ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য পার্ক ॥ শিল্পের নতুন দিগুুন্ত উন্মোচন

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ২২ মার্চ ২০১৯

হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য পার্ক ॥ শিল্পের নতুন দিগুুন্ত উন্মোচন

বাংলাদেশে ভাস্কর্য পার্ক? অবাক হচ্ছেন? হ্যাঁ কিছুটা অবাক করার মতোই বিষয়টি। এরকম একটি অবাক এবং বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কড্ডায় সামিট গাজীপুর ৪৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র কম্পাউন্ডের উন্মুক্ত স্থানে হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য পার্ক উদ্বোধনের মাধ্যমে। পার্কটি উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম। এটি দেশের ইতিহাসে প্রথম একটি ভাস্কর্য পার্ক। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে যে কেউ পার্কটি পরিদর্শন করতে পারেন। পৃথিবীর অনেক দেশেই কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে এ ধরনের ভাস্কর্য পার্ক পরিদর্শনের রেওয়াজ চালু রয়েছে। সারা পৃথিবীতেই পরিকল্পিত ভাস্কর্য পার্ক ধারণাটি খুব বেশি পুরোনো নয়। ইতোপূর্বে অপরিকল্পিত এবং বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পার্ক হয়ে থাকলেও গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সুপরিকল্পিত ভাস্কর্য পার্কের ধারণাটি বিশ্বব্যাপী শিল্পী সমাজ এবং শিল্পবোদ্ধাদের গণনায় আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক্ষেত্রে অগ্রবর্তী বলা যায়। বর্তমানে সুপরিকল্পিত ভাস্কর্য পার্ক সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে এবং ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অসংখ্য ভাস্কর্য পার্ক গড়ে উঠেছে।এর মধ্যে বিভিন্ন শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে দলগত পার্ক যেমন আছে আবার অন্যদিকে একজন শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে একক ভাস্কর্য পার্কও রয়েছে। বাংলাদেশে একক বা দলগত কোন প্রকার ভাস্কর্য পার্কই অতীতে ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরেজমিনে ভাস্কর্য পার্ক গড়ে ওঠা দেখেছেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আধুুনিক ভাস্কর্য শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। শুধু তাই নয় দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল অলিম্পিক পার্কে একজন প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে তার একাধিক শিল্পকর্ম স্থাপিত হয়েছে। অলিম্পিক পার্ক ছাড়াও আরও কয়েকটি পার্কে তার কাজ স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া তার স্ত্রী দেশের আর একজন খ্যাতিমান ভাস্কর আইভি জামানের ভাস্কর্যও দক্ষিণ কোরিয়ায় কিমচিয়ন সিটির জিগজি ভাস্কর্য পার্কে স্থায়ীভাবে স্থান পেয়েছে। পৃথিবী বিখ্যাত ভাস্কর্য পার্ক ঘুরে দেখতে দেখতে এবং বিশ্বখ্যাত ভাস্কর্য শিল্পীদের সংস্পর্শে আসার সুবাদে হামিদুজ্জামান খানের মনেও সুপ্ত বাসনা জাগে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে একটি সুপরিকল্পিত আধুনিক ভাস্কর্য পার্ক গড়ে তুলবার। আর সেই লক্ষকে সামনে রেখে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঢাকার সাভারে একটি জায়গাও কিনেছিলেন। কিন্তু পরে তার উপলব্ধি হয় যে এই পরিমাণ জায়গা ভাস্কর্য পার্ক গড়বার জন্য যথেষ্ট নয়। এছাড়া একটি ভাস্কর্য পার্ক রক্ষণাবেক্ষণসহ নানা ঝক্কি ঝামেলাও রয়েছে। যেটি কোন রকম পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া একজন ব্যক্তির পক্ষে এককভাবে করা সম্ভব নয়। তাই তিনি বিকল্প ভাবনা ভাবতে