ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমূল সংস্কারের পর দৃষ্টিনন্দন কান্তজীর মন্দির

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২২ মার্চ ২০১৯

আমূল সংস্কারের পর দৃষ্টিনন্দন কান্তজীর মন্দির

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ বৈচিত্রময় ও নান্দনিকতার ছোঁয়ায় আমূল সংস্কারের পর দৃষ্টিনন্দন কান্তজীর মন্দির ও নয়াবাদ মসজিদ দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে আগত পর্যটকদের ভীড়ে মুখরিত এখন কান্তনগর ও নয়াবাদ গ্রাম এলাকা। দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে ঐতিহাসিক এ মসজিদ ও মন্দির দেখতে আসছেন পর্যটকরা। প্রাচীণ স্থাপত্যের অনন্য এ নিদর্শনগুলো দেখে পর্যটকদের চোখে-মুখে রীতিমত তৃপ্তির ছাপ দেখা যায়। স্থানীয় সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালের প্রচেষ্টায় ওই মসজিদ ও মন্দির অবকাঠামোর যে সংস্কার হয়েছে তা স্থাপনাগুলোকে করেছে নান্দনিক, বৈচিত্রময় ও দর্শনীয়। রাতের আধাঁর নেমে আসার সাথে সাথে আলোক রশ্মি যেন স্থাপনাগুলোকে নতুন যৌবন দিয়ে দেয়। প্রাচীণ এ মসজিদ ও মন্দির তখন হয়ে ওঠে চোখ জুড়ানো স্থাপত্য। দিনাজপুর জেলা সদর হতে ২০ কিঃ মিঃ উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর হতে ৭ কিঃ মিঃ দক্ষিণ পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নে দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেপা নদীর তীরে কান্তনগর এলাকায় প্রাচীণ টেরাকোটার অনন্য নিদর্শন কান্তজীর মন্দির অবস্থিত। কালিয়াকান্ত জিউ অর্থাৎ শ্রী-কৃষ্ণের বিগ্রহ অধিষ্ঠানের জন্য মন্দির নির্মিত হয় বলেই এই মন্দিরের নাম কান্তজীর মন্দির। প্রায় ১ মিটার (৩ ফুট) উঁচু এবং প্রায় ১৮ মিটার (৬০ ফুট) বাহু বিশিষ্ট প্রস্তর নির্মিত একটি বর্গাকার বেদীর উপর এই মন্দির নির্মিত। শোনা যায়, বেদীর পাথরগুলো আনা হয়েছিল ভারতের প্রাচীন বানগড় নগরের ভেঙ্গে যাওয়া প্রাচীন মন্দিরগুলো হতে। পাথরের ভিত্তি বেদীর উপর মন্দিরটি ইটের তৈরী। বর্গাকারে নির্মিত মন্দিরের প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬ মিটার (৫২ ফুট)। মন্দিরের চারিদিকে রয়েছে বারান্দা। প্রত্যেক বারান্দার সামনে রয়েছে ২টি করে স্তম্ভ। স্তম্ভগুলো বিরাট আকারের এবং ইটের তৈরী। স্তম্ভ ও পাশের দেওয়ালের সাহায্যে প্রত্যেক দিকে ৩টি করে বিরাট খোলা দরজা তৈরী করা হয়েছে। বারান্দার পরেই রয়েছে মন্দিরের কামরাগুলো। একটি প্রধান কামরার চারিদিকে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট কামরা। ৩ তলা বিশিষ্ট এই মন্দিরের নয়টি চূড়া বা রতœ ছিল। এজন্য এটিকে নবরতœ মন্দিরও বলা হয়ে থাকে। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মন্দিরের চূড়াগুলো ভেঙে গেছে। মন্দিরের উচ্চতা ৭০ ফুট। মন্দিরের উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি হতে জানা যায়, দিনাজপুরের জমিদার মহারাজা প্রাণনাথ রায় (মৃত্যু ১৭২২ খৃঃ) তার শেষ জীবনে মন্দির তৈরীর কাজ শুরু করেন এবং তার মৃত্যুর পর তার আদেশ অনুসারে দত্তক পুত্র মহারাজা রামনাথ রায় এই মন্দির তৈরীর কাজ শেষ করেন ১৭৫২ খৃষ্টাব্দে। ইট দ্বারা তৈরী এই মন্দিরের গায়ে পোড়ামাটির চিত্রফলকের সাহায্যে রামায়ণ-মহাভারতের প্রায় সব কয়টি প্রধান কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। সে সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন কাহিনী এবং সম্রাট আকবরের কিছু চিত্র কর্ম রয়েছে। অতি সুন্দর ও কারুকার্যময় এই কান্তজীর মন্দির। পোড়া মাটির চিত্র ফলকের এমন সুন্দর ও ব্যাপক কাজ বাংলার আর কোন মন্দিরেই নেই। সারা উপমহাদেশেও আছে কিনা সন্দেহ। ঐতিহাসিক বুকানন হ্যামিলটনের মতে, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরতম মন্দির। কান্তজীর বা শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ ৯ মাস এই মন্দিরে অবস্থান করে এবং রাস পূর্ণিমায় মাস ব্যাপী তীর্থ মেলা বসে। দেশ-বিদেশ হতে বহু পূণ্যার্থী আসেন এই মেলায় এবং মন্দিরটি দেখতে। মন্দিরটি দীর্ঘদিন যাবৎ সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে ধীরে ধীরে এটি দেখতে আসা মানুষের সংখ্যা কমতে শুরু করে। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল মন্দিরটি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। মূলতঃ পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণে তার এ উদ্যোগ। টেরাকোটা অলঙ্করণের বিস্ময় জাগানিয়া কান্তজিউ মন্দিরকে ঘিরে একটি পর্যটন এলাকা গড়ে তুলতে তার প্রচেষ্টা সফলতা লাভ করে। এখন সেখানে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসছেন মন্দির পরিদর্শনে। পর্যটকদের ভীড়ে এলাকায় নতুন প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। কর্মজীবী মানুষেরা ফিরে পেয়েছে যেন নতুন জীবন। শুধু তাই নয়, দিনাজপুর জেলা শহর থেকে মন্দিরে যাবার জন্য ঢেপা নদীর উপর তৈরি হয়েছে ব্রীজ। ওই ব্রীজটি না থাকায় প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরে মন্দিরে যেতে হতো। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের জন্য সেখানে থাকার কোন পরিবেশ ছিল না। সে কারনে মন্দিরের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে পর্যটন মোটেলের আকর্ষনীয় রেষ্ট হাউজ। দর্শনার্থীদের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানাতে নির্মাণ করা হয়েছে মিউজিয়াম। কেনা-কাটার সুবিধার্থে পাশেই মার্কেট তৈরি করে এর আশপাশের রাস্তা উন্নয়ন করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী শিব মন্দির ও রাজবেদী সংস্কার করে আমুল পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রবেশ দ্বারে স্থাপন করা হয়েছে তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতি স্তম্ভ। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘সিদু কানু’ চত্তর। বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ ডি.সি রায় বলেন, অনালোকিত শ্রী শ্রী কান্তজীর মন্দির আলোকিত হয়েছে। যেখানে যাওয়ার রাস্তাই ছিল না সেই মন্দির আজ পাকা রাস্তা, ব্রীজ, ঝলমলে বিদ্যুত্যের আলোয় আলোকিত এবং পর্যটক ও পুজারীদের পদচারনায় মুখরিত এই তীর্থস্থানের জন্য সত্যিই আমি গর্বিত।
×