ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জ্যোৎস্নালিপি

আমার মায়ের হাতপাখাটি

প্রকাশিত: ০৮:৩৫, ২৩ মার্চ ২০১৯

আমার মায়ের হাতপাখাটি

আমি তখন বেশ ছোট। ক্লাস থ্রিতে পড়ি। প্রায় সব সময়ই মায়ের গায়ে গায়ে লেপটে থাকতাম। মা বলত, সব সময় মায়ের গায়ে লেগে থাকতে হয় না মিনু। মা’র এখন কত কাজ। আমি মায়ের গলা জড়িয়ে বলতাম, কী কাজ মা! মা বলত, দেশের কাজ। আমি অতসত না বুঝে বলতাম, তোমার গায়ের গন্ধ ছাড়া আমার ভাললাগে না মা। মা বলত সময়টা ভাল না মিনু। আমাদের সবাইকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। আমি অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলতাম, আমিই তোমার সব কাজ মা। মা আমার গালে চুমু দিয়ে বলত, তোদের জন্যই তো একটি স্বাধীন দেশ চাই মিনু। আমি কিছু না বুঝে মায়ের গলা আরও জোরে জড়িয়ে ধরতাম। মা ফিসফিস করে বলত এভাবেই আমরা আমাদের মাকে আগলে রাখব। মা’র খুব সুন্দর একটা কাপড়ের তৈরি হাতপাখা ছিল। বেশি গরম পড়লে মা সেই পাখা দিয়ে আমাকে বাতাস করত। একদিন মা সেই হাতপাখাটা আমাকে দিয়ে বলল, এই পাখাটা তোর বিলু কাকার কাছে দিয়ে আসতে পারবি? আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, তাহলে রাতে আমায় বাতাস করবে কী করে! মা কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলল, দিয়ে আসতে পারবি কি না বল? আমি বললাম খুব পারব। আসলে বিলু কাকার কাছে গেলে রঙিন রঙিন গুঁড়া লজেন্স পেতাম। সেই লজেন্স মুখে দিলে জিহ্বা রঙিন হতো। আমরা বন্ধুরা মিলে সেগুলো খেয়ে দেখতাম, কার জিহ্বা কত রঙিন হয়েছে। শিউলি, নমিতা, সরলা অনিতা, দিপক, প্রদীপ, সুমন সবাই লোভে লোভে থাকত, আমি কখন ওদের গুঁড়া লজেন্স দেব সেই আশায়। বিলু কাকা আমার জন্য আগে থেকেই গুঁড়া লজেন্স কিনে রাখত, আমি গেলেই সেটা আমার হাতের মুঠোর মধ্যে ধরিয়ে দিত। আর মায়ের হাতপাখাটা নিয়ে একই রকম একটা হাতপাখা আমার হাতে দিয়ে বলতে, এটা তোর মাকে দিস। আমি একই রকমের পাখা হাতে নিয়ে বাতাস খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। মা সেই পাখাটা আমার হাত থেকে নিয়ে বাবার হাতে দিত। বাবা পাখা নিয়ে বাতাস খেতে খেতে ঘরে চলে যেত। একদিন মা আমাকে ডেকে বলে, মিনু তুই তো অনেক ছোট, সময়টা ভাল না এখন একা একা বাইরে যেতে নেই। আমি বলি, কেন যেতে নেই মা? মা বলে, এখন তো যুদ্ধ চলছে তাই। আমি বলি, যুদ্ধ কি মা? মা বলে, তুই বুঝবি না। আগে বড় হ। আমি বলি, আমি বড় হব মা। মা বলে, যুদ্ধকালে কেউ বড় হতে পারে না মিনু। আমি আবার বলি, যুদ্ধ কি মা? মা বলে, যুদ্ধ মানে শিশুদের ঘরের বাইরে না যাওয়া। স্কুলে না যাওয়া। বাবার আদর না পাওয়া। যুদ্ধ মানে গুঁড়া লজেন্স খেতে