ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ১২:৪৪, ২২ মার্চ ২০১৯

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

পর্ব-২৮ আশির দশকে আমি দুটি কাজ করেছিলাম যাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। একটি হলো, কার্ল স্যুখমায়ারের ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’ নাটকটির বঙ্গানুবাদ এবং এর সফল মঞ্চায়ন আর অন্যটি হলো রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ নাটককে নতুন রূপে সাজিয়ে মঞ্চে উপস্থাপন করা। এই দুটি কাজেই আমার প্রয়াত তরুণ বন্ধু খালেদ খান আমার সঙ্গে বসে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। অতএব এই কাজ দুটোতে তাঁর অবদান স্বীকার না করে উপায় নেই। আমার মনে আছে যে আমি প্রথমে মনে মনে নাটক দুটির মঞ্চায়ন নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে এগুলোর প্রযোজনা পান্ডুলিপির একটা চিত্র দাঁড় করিয়েছিলাম, সেটা খালেদকে বলায় ও নিজেই অসীম আগ্রহ নিয়ে আমার সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে। তখন নাট্যাঙ্গনে খালেদ প্রবেশ করেছে মাত্র। অথচ তার মনে ছিল অসীম আগ্রহ এবং উচ্চাকাক্সক্ষা। অভিনয়ের প্রতিটি বিষয়ে রীতিমতো পড়াশোনা করত এবং এ নিয়ে আলোচনা করতে ভালবাসত। ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’ এবং ‘অচলায়তন’ এই দুটি নাটকেই আমি প্রথাসিদ্ধ অনুবাদ এবং রূপান্তরের পথ পরিহার করে সরাসরি প্রযোজনা পা-ুলিপি আকারেই লিখেছিলাম। অতএব মঞ্চে যখন এই নাটক দুটো আবির্ভূত হলো তখন এর আকর্ষণ অনেকাংশে বেড়ে যায়। ফলে প্রচুর দর্শক সমাগম ঘটে। এই কাজ দুটিতে আমি প্রচ- তৃপ্তি পেয়েছিলাম যা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল ভবিষ্যতে নাটক নিয়ে আরও ব্যাপক নিরীক্ষাধর্মী কাজ করার। স্মরণ করা সম্ভব হবে যে এর আগেই আমি বের্টোল্ট ব্রেশ্টের প্রখ্যাত নাটক ‘সেৎজুয়ানের ভাল মেয়ে’ নাটকটির রূপান্তর করেছিলাম। অতএব, আমার সাহস বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ঠিক এই সাহসেরই বশবর্তী হয়ে আমি এক দুর্বিনীত যুবকের মতো শেক্সপীয়রের হ্যামলেটকেও ভেঙে ‘দর্পণ’ বলে একটি নাটক লিখেছিলাম এবং সফল মঞ্চায়ন করেছিলাম। সেই নাটকেও হ্যামলেট এর রূপান্তরিত চরিত্র দর্পণ-এ অসাধারণ অভিনয় করেছিল খালেদ খান। কী সব দিন গেছে তখন! সারাদিন অফিসের পরিশ্রম, সন্ধ্যাবেলায় মহড়া তারপর রাত দুটো অবধি নাটক লেখা। একটুও ক্লান্ত মনে হয়নি নিজেকে। কে যেন বলেছিল যে, যে কাজ করতে ভাল লাগে তাতে কখনো ক্লান্তি আসে না এবং আমি এই কথার সারবত্তা খুঁজে পেয়েছি আমার জীবন থেকেই। প্রচ- পরিশ্রম এবং সময় ব্যয় করে, অনেক সময় রাত্রির ঘুমকে চোখ থেকে বিতাড়িত করে কাজ করে গেছি, পেটের দায়ে নয়। যা ভালবাসি সেই কাজে, আমার কখনও ক্লান্তি আসেনি। আমার নির্দেশিত প্রথম নাটক বাদল সরকারের ’বাকি ইতিহাস’ নিয়ে আমি বড় ভীত ছিলাম। আমি হয়তো আগেও লিখেছি যে এই নাটকটির নির্দেশনার ভার আমাকে অনাহূতভাবে চাপিয়ে দেন আমাদের দলের সুহৃদ, শুভানুধ্যায়ীরা। ভয় পেয়েছিলাম তবে পিছ্পা হইনি। তখন যৌবনকাল, হৃদয়ে উপচে পড়তো দুঃসাহস। করলেই হয়, এই ধরনের একটা প্রত্যয় সবসময় অনুপ্রাণিত করতো আমাকে। প্রযোজনাটি উতরে গিয়েছিল। এখন ভাবলে মনে হয় কত অকিঞ্চিৎকর কাজ হয়েছিল সেটি। আজকে হলে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ভাবতাম