি। মধ্যযুগে বৃহত্তর কুমিল্লার অংশ দোল্লাই পরগনার মতো ছিল। অর্থাৎ আশপাশের অনেকগুলো গ্রাম নিয়ে গঠিত হয়েছিল দোল্লাই। বর্তমান দোল্লাই ইউনিয়নের কাছেই বর্তমান চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা। পাশাপাশি সুদীর্ঘকাল থেকে দোনাগাজী চাঁদপুরের কৃতীজন হিসেবে জেলাবাসীর কাছে বহুল পরিচিত হয়ে আছেন। অন্যদিকে মধ্যযুগে উজানি সমৃদ্ধ নগর ছিল। মধ্যযুগের কবি ক্ষেমানন্দ কেতকাদাসের ‘মনসার ভাসানে’ উজানীনগরের সমৃদ্ধির বর্ণনা রয়েছে। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চ-ীমঙ্গল’ কাব্যেও এ নগরের বর্ণনা রয়েছে। মধ্যযুগের অনেক স্থাপত্য এখনও উজানিতে স্বগৌরবে টিকে আছে। বেহুলা-লখিন্দরের লৌহবাসর, বেহুলার জন্মসহ বহু মিথ উজানিনগরকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে। দোনাগাজীর ‘চৌধুরী’ উপাধি এবং কাব্যে বৈদগ্ধতা দেখে আহমদ শরীফ অনুমান করেছেন, ‘তিনি ধনী-মানী বংশের সন্তান। দেশ প্রচলিত বিদ্যা ও সংস্কৃতিতে ছিল তাঁর সহজ অধিকার। তাই তাঁর বৈদগ্ধ্যের, কবিত্বের ও উচ্চবিত্তের জীবন-প্রতিবেশ-চেতনার সাক্ষ্য মেলে তাঁর কাব্যের সর্বত্র।’ মধ্যযুগে বর্তমান দোল্লাই নবাবপুরের এমন সমৃদ্ধ ইতিহাসের কথা জানা যায়নি, যেই সমৃদ্ধির কথা কচুয়ার উজানিনগর সম্পর্কে জানা যায়। জনশ্রুতি, ষাটের দশকের একটি পরিবারের দাবি এবং ইতিহাস বিবেচনায় তাই এ কথা বলা যায়, কচুয়ার বিখ্যাত উজানিনগরেই কবি দোনাগাজীর জন্ম। মধ্যযুগের কোন কোন কবি রাজসভায় স্থান করে নিয়েছিলেন। তাঁরা রাজা কিংবা রাজপরিবারের অনুরোধে ও পৃষ্ঠপোষকতায় কাব্য রচনা করতেন। এর উদাহরণ মহাকবি আলাওল। দোনাগাজী রচিত ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’ কাব্যের শুরুতে কেবল স্তূতিপর্বে আল্লাহ-রাসুল-পীরের বন্দনা রয়েছে। কোন রাজা, আমর্ত্য বা অন্যকারো প্রশংসা করে বন্দনা করা হয়নি। অর্থাৎ কোন পৃষ্ঠপোষকতা কবি নেননি। অথবা নিজে বিত্তবান হওয়ায় তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণের প্রয়োজন পড়েনি। যদি কারও উৎসাহ কিংবা পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি কাব্য রচনা করতেন তবে রচনার শুরুতেই পৃষ্ঠপোষকের নামে স্তুতিপর্ব থাকত। এ থেকে অনুমান করা যায়, তাঁর কাব্য রচনার পেছনে আত্মোৎসাহ কাজ করেছে। কাব্যবিশ্লেষণ করে ধারণা করা হয়, তিনি শেষ বয়সে এসে কাব্য চর্চায় ব্রতী হয়েছিলেন। ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’-এর কাহিনী আলিফ লায়লার ৭৫৭তম রজনীতে শুরু এবং ৭৭৮তম রজনীতে কাহিনীর শেষ। দোনাগাজী ১০৭টি পর্বে কাব্যের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’-এর মূল কাহিনী হলোÑ মিসররাজ বিত্তবান ও ধার্মিক হলেও তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। জ্যোতিষিরা জানালেন, রাজা শাহ কহতানের কন্যার গর্ভেই মিসর রাজের সন্তান লাভ সম্ভব। অতঃপর মিসর রাজ কহতান কন্যাকে বিয়ে করলেন। যথাসময়ে তিনি পুত্র সন্তানের জনক হলেন। একই দিনে রাজার সালেহ পাত্রও পুত্র সন্তানের জনক হলেন। এ দুটি সন্তান রাজপ্রসাদে একই সঙ্গে বড় হতে লাগলো। রাজপুত্রের নাম সয়ফুল মুলুক। সালেহ পাত্রের পুত্রের নাম সায়াদ। অল্পবয়সেই শাস্ত্র-অস্ত্র-কাব্যে তারা পারঙ্গম হয়ে উঠলেন। তাদের ১৪ বছর বয়সে রাজা সোলাইমানের দেয়া উপহার ভাগ করে দেয়া হলো। উপহার হিসেবে রাজপুত্র পেল আঙটি ও কাবাই। সেদিন রাতেই কাবাইয়ের মধ্যে সয়ফুল মুলুক জিনরাজকন্যা রূপসী বদিউজ্জামালের ছবি দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়। অতঃপর প্রেমে