না পাওয়া। আমার মনে এটাই গেঁথে যায়, যুদ্ধ মানে গুঁড়া লজেন্স খেতে না পাওয়া। গুঁড়া লজেন্স খেতে না পাওয়ার দুঃখে আমাদের সবার মন থারাপ হয়। আমাদের স্কুলে যাওয়া হয় না। আমরা শিশুরা বুঝে যাই আগের মতো আর আমাদের দিন যাচ্ছে না। বাবাকেও আর কাছে পাই না। মা’র কাছে জানতে চাইলে মা বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন সন্ধ্যায় চুপি চুপি বাবা বাড়িতে আসে। মা ফিসফিস করে কথা বলে। আমি কাছে যেতেই বাবা আমার গালে আদর করে দেয়। আমি বলি, আমি স্কুলে যাব কবে বাবা? কবে মাছ খেতে পাব? বাবা বলে, খুব তাড়াতাড়ি। আমি হাততালি দিয়ে বলি, তাহলে আমি গুঁড়া লজেন্স খেতে পাব! আমার জিভ লাল হবে! বাবার চোখে জল দেখে আমি বলি, মা বাবা কাঁদছে কেন? তুমি কি বাবাকে বকেছ? মা বলে, তুই কি একটা কাজ করতে পারবি? আমি বলি বল? মা তার হাতপাখাটা দেখিয়ে বলে, এটা তোর বিলু কাকাকে দিতে পারবি। আমি গুঁড়া লজেন্সের লোভে বলি, খুব পারব। যদিও রাতের আঁধারে আমার ভয় করে। আমি মায়ের হাতপাখা নিয়ে আমাদের স্কুল ঘরের পেছনে একটা ঝোঁপের আড়ালে বিলু কাকা আর গুঁড়া লজেন্সের আশায় বসে থাকি। ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে আসে। বিলু কাকা আসে না। আমার গুঁড়া লজেন্স পাওয়া হয় না। অনেক রাত অবধি গুঁড়া লজেন্সের আশায় থেকে বাড়ি ফিরলে মা আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। আমি বুঝি না মায়ের কান্না। শুধু বলি, মা কান্না কর না, আমার গুঁড়া লজেন্স লাগবে না! পরদিন সকালে বিলু কাকার লাশ দেখতে আমরা নদীর পাড়ে যাই। আমি জানি বিলু কাকার হাতের মুঠিতে মোড়ানো সাদা কাগজ আর পাশে পড়ে থাকা লাল, নীল, গোলাপি, সবুজ রঙের গুঁড়া লজেন্স আমারই জন্য ছিল। আমি বিলু কাকা, বিলু কাকা বলে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলি, বিলু কাকা আমার গুঁড়া লজেন্স চাই না। বাড়ি ফিরে মাকে বলি, মা আমি আর কখনও গুঁড়া লজেন্স খাব না। মা সেই হাতপাখাটি নিয়ে একটা টিনের বাক্সের মধ্যে তালা বন্ধ করে রেখে দেয়। তারপর একদিন যুদ্ধ শেষ হয়। স্বাধীন দেশে আমিও বড় হই। যুদ্ধ আর স্বাধীনতার মানে বুঝতে শিখি। কিন্তু আমার মা আর আমার বাবার জন্য অপেক্ষা শেষ হয় না। একদিন মাকে বলি, মা তোমার সেই হাতপাখটা আমায় দেবে? যা আমি বিলু কাকাকে দিতে পারিনি। মা হাতপাখাটিকে বাক্স থেকে বের করে আনে। আমি হাতপাখাটি নেড়েনেড়ে দেখি। হাতপাখাটির বুকে কিছু আঁকিবুঁকির সঙ্গে লাল সবুজ দিয়ে লেখা রয়েছে, জয় বাংলা। আমি হাতপাখাটির গায়ে হাত বুলিয়ে বিলু কাকা আর আমার বাবার স্পর্শ পাই। আমার দুচোখ ভরে জল আসে। আমি আমার সমস্ত শক্তি গলায় এনে বলি, জয় বাংলা। অলঙ্কারণ : প্রসূন হালদার
×