ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলায় টাইপ তৈরিতে যাদের অবদান অনস্বীকার্য

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ২৩ মার্চ ২০১৯

 বাংলায় টাইপ তৈরিতে যাদের অবদান অনস্বীকার্য

পীয়্যান মুগ্ধ নবী ॥ কম্পিউটার, স্মার্টফোন থেকে শুরু করে একেবারে সরল বাটন ফোন, সবখানেই আপনি দিব্যি বাংলায় লিখে ফেলতে পারছেন যখন তখন, খুব সহজে। বাংলায় টাইপ করার ব্যাপারটি যত সহজ দেখছি আমরা আজকের দিনে, দেড় যুগ আগেও বিষয়টা অতটা সহজ ছিল না। আর অর্ধশতাব্দী আগে বাংলায় টাইপ ব্যাপারটিই ঠিকমতো ছিল না। অবাক করা হলেও ঘটনাটি এমনই। এত সহজে বাংলায় টাইপ করে চলেছি কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের পর্দায়, তার জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে যে মানুষটার কাছে তিনি মুনীর চৌধুরী। ‘কবর’ এবং ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকদ্বয়ের রচয়িতা মুনীর চৌধুরী। নাট্যকার, শিক্ষাবিদ, সাহিত্য সমালোচক এসব পরিচয়ের বাইরেও তিনি ছিলেন ভাষাবিজ্ঞানী। ঐ দুই বিখ্যাত নাটক রচনার মধ্যবর্তী সময়ে তিনি উদ্ভাবন করেন প্রথম বাংলা টাইপ রাইটার লেআউট ‘মুনীর অপটিমা’। শুরুতে বাংলা টাইপ রাইটারের প্রবর্তন করে রেমিংটন বোন্ডে নামের এক আমেরিকান কোম্পানি। ইংরেজী টাইপরাইটারের শুরুটাও তাদের হাতেই হয়েছিল। রেমিংটন বোন্ডের বাংলা টাইপরাইটার থাকলেও সেটি খুব একটা কার্যকরী ছিল না, বাংলা ভাষা টাইপিংয়ের ক্ষেত্রে তখনও রোমান হরফের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সে সব সঙ্কট বিবেচনা করেই ১৯৬৫ সালে মুনীর চৌধুরীর হাত ধরে আসে প্রথম বাংলা টাইপরাইটার লেআউট। এটি যেন ছিল বাংলা ভাষার জন্য এক অভাবনীয় বিপ্লব। তবে এই লেআউটেরও ছিল অনেক সীমাবদ্ধতা। এসব সীমাবদ্ধতা নিয়েও এই লেআউট একলাই চলেছে প্রায় দুই যুগ। তবে এটি শুধু ব্যবহার হতো টাইপরাইটারেই। কিন্তু আশির দশকে এসে কম্পিউটার যখন খুব বেশি ‘স্পেশাল’ কিছু, তখন এক প্রকৌশলী মুনীর অপটিমার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে গিয়ে ভাবলেন কম্পিউটারেই বাংলা লেখার কথা। প্রকৌশলী সাইফ শহীদের কাছে তখন যে কম্পিউটার ছিল (তঢ ৮১) সেটিকে টিভি স্ক্রিনের সঙ্গে যুক্ত করে এক ‘ব’ বর্ণ লিখতেই কম্পিউটারের পুরো ১৬ কিলোবাইট মেমোরি খরচ হয়ে গিয়েছিল। তারপর তিনি নিজেই লেগে পড়েন কম্পিউটারে টাইপ করার জন্য একটি লেআউট তৈরিতে। আশির দশকের শুরুতে তিনি ছিলেন জাপানে। সেখানে জাপানী এক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তিনি শুরু করেন বাংলা লেআউটের কাজ। পরে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে ফিরে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণমালা’ বইটি দুই টাকা দিয়ে কিনে সেখান থেকে বর্ণমালা মেট্রিক্সে রূপান্তর শুরু করেন। যুক্তবর্ণ এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে জটিলতা ধীরে ধীরে সমাধান করতে করতে অবশেষে ১৯৮৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনটি ফন্টে প্রকাশিত হয় কম্পিউটারে লেখার উপযোগী প্রথম বাংলা লেআউট ‘শহীদলিপি’। প্রথমে শুধু ম্যাকের জন্য হলেও পরবর্তীতে উইন্ডোজের জন্যও লেআউট বানানো হয়। অবশ্য এই লেআউটের ‘শহীদ’ সাইফ শহীদ নিজে নন, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাতেই তিনি এই নাম রেখেছিলেন। শহীদলিপি থাকলেও ব্যক্তিগত কম্পিউটারে বাংলা লেখার ব্যাপারটা তখনও খুব একটা সহজ ছিল না। সে লক্ষ্যেই তৎকালীন সাংবাদিক ও পরে ব্যবসায়ী মোস্তফা জব্বার কাজ শুরু করেন পার্সোনাল কম্পিউটারে সহজে বাংলা লেখার জন্য একটি নতুন লেআউট নিয়ে। পরবর্তীতে মোস্তফা জব্বার এবং তার দলের প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় সম্পূর্ণ নতুন একটি লেআউটসহ বাংলা লেখার সফটওয়্যার ‘বিজয়’। পুরনো সীমাবদ্ধতাগুলো অনেকাংশেই লুপ্ত হয়। দীর্ঘদিন ধরে এটি পত্র-পত্রিকাসহ বিভিন্ন অফিসে ব্যবহৃত হয়েছে, হচ্ছে। ব্যক্তিগত ব্যবহারের কাজেও অনেকে বিজয় কিবোর্ড ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই কিবোর্ড লেআউটটিও কিনতে হতো। তবে এই শতাব্দীর শুরুর দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের এক তরুণ ছাত্র মেহেদী হাসান খান ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’ স্লোগানে শুরু করেন এক অভাবনীয় কাজ। রিফাতুন্নবি, তানভিন ইসলাম সিয়াম, রাইয়ান কামাল, শাবাব মুস্তফা, নিপুণ হক, সারিম খান- এই বন্ধুদের নিয়ে মেহেদী প্রকাশ করলেন প্রথম বাংলা ফোনেটিক লেআউট ‘অভ্র’। ফোনেটিকের ধারণাটা অনেকটা এমন, রোমান হরফেই কেউ একজন ‘ধসর’ লিখলে সেটি ‘আমি’ হয়ে যাবে। এই ফোনেটিক লেআউটের ভিত্তি করেই বানানো হয় ‘অভ্র’ বাংলা কিবোর্ড। অভ্র ছিল একেবারেই বিনামূল্যের একটি সফটঅয়্যার। ব্যস, কম্পিউটারে বাংলা লেখালেখি যেন সত্যিই সবার নাগালে চলে আসল। নতুন কোন লেআউট শেখার ঝামেলা আর রইল না। কম সময়ের মাঝেই অভ্র খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। সঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে অনলাইনেই বাংলা লেখা। মুনীর চৌধুরীর হাত ধরে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা যেন মেহেদী হাসান খানের কাজে একরকম পূর্ণতা পায়। এখন কত সহজেই স্বল্পশিক্ষিত একজন মানুষের পক্ষেও গড়গড় করে বাংলা লিখে ফেলা যথেষ্ট সহজ। ভাষা যেন হয় সত্যিই উন্মুক্ত।
×