হয়তো। এরপরে নির্দেশক হিসেবে দু’একটি ভাল কাজ যে হয়নি তা নয় কিন্তু তা আমাকে সম্পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট করেনি। এইখানে আমাকে স্বীকার করতেই হয় যে অভিনেতা হিসেবে আমার কাজ অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক বেশি উন্নত হয়েছে এ পর্যন্ত। এখানে বিষয়টি পর্যলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশে তখন সবে নাট্যচর্চা শুরু হয়েছে। অতএব, নির্দেশনা সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করতে হতো দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নাটক দখে। আমরা অধিক নির্ভর করেছি কলকাতার নাটকের উপরে। কলকাতায় তখন বের্টোল্ট ব্রেশ্টের নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয়। সঙ্গীত, নৃত্য, চোখা সংলাপ, কাব্যময়তা নিয়ে ওইসব নাটকের এমন সব চমকপ্রদ প্রদর্শনী হতো যে চোখ ফেরানো যেত না। অতএব, আমি একজন নব্য নির্দেশক হিসেবে নাটকের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা না করে বাহ্যিক চাকচিক্যের দ্বারা আকর্ষিত হতাম বেশিরভাগ। সেই প্রলেপ আমার কাজেও অনেক সময় অনাহূতভাবে চেপে বসেছে। স্বীকার করতেই হয় যে আমার ওই অকিঞ্চিৎকর প্রচেষ্টা জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। কেননা আমাদের সাধারণ দর্শক তখনও আপাত রম্য ভেদ করে নাটকের গভীরে প্রবেশ করতে শেখেনি। এই জনপ্রিয়তা, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমাকে আরও লোভী করে তুলেছে। অতএব, সততা ক্ষুণœ হয়েছে। অভিনয়ের ক্ষেত্রে এই লোভ সংবরণ করতেই হয়েছে চরিত্র এবং সংলাপের দাবিতে। যেমন, শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের প্রধান চরিত্রের এক অমোঘ সংলাপ: ‘এটা হওয়া কিছু নয়, এটা হয়ে থাকাটাই কিছু। ব্যাঙ্কোকে নিয়ে যে শঙ্কা, অন্তরে শেলের মতো আমাদের, আমি আর কারো নয় শুধু তার অস্তিত্বে শঙ্কিত আছি।’ এই সংলাপটি বিশ্বস্তভাবে উচ্চারণ করতে হলে এর শরীরে রং চড়ানো কি সম্ভব? ভেতর থেকেই সংলাপে উচ্চারিত শংকাটি প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বেরিয়ে আসে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, পরে হয়তো আরও বিশদ আলোচনা করবো যে, অতি অভিনয় কখনই বিশ্বাসযোগ্য হয় না। অতএব সুউচ্চারণে স্পষ্টভাবে কথা বলে গেলেই তা সংলাপ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। এই যে সংলাপের ভেতরে প্রবেশ করা, সংলাপটিকে আত্মস্ত করা এবং চরিত্রকে আত্তীকরণ করা এই বিষয়গুলো আমরা শিখেছি রুশ নির্দেশক-অভিনেতা স্তানিস্লাভস্কি’র কাছ থেকে। এই পদ্ধতিকে পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় ‘মেথড স্কুল’। কিছু কিছু প-িতদের মতে প্রখ্যাত জার্মান নাট্যকার-নির্দেশক বার্ট্রল্ট ব্রেশ্ট, একটি পদ্ধতি অনুসরণ করতেন যেটার নামকরণ করা হয়েছিল ’এপিক স্কুল’। বলা হয়ে থাকে যে এই স্কুলের মতে চরিত্রের সঙ্গে কখনই একাত্ম হওয়া যাবে না। চরিত্রের মাঝে যেন অভিনেতা হারিয়ে না যায় সেদিকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে। আমি এত বছরের অভিনয় জীবন পার করবার পর এখনও বুঝে উঠতে পারিনি যে কি করে চরিত্রের সঙ্গে বিযুক্ত থেকে চরিত্রটির প্রতি সুবিচার করা যায়। এই বিষয়টি এতই জটিল এবং বিস্তৃত যে তা নিয়ে একটি গ্রন্থই রচনা করা যায় হয়তবা। এ নিয়ে আরও বিশদ কথা হবে বারান্তরে। আজ এইটুকুই।
×