ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিবচর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে মডেল

সড়কের মোড়ে মোড়ে ভাস্কর্য

প্রকাশিত: ০৮:৩৯, ২৩ মার্চ ২০১৯

সড়কের মোড়ে মোড়ে ভাস্কর্য

এ যেন কোন এক শিল্পীর রং-তুলিতে আঁকা নিখুঁত মুক্তিযুদ্ধময় এক ছবির জনপদ। কোথাও নৌকায় চড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের’ প্রবহমান ’৭১ ভাস্কর্য, কোথাও অস্ত্র হাতে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে’ স্বাধীনতা স্মৃতি স্তম্ভ ভাস্কর্য, রয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ, কোথাও রয়েছে সড়ক ’৭১, আবার ৭১ চত্বরসহ অসংখ্য ভাস্কর্য-স্মৃতি স্তম্ভ-মুর‌্যাল। এখানেই শেষ নয় উপজেলার বিভিন্ন সেতু, স্থাপনা, দোকানপাট সবকিছুতেই রয়েছে লাল সবুজের সমারোহ। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ভবনসহ একাধিক স্থাপনা। এ যেন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের এক বিশাল জনপদ। এমন দৃশ্য জেলার বা বাংলাদেশের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। জেলার মধ্যে শিবচর উপজেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ইতিহাস গড়ে তুলেছে। এ সব মহান কর্মের নেপথ্যে রয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, যুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর কোষাধ্যক্ষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে সাবেক এমপি মরহুম ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীর (দাদাভাই) যোগ্য উত্তরসূরি জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সাধারণ সম্পাদক নূর-ই আলম চৌধুরী এমপি। তার এ মহান উদ্যোগের কারণেই নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। শিবচর উপজেলার এ দৃষ্টান্ত দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেয়ার দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের। ভৌগোলিক কারণে পদ্মা সেতুসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশ দ্বার মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা বহুল পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই উপজেলার বীর সন্তানদের রয়েছে অনন্য অবদান। তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের এমপি ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরী দাদাভাই ছিলেন মুজিব বাহিনীর কোষাধ্যক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তার দিক নির্দেশনায় শিবচর থেকে পাশর্^বর্তী ৯ উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরী দাদাভাই এর বড় ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীর এ উদ্যোগ দেশে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। উপজেলা সদরে ঢুকতেই একের পর এক সেতু চোখে পড়বে লাল সবুজের রঙে রাঙানো। বঙ্গবন্ধুর বড় বোন চৌধুরী ফাতেমা বেগম পৌর অডিটোরিয়ামের সামনে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে পানির ফোয়ারার মাঝে নৌকায় চড়ে একদল শাড়ি পরা নারী, লুঙ্গি কাছা দেয়া খালি গায়ে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের ‘প্রবহমান ’৭১ ভাস্কর্য’। প্রায় ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত কলেজ মোড়ে অস্ত্র তাক করে ’স্বাধীনতা স্তম্ভে’ দাঁড়িয়ে আছে বীর সেনানীরা। পৌরবাজারে দীর্ঘ একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘সড়ক ’৭১’ নামে। যেখানে লাল সবুজ রঙে সজ্জিত শতাধিক দোকানও রয়েছে। ’৭১ সড়কে প্রবেশমুখেই প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি স্তম্ভ’। উপজেলা পরিষদের সামনে প্রায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে থাকা একদল মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য। শহীদদের কবরের পাশে তৈরি করা হয়েছে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ।’ যেখানে স্থানীয় ১৩ জন শহীদদের নামসহ যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। শেখ ফজিলাতুন্নেছা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রায় ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে শেখ ফজিলাতুন্নেছার এক অসাধারণ ভাস্কর্য। ’৭১ চত্বর, বিজয় চত্বর, বরহামগঞ্জ চত্বর, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ অসংখ্য ম্যুরাল। যার প্রায় সবগুলোই স্থানীয় সংসদ সদস্য নূর-ই-আলম চৌধুরীর নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করে নির্মাণ করা হয়েছে। এ সব ভাস্কর্য, ম্যুরালসহ বিভিন্ন স্থাপনা মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বহন করছে। বিভিন্ন রাস্তাঘাট শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ, স্কুলের বিভিন্ন ভবন মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ, বিভিন্ন সেতু মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাট-বাজারের দোকানপাটও লাল সবুজ সাজে সজ্জিত। সব মিলিয়ে এ যেন জাতীয় পতাকার লাল সবুজের সমারোহ ও ভাস্কর্য সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনপদ। এ সকল স্মৃতি স্তম্ভে সকল জাতীয় দিবস পালন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানমালার। এসব অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে শিবচরকে মডেল গণ্য করার দাবী বীর মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি, সাধারণ জনগণসহ সকলের। স্কুল শিক্ষার্থী আলমাস বলেন, ‘আমরা কখনও শিবচরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতাম না। বর্তমানে বাজারের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য দেখে মুরব্বিদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধে শিবচরের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারছি আর গর্বিত হচ্ছি।’ রিজিয়া বেগম মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ বাবুল আশরাফ বলেন, ‘শিবচর যেন এক মুক্তিযুদ্ধের শহরে রূপ নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এত স্মৃতি সংরক্ষণ আর কোথাও নেই। এখান থেকে শিক্ষা নিয়েই নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হতে পারবে।’ মুক্তিযুদ্ধকালীন ২নং এরিয়া কমান্ডার মোসলেমউদ্দিন খান বলেন, ‘আমাদের সংসদ সদস্য যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ করছেন তাতে আমরা গর্বিত।’ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শাজাহান চৌধুরী বলেন, সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে শিবচরকে মডেল হিসেবে নেওয়া উচিত।’ শিবচর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সামসুদ্দিন খান বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মরহুম ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরীর (দাদাভাই) সন্তান আমাদের সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা সারাদেশের মধ্যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’ শিবচর উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম তালুকদার বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে আমাদের সংসদ সদস্যের নির্দেশে ইতোমধ্যেই আমরা প্রবহমান ’৭১, স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ, ’৭১ চত্বর, ’৭১ সড়কসহ বিভিন্ন ভাস্কর্য ও ম্যুরাল নির্মাণ করেছি। যা মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বহন করছে।’ শিবচর পৌর মেয়র আওলাদ হোসেন খান বলেন, ‘আমাদের শিবচর উপজেলায় যে দিক থেকেই কেউ প্রবেশ করুক নজরে পড়বে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমৃদ্ধ বিভিন্ন ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও লাল সবুজের বিশাল সমারোহ। আর মুক্তিযুদ্ধের এ সকল স্মৃতি সংরক্ষণে আমাদের সংসদ সদস্য নিজস্ব তহবিল থেকেই অধিকাংশ ব্যয় করেছেন। এছাড়া পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ থেকেও কিছু কিছু স্মৃতি সংরক্ষণে ব্যয় করা হয়েছে।’ শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে শিবচর উপজেলা ও এ সবের মূল উদ্যোক্তা জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী এমপি সারাদেশে দৃষ্টান্ত হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে শিবচরকে আমার কাছে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে স্থানীয় সংসদ সংদস্যের এ দেশপ্রেম সত্যি বিরল।’ জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ ও আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সাধারণ সম্পাদক নূর-ই-আলম চৌধুরী এমপি বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে আমাদের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। সারা উপজেলাকেই মুক্তিযুদ্ধের আলোকে সাজাতে চাই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় ছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সম্পূর্ণরূপে বিকৃত করেছে। আমরা এমন কিছু করতে চাই যেন আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে জীবন ধারণ করতে পারে।’ -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×