উন্মাতাল রাজপুত্র সায়াদকে নিয়ে বের হলো বদিউজ্জামালের সন্ধানে। পথে পথে বহু প্রতিকূলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দৈত্য-দানব, যুদ্ধবিগ্রহ শেষে মালেকার সহযোগিতায় সয়ফুল মুলুক ও বদিউজ্জামালের দেখা হয়। পরির সঙ্গে মানুষের বিয়ে নিয়ে চলে পারিবারিক আপত্তি। অবশেষে তারও সমাধান হয়। সয়ফুল মুলুকের সঙ্গে বদিউজ্জামালের বিয়ে হয়। অন্যদিকে মালেকা ও সায়াদেরও বিয়ে হয়। নবদম্পতি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে মিসরে ফিরে যায়। মিলনাত্মক সমাপ্তি ঘটে এ উপাখ্যানের। আলিফ লায়লা থেকে কাহিনী নিলেও দোনাগাজী কাহিনীকে উপস্থাপন করেছেন তাঁর নিজস্ব ঢংয়ে। প্রকৃতির প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তাঁর কাব্যের পরতে পরতে মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতি বিশেষভাবে উচ্চকিত হয়েছে। অন্যদিকে তৎকালীন সমাজের স্বচ্ছ একটি প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে এ কাব্যে। তৎকালীন বিশ^াস, রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, উৎসব, পার্বণের কথাও কাব্যে যত্ন সহকারে তুলে ধরেছেন দোনাগাজী। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’ গ্রন্থটি দোনাগাজী পরবর্তীতে আলাওল, মালে মুহম্মদ লিখেছেন। তিন রচয়িতার মধ্যে গবেষকগণ আলাওলের রচনাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু আহমদ শরীফ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন অনেক ক্ষেত্রেই দোনাগাজী কাব্যরচনায় অন্যদের চেয়ে অধিক পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘দোনাগাজীর বর্ণনা জীবন্ত। আলাউল প্রদত্ত চিত্র প্রাণহীন। আর মালে মুহম্মদ অঙ্কিত দেওনী নীরস। দোনাগাজীর কাব্যের উৎকর্ষ বিচারে তুলনামূলক আলোচনা দীর্ঘ করা নিষ্প্রয়োজন। তবে যুদ্ধ বর্ণনাটি আলাউলে সুদীর্ঘ, দোনাগাজীতে নাতিদীর্ঘ আর মালে মুহম্মদে অতি সংক্ষিপ্ত। আলাউল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন বীরের দ্বৈরথ। দোনাগাজী করেছেন সাধারণভাবে।’ অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘সংবেদনশীল কবি-মন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি তাঁর কাব্যকে দিয়েছে লাবণ্য আর তাঁকে করেছে বিশিষ্ট কবি। বাঙলায় সয়ফুল মুুলুক-বদিউজ্জামাল’ উপখ্যানের তিনিই শ্রেষ্ঠ কবি-দ্বিমতের আশঙ্কা না করেই তা উচ্চারণ করা চলে। আর মধ্যযুগের পাঁচালী কাব্যেরও তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ও বিশিষ্ট কবি।’ ড. মুহম্মদ এনামুল হক ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে দোনাগাজী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তাঁর ভাষার প্রকৃত ভাব, ছন্দের শিথিলতা, অন্ত্যানুপ্রাসের শৈথিল্য এবং প্রাচীন শব্দ প্রয়োগের বাহুল্য সমস্তই একসঙ্গে মিলে তাঁকে স্বাধীনতা যুগের মুসলিম কবিদের সমপর্যায়ভুক্ত করে তুলেছে।’ মধ্যযুগের কবি দোনাগাজীকে নিয়ে নতুন করে তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এ কবিকে কোথায় সমাহিত করা হয়েছে সে তথ্যও আমাদের জানা নেই। রবীন্দ্রনাথ যেমন ‘সোনার তরী’তে বলেছেন মহাকাল কেবল কাজ নিয়ে যায়, রেখে যায় রক্ত-মাংসের ব্যক্তিকে-তেমনি ব্যক্তি দোনাগাজীও সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু মহাকাল নিজের কাছে সযত্নে রেখে দিয়েছে কবিকীর্তি ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’ কাব্য। গুণী এ কবির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রইল।
×