থাকেন। আর বিকল্প ভাবনাটি বাস্তবায়নে এক বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ এবং এর মূল কর্ণধার ও শিল্প সংগ্রাহক মুহাম্মদ আজিজ খান। হামিদুজ্জামান খানের প্রস্তাবে স্বপ্রণোদিত হয়ে মুহাম্মদ আজিজ খান তার বিদ্যুত কেন্দ্রে দুই একরের অধিক পরিমাণ জায়গা ছেড়ে দেন। আর সেই জায়গাতেই হামিদুজ্জামান খান তার স্বপ্নের ভাস্কর্য পার্কের বাস্তব রূপায়ণের কাজ শুরু করেন ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। যেটির চূড়ান্ত রূপ পাওয়া যায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন পর্বের মাধ্যমে। তবে এটির কাজ এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। প্রয়োজন মতো এটিকে আরো পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা হবে বলে শিল্পী জানান। বর্তমানে পুরো ভাস্কর্য পার্কটিতে স্থান পেয়েছে মোট ১৩টি শিল্পকর্ম। এখানে রয়েছে ১২টি ভাস্কর্য এবং দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম ৩৫০ ফুট দৈর্ঘের একটি ম্যুরাল। পার্কে স্থাপিত ম্যুরালটি সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে স্টোন এবং মেটালে তৈরি। যেহেতু এটি একটি ওপেন স্পেস সেহেতেু রোদ, বৃষ্টি কিংবা ঝড়ের কবলে পড়ে যাতে এটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে দিকটি শিল্পীর ভাবনায় ছিল এবং সেই অনুযায়ী ভারি মিশ্র মাধ্যমে এটি তৈরি। একটি বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রে তৈরি বিধায় ম্যুরালটিতে বিদ্যুত কেন্দ্র বা একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। অনেকগুলো চাকা সদৃশ্য বস্তু চোখে পড়ে, বিদ্যুতের কেবল সদৃশ্য আঁকাবাঁকা রেখা চেখে পড়ে, ইন্ডাস্ট্রির চুল্লি চোখে পড়ে। দূর থেকে লক্ষ্য করলে এটিকে অনেকটা পেইন্টিংয়ের মতোও দেখা যায়। সব মিলিয়ে ম্যুরালটিতে শিল্প এবং সৃষ্টির এক অপূর্ব মেলবন্ধন রচিত হয়েছে। ভাস্কর্য পার্কটিতে স্থান পাওয়া আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে বহুল পরিচিত একটি চিত্র রিক্সাচালক এবং যাত্রীকে হত্যা দৃশ্য সম্বলিত একটি ভাস্কর্যে চোখ আটকে যায়। এই ভাস্কর্যটি মুহূর্তেই আমাদের ইতিহাসের নির্মম গণহত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং এই দেশটি পাবার পেছনে নাম না জানা অসংখ্য মানুষের তাজা প্রাণ বিসর্জনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একটি ভাস্কর্যে দেখা যায় ল্যাম্প পোস্টের নিচে পাঠরত এক মানব প্রতিকৃতি। মুহূর্তেই মনে পড়ে যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সেই ল্যাম্প পোস্টের নিচে সীমাহীন কষ্টে জ্ঞানার্জনের কথা। প্রতিবন্ধকতা এবং সেটিকে জয় করার এক অদম্য শক্তি এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুত কেন্দ্রে স্থাপিত ভাস্কর্য হিসেবে এটি যথেষ্ট মানানসইও বটে। কারণ এটি বিদ্যুতহীন অন্ধকার সময় থেকে বিদ্যুতের আলোর পথের যাত্রাও নির্দেশ করে। চাকা মানেই গতি। চাকা সদৃশ্য এরকম একটি ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে এখানে। পৃথিবীর গতিময়তা নির্দেশ করে এটি। ফ্রেমের মধ্যে গোলাকার পৃথিবী এরকম একটি ভাস্কর্য চোখে পড়ে। পৃথিবী মানেই একটি গোলাকার কিছু আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে। আবার অন্যভাবে লক্ষ্য করলে মনে হয় যেন অন্ধকার রাতে এক ফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। আবার এতে প্রকৃতিও খুঁজে পাওয়া যায়। ফ্রেমটিকে মনে হয় যেন একটি বড় পাতা। মুহূর্তেই এক ভাল লাগার আবেশে জড়িয়ে ফেলে এটি। একটি ভাস্কর্যে দেখা যায় চাকা এবং তার উপর একটি পাখি বসা। চাকার জীবন নেই আর পাখির জীবন আছে। জীবন নেই কিন্তু চাকা গতিময় এবং শান্তির বার্তাবাহী পাখি যেন শান্তিপূর্ণ এক গতিময়তা নির্দেশ করে। ভাস্কর্যগুলোর ব্যাকড্রপ হচ্ছে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ, সবুজ ঘাস, মাটি, প্রকৃতি। ভাস্কর্য পার্কে যে ব্যাকগ্রাউন্ড আমরা পাই সেটি চার দেয়ালে ঘেরা আবদ্ধ গ্যালারিতে পাওয়া সম্ভব নয়। দেশ, মাটি, প্রকৃতি, পাখি এরকম নানা বিষয় বৈচিত্র্যে পূর্ণ ভাস্কর্র্য পার্কটি। শিল্পকর্মগুলো দেখতে গিয়ে কোনরকম একঘেয়েমি লাগার সুযোগ নেই। পুরো ভাস্কর্য পার্ক ঘুরে দর্শনার্থী ক্লান্ত হয়ে পড়বেন? যাতে ক্লান্তি এসে ভর না করে সে জন্য বসা যায় এমন ভাস্কর্যও স্থান পেয়েছে এখানে। আর এমন স্থানে বসার উপযোগী ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে যাতে সুদৃশ্য ম্যুরাল থেকে শুরু করে পুরো ভাস্কর্য পার্কটি আপনার নিকট দৃশ্যমান হয়। এখানে বসে এক অন্য রকম ভাল লাগায় ভরে যাবে মন। সব মিলিয়ে এক অসাধারণ নান্দনিক উপস্থাপনা এটি। রোদ, বৃষ্টিতে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং আমাদের আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে যায় সেই বিষয়টিকে মাথায় রেখে ভাস্কর্যগুলো পিওর স্টিল, স্টেইনলেস স্টিল এবং স্টোনে তৈরি করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো কোন ভাস্কর্যেই রংয়ের ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি ম্যুরালটিতেও কোন প্রকার রংয়ের ব্যবহার হয়নি। কারণ একবার রং ব্যবহার করলে এগুলোর রূপ ঠিক রাখতে কিছুদিন পরপরই রং করতে হবে। এখন সেই ঝামেলা নেই ফলে প্রাকৃতিকভাবেই এগুলোর রং এবং রূপ ঠিক থাকবে। পার্কটি স্থাপনের ক্ষেত্রে এখানে একজ ব্যক্তির কথা না বললেই নয় আর তিনি হচ্ছেন মুহাম্মদ আজিজ খান। যিনি অত্যন্ত শিল্প সমঝদার একজন মানুষ। এদেশে সবাই ব্যবসা করেন কিন্তু শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না বললেই চলে। সেদিক থেকে মুহাম্মদ আজিজ খান শিল্পের পৃষ্ঠপেষকতায় এক অগ্রপথিক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এদেশে শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছেন। তিনি দেশের একজন আন্তর্জাকিত মানের অন্যতম বড় ব্যবসায়ীই শুধু নন; একজন অন্যতম বড় শিল্প সংগ্রাহকও বটে। তার সর্বশেষ নিদর্শন তিনি রাখলেন এই পার্কটি স্থাপন করে এবং শিল্পীর নামেই এটির নামকরণ করে। তিনি চাইলে বিভিন্ন শিল্পীর শিল্পকর্ম দিয়েও পার্কটি সাজাতে পারতেন এবং অন্য কোন নামকরণও করতে পারতেন। কিন্তু না তিনি তা কনেনি। যে দেশে সরকারী বেসরকারী কোন উদ্যোগেই একক তো দূরের কথা কোন দলগত ভাস্কর্য পার্কই নেই সেখানে একজন অসাধারণ গুণী শিল্পীর একক ভাস্কর্য পার্ক স্থাপন করে এদেশের ইতিহাসে এক বিরল নজির স্থাপর করলেন। সেই সঙ্গে আমাদের একজন আন্তর্জাতিক মানের শিল্পীকে বিরল সম্মানে ভূষিত করে আমি বলব তিনি নিজেই এক বিরাট সম্মানের জায়গায় পৌঁছে গেছেন। শিল্পের প্রতি তার এই দরদ অব্যহত থাকবে আমরা সেটিই প্রত্যাশা করব। হামিদুজ্জামান খান এমন একজন ভাস্কর্য শিল্পী যার ধ্যান ধারণায় সদাসর্বদা থাকে এই দেশ, মাটি এবং প্রকৃতি। তার প্রতিটি কাজেই আমরা দেশপ্রেম খুঁজে পাই। আবার তিনি বৈশ্বিক এবং আধুনিক। এভাবে বলতে পরি যে, দেশ হচ্ছে তার কাজের ব্যাকড্রপ বা জমিন। আর সেই ব্যাকড্রপ বা জমিনে তিনি যে শিল্পকর্ম স্থাপন করেন সেটি হয়ে ওঠে আধুনিক এবং বৈশ্বিক। সব মিলিয়ে তিনি আমাদের দেশের একজন আধুনিক আন্তর্জাতিক শিল্পী। হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য পার্কের প্রতিটি কাজেও সেই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। আমরা তার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
×